প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
সাকিল আহমদ অরণ্য | ১৯ আগস্ট, ২০১৫
১৯৯৬ সালে লালপুরে এক যুবলীগ নেতা ২০০ হিন্দু পরিবার উচ্ছেদ করেছিল। এসব নিয়ে তখন পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। এবিএম মুসা লিখেছিলেন,‘ এদের রামও মারছে, রাবনও মারছে’ শিরোনামে। সেখানে তিনি বলেছেন, হিন্দুদের কাছে আওয়ামী লীগ হলো রাম। এই রাম সম্পত্তি দখলের লোভে হিন্দুদের উচ্ছেদ করে আর বিএনপি হলো হিন্দুদের নিকট রাবন। এই রাবন মনে করে শত প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও হিন্দুরা কেবল আওয়ামী লীগকেই ভোট দেয়। তাই বিএনপি, হিন্দুদের খেদিয়ে ওপার পার করে। অন্যদিকে উচ্ছেদ হওয়া হিন্দুরা কিছুদিন এখানে সেখানে ঘুরে একসময় নিজ দেশ ছেড়ে বাধ্য হয়ে ওপার (ভারত) চলে যায়।
ফরিদপুরে অব্যাহতভাবে হিন্দু পরিবার উচ্ছেদ করে চলছে রামেরা। ফরিদপুরে অসংখ্য রামের মধ্যে একজন প্রভাবশালী রামের কাহিনি বলছি। ঐ ভয়ংকর রাম ফরিদপুরে অনেকগুলো হিন্দু বাড়ি জবরদখল করেছেন, যা তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে।
সম্প্রতি তিনি ফরিদপুরের ঝিলটুলিতে রাজেন্দ্র কলেজ হিন্দু হোস্টেলের বিপরীতে অবস্থিত ‘দয়াময়ী আশ্রম’ নামের বাড়িটি যা ভাজনডাঙার জমিদার সতিশচন্দ্র গুহ মজুমদার তৈরি করেছিল সেটি দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ঐ বাড়িটির লাগোয়া যে বাড়িটি রয়েছে সেটি হলো এই রামের। এই মহান রাম হলেন, ফরিদপুরের রাজাকার খন্দকার নুরু মিয়ার পুত্র বর্তমান আওয়ামী সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এর মন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেয়াই খন্দকার মোশাররফ।
‘দয়াময়ী আশ্রম’ এর প্রতিষ্ঠাতা ভাজনডাঙার জমিদার সতিশচন্দ্র গুহ মজুমদার রাজন্দ্র কলেজের উদ্যোক্তাদের অন্যতম। সতিশচন্দ্র গুহ মজুমদার উত্তরসুরী একমাত্র সদস্য অরুণ গুহ মজুমদার। অরুণ সাহেবের একমাত্র মেয়ে তুলি মজুমদার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে।
‘দয়াময়ী আশ্রম’ বর্তমানে অর্পিত সম্পত্তি এবং খন্দকার মোশাররফ সাহেব সিস্টেম করে সকলের অজান্তে নিজেই করিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু এরপরেও একটা ঝামলো হয়ে যায়। সেটা হলো বর্তমান অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যাবর্তন আইন আংশিক কার্যকর হবার কারণে বাড়িটি অরুণ বাবু পেতে যাচ্ছেন। এই বাড়িটি প্রায় ৩ একর জায়গা জুড়ে যার বর্তমান দাম কয়েক কোটি টাকা, যাতে একটি দ্বিতল পুরাতন ভবন আর একটি পুরান মন্দির রয়েছে।
