আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

প্রবীর সিকদারের অপরাধগুলো খতিয়ে দেখা হোক

ফকির ইলিয়াস  

একজন পঙ্গু সাংবাদিক। ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটেন। বাম হাত অবশ। সমস্ত শরীর জুড়ে বহন করছেন বোমার অনেকগুলো স্প্রিন্টার। এক সময় তিনি দৈনিক জনকণ্ঠে ‘তুই রাজাকার’ সিরিজে কয়েকটি লেখা লিখেছিলেন। তার নাম প্রবীর সিকদার। একজন সিনিয়র সাংবাদিক, বাংলাদেশের। তাকে চেনেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও। তিনি চীন সফর করেছিলেন সরকারি টিমের সদস্য হিসেবেই।



সেই প্রবীর সিকদারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি নিজের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় গিয়েছিলেন জিডি করতে। তার জিডি গ্রহণ করা হয়নি। এরপর তিনি নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। এ নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার পরই শুরু হয় নানামুখী তৎপরতা। তাকে ঢাকায় গ্রেপ্তার করে ফরিদপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। বলা হয়, মামলা সেখানে হয়েছে। যিনি মামলা করেছেন তার নাম স্বপন কুমার পাল। জানা গেছে তিনি নাকি একজন আইনজীবী। তার আরেক পরিচয় আছে। তিনি ফরিদপুর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের উপদেষ্টা।



আমরা প্রকাশিত সংবাদে দেখেছি, ফেসবুকে লেখালেখিকে কেন্দ্র করে হুমকি পাওয়ার পর নিজের নিরাপত্তাহীনতার কথা তুলে ধরে ঢাকায় থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে গিয়েছিলেন একাত্তরে শহীদের সন্তান প্রবীর সিকদার। ১৯৭১ সালে তার পিতাসহ পরিবারের ১৪ জন সদস্য তিনি হারিয়েছেন। সেই শহীদের সন্তানকে হাতে হাতকড়া পরিয়ে হাজতে নেয়া হয়েছে। কেন তার হাতে হাতকড়া? তিনি দৌড় দেবেন? তিনি তো পঙ্গু। দৌড় দেয়ার ক্ষমতা তার নেই। তিনি কি পুলিশের উপর আক্রমণ করবেন? তার হাতটি অবশ। সে ক্ষমতাও তার নেই। তা হলে? কেন তার হাতে হাতকড়া?



আমরা অতীতে দেখেছি একাত্তরের কুখ্যাত ঘাতক-দালালদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। না, তাদের হাতে হাড়কড়া পড়েনি। বরং পুলিশ মাথায় ছাতি ধরে তাদের এগিয়ে নিয়ে গেছে। কেউ কেউ মুখ ভ্যাংচিয়ে ‘ভি’ দেখিয়েছে ভিক্টরি চিহ্ন হিসেবে! ভিক্টরি মানে বিজয়। একাত্তরে যারা পরাজিত হয়েছিল তারাই বিজয় চিহ্ন দেখিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে। এটাই আজ বাঙালির নিয়তি! এটাই আজ মহান বিজয়ের নিয়তি!



খুব বেদনার ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মাত্র কদিন আগে জাতি ‘জাতীয় শোক দিবস’ পালন করেছে। ১৫ আগস্ট কোনোদিন ভুলতে পারবে না এই জাতি। সেই শোকের দিনেই দাপট দেখানোর জন্য দেশে-বিদেশে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ করেছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। কুষ্টিয়ায় শোক দিবসের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গোলাগুলি হয়েছে। একজন নিহত হয়েছেন। দুপক্ষের এ সংঘর্ষে কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়েছেন।



ওয়াশিংটন দূতাবাসের শোক দিবসের অনুষ্ঠানে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন আওয়ামী লীগের প্রবাসী নেতাকর্মীরা। এ সময় প্রতিপক্ষের চেয়ারের আঘাতে এক যুবলীগ নেতার মাথা ফেটে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্র পুলিশ হস্তক্ষেপ করে। এ সময় দুজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও অবহিত করেছে ওয়াশিংটন দূতাবাস। এই হলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অনুসারী কিছু মানুষের কাজকর্মের খতিয়ান।



একটি বিষয় আমরা দেখছি, এ সময়ে অনেক জামায়াত-বিএনপি সমর্থকও আওয়ামী লীগে যোগ দিতে শুরু করেছে। একই অবস্থা আমরা ১৯৭৭-৭৮ সালেও দেখেছিলাম, যখন জিয়ার দলে ভেড়ার জন্য অনেক আওয়ামী লীগারও লাইন দিয়েছিলেন। তাহলে বিষয়টি কী প্রমাণ করছে? সবাই ভোগের অংশ চাইছে। এরা মনে করছে আওয়ামী লীগ অনেক বছর ক্ষমতায় থাকবে, তাই এই দলে ভেড়া ছাড়া হালুয়া-রুটির কোনো ভবিষ্যৎ নেই।



