প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ড. শামীম আহমেদ | ০৭ মার্চ, ২০২১
প্রতিবছর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে লিখি। ভাষণের গুরুত্ব, এর ব্যাপ্তি, ৭ মার্চের ভাষণই যে মূলত আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণার সূত্রপাত, সে বিষয়ে লিখি। এবার একটু ভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখতে চাই। স্বাধীনতা লাভের ৫০তম বছরে এসে বাংলাদেশ বিশ্বের অনুন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হয়েছে। এটা একটা অসামান্য অর্জন, অবিশ্বাস্য অগ্রগতি।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে এতদিন বাংলাদেশ অনুন্নত দেশ হিসেবে জাতিসংঘের তালিকাভুক্ত ছিল। যদিও আমরা বলছি আমাদের উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে প্রায় ৫০ বছর লেগেছে, আসলে বিষয়টি তা নয়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল এই ২১ বছর এবং ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এই ৭ বছর, মোট ২৮ বছর বাংলাদেশ জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া, এবং সেনাশাসনের কালো যুগে নিমজ্জিত ছিল। এই ২৮ বছরে উন্নতি সাধন করা তো দূরে থাক, বাংলাদেশ যে পরাধীনতা থেকে মুক্ত ছিল- এটাই বরং আমাদের ভাগ্য বলতে হবে। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন ২৮ বছরকে যদি আমরা হিসাব থেকে বাদ দিই, তবে বলা যায় মূলত স্বাধীনতা লাভের ২২ বছরের মধ্যে আমরা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছি।
বাংলাদেশকে পরাধীন রাষ্ট্র থেকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন করতে বঙ্গবন্ধু এই আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেন মূলত ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যে দিয়ে। বঙ্গবন্ধু সেদিনের সেই আগুন ঝরা বক্তব্যে বলেছিলেন, “আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়। নির্বাচনে আপনারা সম্পূর্ণভাবে আমাকে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে।” বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক কোন ক্ষমতার মসনদে বসবার অভিপ্রায় থেকে ছিল না, ছিল বাংলাদেশের মানুষের অধিকার রক্ষার ডাক, তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য জীবন বাজি রাখবার শপথ।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশ গড়বার পর দীর্ঘদিন আমরা কালো ও অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি সময় পার করলেও ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে দ্রুত কাজ করতে থাকেন এবং তার আপোষহীন নেতৃত্বের ফসল হিসেবে আমরা আজ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছি। বঙ্গবন্ধু কন্যা তার পরবর্তী পদক্ষেপও ঠিক করে রেখেছেন। তিনি চান ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এবং আমরা জানি শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জন্য যা ভালো, তাই চান, এবং সেই লক্ষ্যে তিনি বরাবরই অবিচল থাকেন।
তবে অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়শীল দেশে পরিণত হবার এই যাত্রাটা খুব সহজ ছিল না। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে তিনটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য পর পর দুইবার অর্জন করতে হয়েছে আমাদের। এটিই জাতিসংঘের শর্ত যে একটি রাষ্ট্র যদি অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসতে চায় তবে তাদের ৩ বছরের ব্যবধানে দুইবার ৩টি ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য লক্ষ্যগুলো ছিল, ১) মাথাপিছু আয় ন্যূনতম ১২৩০ ডলার হতে হবে, ২) মানবসম্পদ সূচক অন্ততপক্ষে ৬৬ পয়েন্ট বা তার বেশি হতে হবে, এবং ৩) অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচক ৩২ পয়েন্টের নিচে থাকতে হবে।
বাংলাদেশ প্রথমবার ২০১৮ সালে এবং দ্বিতীয়বার ২০২১ সালে তার ৩টি লক্ষ্যমাত্রাই পূরণ করেছে। ২০২১ সালে দ্বিতীয়বারের মতো জাতিসংঘের যাচাইয়ে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় নির্ধারিত হয়েছে ১৮২৭ ডলার (লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২৩০ ডলার), মানবসম্পদ সূচক দাঁড়িয়েছে ৭৫.৩ পয়েন্ট (লক্ষ্যমাত্রা ছিল ন্যূনতম ৬৬ পয়েন্ট), এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচক দাঁড়িয়েছে ২৫.২ পয়েন্টে (লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩২ পয়েন্টের নিচে)।
সুতরাং পর পর ২ বার তিনটি লক্ষ্যমাত্রাই পূরণ করায় জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ ঘোষণার চূড়ান্ত সুপারিশ দেয়। সেপ্টেম্বর ২০২১ এ চূড়ান্তভাবে এ ঘোষণাটি দেয়া হবে যা স্বাধীনতার ৫০ তম বছরে আমাদের এক অনন্য অর্জন, এক অবিশ্বাস্য বিজয়, যা কিনা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উল্লিখিত লক্ষ্যগুলোর বাস্তবায়নের ফসল।
আমি মনে করি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এই অর্জন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হওয়া দরকার। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এ নিয়ে তেমন কোন লেখালেখি চোখে পড়ছে না সুশীল সমাজে। আমার কাছে মনে হয় নানা সময়ে জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া ও সেনাবাহিনীর ২৮ বছরের দুঃশাসনের ফলশ্রুতিতে আমরা পরনিন্দা, পরচর্চা, সমালোচনা ও ছিদ্রান্বেষণের এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে গেছি যে এখন নিজের দেশের সাফল্যেও আমরা উদ্বেলিত হতে পারি না। আমরা অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে হয়ত পরিণত হয়েছি, কিন্তু আমাদের মরে যাওয়া আত্মার পুনরুত্থান কীভাবে ঘটবে তা কেবল মহান আল্লাহতাআলাই ভালো বলতে পারবেন।
পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে, দুর্নীতি হয়। কিন্তু আমাদের মধ্যে মন্দের প্রতি যে মোহ, ভালোর প্রতি ততটাই অন্ধত্বের প্রভাব দেখতে পাই। তাই আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম হয়ত শেষ হয়েছে, কিন্তু জাতি হিসেবে আত্মোন্নয়নের, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সংগ্রামটা বোধহয় আরও বেশ কিছুদিন ধরে চালিয়ে যেতে হবে। সেই সংগ্রামেও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের উজ্জীবিত করবে, সাহস জোগাবে ঠিক এইভাবে: “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য