বিভিন্ন মাধ্যমের খবরে প্রকাশ, কিছুদিন আগে খন্দকার মোশাররফ এর উকিল অরুণ বাবুর কাছ থেকে জোর করে মোশাররফ সাহেবের নামে করা একটা বায়নানামা দলিলে সাক্ষর করিয়ে নেয়। আদালত প্রাঙ্গণে সকলের সামনে জোর করে স্বাক্ষর নিলেও কেউ কিছু বলার সাহস পায়নি। গত ১৩ এপ্রিল সকালে মোশাররফ সাহেব নিজে তার দলবল নিয়ে এসে অরুণবাবু কে বাড়ি ছেড়ে যেতে বললে সে অনেক কান্নাকাটি করে কিন্তু তাতে কাজ হয়না।
এরপর মোশাররফ হোসেন অরুণ বাবুর পরিবারের সবাইকে জোর করে তারই এক বাড়িতে রাখেন। অভিযোগ রয়েছে, ঐ বাড়িটিও তিনি ক’দিন আগে দখল করে নিয়েছেন আর এক হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে। অরুণ বাবুকে বাড়ি থেকে বের করার সময় তার সামনে মোশাররফ সাহেবের লোকজন মন্দিরটি ভেঙ্গে ফেলে। সে সময় মোশাররফ সাহেব কি করতে চাইছে তা স্পষ্ট নয়। তখন মূলত বাড়িটির আইনি প্রক্রিয়ার জন্য কিছুটা সময় লাগবে তাই এই কাজ করেছিলেন। এরপর অরুণবাবুর কি হয়েছিল তা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন নিশ্চয়। মোশাররফ সাহেব বলবে অরুণবাবু তার কাছে বাড়ি বিক্রি করে চলে গেছেন।
অরুণবাবু বাড়ি নিয়ে যা ঘটছে, তা বাংলাদেশে হিন্দুদের জমিজমা দখলের একটি নিত্য-নৈমিত্তিক চিত্র। অবশ্য ইদানিং প্রভাবশালীরা হিন্দু মুসলিম দেখেনা। ক্ষমতা থাকলেই অন্যদের বাড়ি, জমিজমা সব দখল করে নেয়। একুশের গানের রচয়িতা কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী এ ঘটনা শুনে নাকি হেসে মন্তব্য করেছেন ‘হিন্দুর সম্পত্তিতো গণিমতের মাল’। আসলেই তাই, সারাদেশের হিন্দুদের সম্পত্তি গণিমতের মাল মনে করেই অবাধে রাম-রাবনরা ভোগদখল করে। অবশ্য হিন্দু সম্পত্তি ভোগদখলে রামরা এগিয়ে আছে। ড. আবুল বারাকাত তার বইতে বলেছেন, বাংলাদেশে হিন্দুর সম্পত্তির প্রায় ৭০ ভাগ আওয়ামী লীগারদের দখলে।
জানা যায়, অরুণ গুহ মজুমদার এর ঘটনা শুনে বাংলাদেশ মাইনরিটি ওয়াচের এডভোকেট রবীদ্র ঘোষ তদন্ত করতে গিয়েছিলেন ফরিদপুর। সংশ্লিস্ট থানার পুলিশ তাকে বলেছে, ‘ঐ বাড়িতে গেলে তারা তার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে পারবেন না’। রবীন্দ্র ঘোষ যাওয়ার খবর শুনে স্বয়ং মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ তাকে কল দিয়েছিলেন ৮ই আগস্ট এবং জানতে চেয়েছেন, কেন তিনি ঐ বাড়িতে গিয়েছিলেন এবং যাওয়ার আগে অনুমতি নেননি কেন? একইদিন পুলিশের ডেপুটি কমিশনার ডিবি নর্থ, রবিনবাবুকে তলব করেন এবং একই বিষয়ে জানতে চান।
ফরিদপুরে অনেকের কাছেই শুনলাম যে, জেলায় মন্ত্রী মোশাররফ এর অন্যায় এর বিরুদ্ধে টু শব্দটি উচ্চারণ করার কারো সাহস নেই। মন্ত্রীর লম্বা হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধে ১৪ স্বজনহারা শহীদ সন্তান একজন পঙ্গু সাংবাদিক প্রবীর সিকদারও রেহাই পায়না!