চট্টগ্রামের সাতকানিয়া পৌরসভার মেয়র হাজী মোহাম্মদুর রহমান বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। জানা যায়, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর হাজী মোহাম্মদুর রহমান বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। ২০০৩ সালে তিনি বিএনপিতে যোগদান করেন। এরপর বিএনপির ব্যানারে নির্বাচন করে পরপর দুই বার সাতকানিয়া পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। তিনি মূলত আগামী পৌরসভা নির্বাচনকে টার্গেট করেই বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন বলে স্থানীয় অনেকে মনে করছেন। যোগদান অনুষ্ঠানে মোহাম্মদুর রহমান প্রতিজ্ঞা করে বলেছেন, তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো দিন বেইমানি করবেন না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকের মধ্যে লালন করে এখন থেকে দলের জন্য কাজ করে যাবেন।’ আমাদের মনে আছে এমন অনেক প্রতিজ্ঞা বুকে নিয়েই খন্দকার মোশতাকরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১৯৭১ সালে ছিল। পরে এরাই কাল হয়। কারণ এরা সুবিধাবাদী। যাদের কিছুই চাওয়ার নেই, তারাই মুক্তিযুদ্ধের পাশে আছে এবং থাকবে। সুবিধাবাদীরাই ১৯৭৫-এর বেনিফিশিয়ারি, সে কথা কি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ভুলে গেছেন?



প্রবীর সিকদার আক্রান্ত সাংবাদিক। তিনি লেখালেখি করেন। তিনি সন্ত্রাসী নন। তিনি যা লেখেন তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তিনি কি লিখে অপরাধ করেছেন? তার রিপোর্ট কি কারো ক্ষতির কারণ হয়েছে? কিভাবে হয়েছে? কেন হয়েছে? এর নেপথ্যে কি? তা খতিয়ে দেখাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।



সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের মুক্তি দাবি করেছে ‘কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস’-নিউইয়র্ক। ১৭ আগস্ট ২০১৫ তারিখে দেয়া বিবৃতিতে সংস্থাটি বলেছে, একজন মন্ত্রী ও একজন ধনকুবেরের বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণে রোষাণলে পড়েছেন এই সাংবাদিক। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)-এর প্রোগ্রাম রিসার্চ এসোসিয়েট সুমিত গালহটরা বিবৃতির পক্ষে বলেছেন- আমরা চাই প্রবীর সিকদারকে শিগগির মুক্তি দেয়া হোক। এবং কে বা কারা তাকে হুমকি দিচ্ছে, তা সরকার শনাক্ত করুক। আমাদের জানা আছে, ২০০১ সালে প্রবীর সিকদারকে বোমা মেরে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। কেন হয়েছিল? কে করেছিল? তাও খতিয়ে দেখা দরকার।



একটা বিষয় জানিয়ে রাখি, সিপিজের প্রোগ্রাম রিসার্চ এসোসিয়েট সুমিত গালহটরা গত ফেব্রুয়ারি ২০১৫ বাংলাদেশ সফর করেন। তিনি নিউইয়র্ক ফিরে Mission Journal: Bangladeshi press reined in as Hasina exerts authority শিরোনামে একটি রিপোর্ট লিখেন। যা সিপিজে এর ওয়েবসাইটে যে কেউ পড়তে পারেন। লেখাটির লিংক এখানে আছে- https://cpj.org/blog/2015/03/mission-journal-bangladeshi-press-reined-in-as-pri.php

তা হলে কি দেখা যাচ্ছে ? যারা বিদেশি ঐ সাংবাদিক-রিসার্চ ফেলোকে তথ্য দিয়েছেন এরা কারা ? তারা কার পারপাস সার্ভ করছেন ?বিষয়গুলো সরকারের জানা এবং ভাবা দরকার।



বাংলাদেশে আইসিটি এ্যাক্ট করা হয়েছে। এই তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা স¤প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্রের ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ’।



বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগারদের হত্যা করা হচ্ছে। এর কতটা সুরাহা করতে পারছে সরকার- তা মানুষ জানতে চায়। মানুষ জানতে চায়, এ দেশে যারা যুদ্ধাপরাধী তাদেরকে প্রমাণ সাপেক্ষে যুদ্ধাপরাধী বলা যাবে কি না! শহীদ পিতার সন্তান প্রবীর সিকদারকে কেন গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার বিস্তারিত বাংলাদেশের মানুষকে জানানো হোক। তার অপরাধ খতিয়ে দেখা হোক। সেই সঙ্গে তিনি যে রিপোর্র্টগুলো লিখেছেন- এর সত্যতা কতটুকু, এর প্রমাণ কী তাও খতিয়ে দেখুক এ দেশের গোয়েন্দা সংস্থা।



একাত্তরের ঘাতক-দালালরা কোনোভাবেই যেন সরকারের ছত্রছায়ায় পার না পায়। মনে রাখতে হবে, যদি সে অপশক্তি আবার তাদের বিষদাঁত দেখানোর সুযোগ পায় তাহলে কাউকেই ছাড়বে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিষয়গুলো নিয়ে আপনি একটু গুরুত্বের সঙ্গে ভাবুন, প্লিজ।

ফকির ইলিয়াস, কবি ও কলাম লেখক। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