খন্দকার মোশাররফ এপিএস ছিলো সত্যজিত মুখার্জী। বাড়ি দখল প্রসঙ্গে সত্যজিৎ সামান্য বিরুদ্ধাচারণ করায় সত্যজিৎ এবং তার পরিবারের উপর নেমে আসে মন্ত্রীর খড়গ। সম্প্রতি সত্যজিতবাবুর সম্পত্তির হিসাব চেয়েছে দুদক। একজন কেরানীর সম্পত্তির হিসাব চেয়েছে দুদক। বুঝতে নিশ্চয় অসুবিধা হয়না এ নেপথ্যের কারণ।
গত ১৬ এপ্রিল সত্যজিতের চাকুরী চলে যায়। ১৭ এপ্রিল জেলা ছাত্রলীগ কেন্দ্রের কাছে প্রস্তাব পাঠায় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দিতে, কেন্দ্র দেয়নি। ২৪ মে তাই জেলা ছাত্রলীগ কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া হয়। এপ্রিল-মে এই সময়ে সত্যজিতের বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা দায়ের করা হয়!! সত্যজিত এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এদিকে সত্যজিতকে ধরার জন্য সত্যজিতের মামলাগুলোতে তার পরিবারের সদস্যদেরও জড়ানো হয়েছে। সত্যজিতের বাবা মানস মুখার্জি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ৭০ বছর বয়সে মন্ত্রীর রোষানলে পড়ে পিতা হওয়ার অপরাধে তাকে এখন জেল খাটতে হচ্ছে। কারাগারই এখন ৭০ বছর বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধার ঘরবাড়ি।
সত্যজিত আপনি ধরা দিবেন না তাহলে আপনাকে গুম করা হতে পারে। এদেশে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠছে তাতে খুব ভয় হয়। সত্যজিতের বিরুদ্ধে আজ ১৫টি মামলা। মন্ত্রীর এপিএস থাকার আগে তার এবং কার পরিবারের বিরুদ্ধে কোন মামলা ছিলো না। অথচ চাকুরী হারানোর দুই মাসের মধ্যে তাকে রীতিমত ভয়ংকর ক্রিমিনাল বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর কেবল সত্যজিত আর তার পিতাই নয়। যারাই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে গেছেন কেউই ছাড়া পাননি। সত্যজিতের স্ত্রী শুমিকা মজুমদারের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। সত্যজিতের বাবা মুক্তিযোদ্ধা মানস মুখার্জিকে থানায় খাবার দিতে গেলে রূপক সাহা নামে একজনকে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং অকথ্য নির্যাতন করে। সত্যজিতের পক্ষ অবলম্বন করায় জেলা আওয়ামী লীগের সমাজকল্যাণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে ৬টি মামলা দিয়ে তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। জেলা ছাত্রলীগের নীতিশ সাহা, মোখলেসুর রহমান, বিটিভি’র ফরিদপুর প্রতিনিধি বিপুল খান, ইয়াসিন কলেজের ছাত্রলীগ সভাপতি মামুন খান, ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আলিম হায়দার তুহিন, অপু সাহা কেউই রক্ষা পায়নি।
অভিযোগ রয়েছে, প্রথম আলোর ফরিদপুর প্রতিনিধি পান্না বালাকে প্রকাশ্য দিবালোকে সিসি ক্যামেরার সামনে পিটিয়ে আধমরা করলেও পুলিশ অপরাধীদের ধরতে পারেনি। সত্যজিত ধরা পড়ে নাই, কিন্তু তার বন্ধু মোকাররম হোসেন বাবু-কে পুলিশ অনেক নির্যাতন করেছে। অথচ এই দু’জন মন্ত্রীকে এপর্যন্ত আসতে সাহায্য করেছেন। তাকে এমপি করতে জীবন উতসর্গ করেছেন। এ দু’জন শুনেছি ফরিপুরের আওয়ামীপন্থীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। অথচ মন্ত্রীর আক্রোশে এখন রাতারাতি এরা ক্রিমিনালে পরিণত হয়েছে, অর্থাৎ মন্ত্রীর সাথে থাকলে সাধু আর না থাকলে ক্রিমিনাল!
গত ৭ আগস্ট বিভিন্ন মিডিয়ার খবর থেকে জানা যায়, ফরিদপুরের বিভিন্ন হিন্দু সংগঠন ও নেতৃবৃন্দের একটি বিবৃতি এসেছে। এতে মূলত বলা হয়েছে, মন্ত্রীর চরিত্র দুধে ধোয়া তুলসি পাতার মত। মন্ত্রী যে এদের জোর করে বিবৃতি দিয়েছেন বা সভা করিয়েছেন তা যে কেউ বুঝতে পারবেন। এর আগে ১৪জুন একটি মেসেজ বিভিন্ন মিডিয়ায় এসেছিলো, সেটি হচ্ছে- ফরিদপুরের শ্রীঅঙ্গণ এর সাধু, রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজবৃন্দ, ইস্কন মন্দিরের সাধুদের এবং ফরিদপুরের হিন্দু নেতৃবৃন্দকে ডেকে ১৩ই জুন ২০১৫ রাতে মন্ত্রীর ফরিদপুরের বাসভবনে ধমক দিয়ে ‘দয়াময়ী আশ্রম’ নিয়ে সারা পৃথিবীর হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ সহ হিন্দু নেতৃবৃন্দ কর্তৃক দেওয়া বিবৃতি তারা করিয়েছে বলে মন্ত্রী তাদের মা-বাবা তুলে গালিগালাজ করেন। এই ধরনের কোন ঘটনা ফরিদপুরে ঘটে নাই এই মর্মে বিবৃতি দেওয়ার জন্য চাপ দেন।
যাই হোক মিডিয়ায় এসব কাহিনি আংশিক হলেও চলে আসে। ফলে মোশাররফ সাহেব যেভাবে চেয়েছিলেন তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে বাড়িটি তিনি ঠিকই দখল করে নিয়েছেন। ৭০ কোটি টাকার সম্পদ মাত্র দুই কোটিতে নাকি নিয়েছেন! মিডিয়ায় না আসলে হয়ত বিনামূল্যেই সম্পত্তি পেয়ে যেতেন। আচ্ছা মন্ত্রী মহোদয় আপনি যে ২কোটি টাকা কিভাবে কোন মাধ্যমে অরুণবাবুকে দিয়েছেন তা খুব জানতে ইচ্ছে করে। বছরে আপনি কত টাকা আয়কর প্রদান করেন তা খুব জানতে ইচ্ছে করছে।
এবার আবারো অরুণবাবুর কাহিনিতে আসা যাক, ৭০ বছরের অরুণবাবু মন্ত্রীর জমি রেজিষ্ট্রি না হওয়া পর্যন্ত সেই বাড়িতেই নাকি আটকে ছিলেন। জুলাইয়ে জমি রেজিষ্ট্রি সম্পন্ন হবার পর তাকে ভারত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই প্রতিনিয়ত রাম-রাবন দ্বারা অংসখ্য অরুণবাবুরা এদেশে ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, হচ্ছেন। এদেশে কিভাবে একজন হিন্দু তার সম্পত্তি হারায় এবং দেশত্যাগে বাধ্য হয় তার চমৎকার উদাহরণ হয়ে থাকবেন।
তবুও বলি অরুণভাবে অনেক ভাগ্যবান যে, নিজের পূর্বপুরুষের জমি-জমা খোয়ালেও বেঘোরে প্রাণটি হারাতে হয়নি কিংবা গুম হতে হয়নি। শুনেছি অরুণবাবু এখন নিরাপদ আছেন। অরুণবাবু আপনি বারো থাকুন। আর কখনোও ভুল করেও আমাদের কখনো ক্ষমা করবেন না।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য