প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ইনাম আহমদ চৌধুরী | ১৩ মার্চ, ২০২১
তোমাকে বিদায় জানাতে চাচ্ছি না, বন্ধু। তুমি পার্থিব জগৎ থেকে মহাপ্রস্থান করেছ সত্যি; কিন্তু অনেকেরই মনে, অনেকেরই অনুভূতিতে তুমি বিরাজমান রয়েছ। আমিও তাদের একজন। সেই অর্থে আমাদের কাছে তোমার মৃত্যু লোকান্তরগমন নয়। আমাদের চিন্তায়, ভাবনায়, অনুভূতিতে তুমি চিরজীবী।
এই ধরার ধূলিতে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল একই বছর। ১৯৩৭ সালে। আমি দেখেছি, কেউ কেউ তওফিক (হোসেন তওফিক ইমাম- এইচ টি ইমাম)-এর জন্মবছর ১৯৩৯, আর কেউ কেউ ১৯৩৫ বলে উল্লেখ করেছেন। তার জন্ম হয়েছিল ১৫ জানুয়ারি, ১৯৩৭ সালে- বাংলার টাঙ্গাইলে। আর আমার হয়েছিল, ২৯ জুন ১৯৩৭ সালে তদানীন্তন আসাম প্রদেশের সিলেট জেলার হবিগঞ্জে। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন অবসানের প্রাক্কালে ঔপনিবেশিক পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতার বছর ১৯৪৭ সালে হোসেন তওফিক ইমাম (এইচ টি ইমাম) ছিল বঙ্গদেশের রাজধানী কলকাতাতে স্কুলে শিক্ষারত, আর আমি ছিলাম আসামের তদানীন্তন রাজধানী শিলংয়ে। ব্রিটিশ ভারতের দুই প্রদেশে। একটি অভাবিত ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনে কালের গতিচক্রে আমাদের পথ এসে মিলিত হলো শিক্ষার্থীকালেই, আর তার পরে সে সহযাত্রা শুরু হলো জীবনের বন্ধুর পথে, তা হয়ে দাঁড়াল প্রীতিময় সখ্যের বন্ধনে চিরআবদ্ধ।
১৯৫২ সালে আমরা ম্যাট্রিক পাস করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দু'জনই ছিলাম অর্থনীতির ছাত্র। ছাত্রজীবনে দু'জনই সাধারণভাবে বামঘেঁষা। অসাম্প্রদায়িক নির্দলীয় রাজনীতি করেছি। অবশ্য আমাদের ছাত্র-রাজনীতিতে কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা ছিল না। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে উভয়েরই উৎসাহ ছিল। আমি হয়েছিলাম সংস্কৃতি-সংসদের প্রেসিডেন্ট। এমএ পাস করে তওফিক সরকারি কলেজে (রাজশাহী) লেকচারার পদে যোগদান করে। আমি এমএ এবং এলএলবি পাস করে ১৯৬০ সালে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে (সিএসপি) যোগদান করি। আর তওফিক যোগ দেয় ১৯৬১ সালে, একই সার্ভিসে। লাহোর একাডেমি এবং অন্যত্র আমাদের একই ধরনের ট্রেনিং। বিলেতে সে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে এবং আমি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর অধ্যয়ন করি। পেশাগত প্রশাসনিক জীবনে একই ধরনের অভিজ্ঞতার সূচনা। ঘটনাক্রমে চাকরির শুরুতেই আমার সিরাজগঞ্জে প্রশাসক হিসেবে পদায়ন, আর ওখানেই তার বাড়ি। কখনও কখনও গতিপথ বিভিন্নমুখী হয়। আমাদের হতে হয় বিভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি। ভিন্ন কোনো অবস্থাতেই, তা অনুকূলই হোক বা প্রতিকূল, আমাদের গভীর বন্ধুত্বে কখনও চিড় ধরেনি। পরে একসময় ঘনিষ্ঠ বৈবাহিক আত্মীয়তার সম্পর্কও স্থাপিত হয়। বাস্তবিক পক্ষে চ্যালেঞ্জের যখন সম্মুখীন হয়েছি, ব্যক্তিগত সম্পর্ক তখন দৃঢ়তরই হয়েছে, পারস্পরিক আন্তরিক শুভেচ্ছা হয়েছে উষ্ণতর।
তওফিকের অনেক গুণের মধ্যে একটি বিশেষ দ্রষ্টব্য ছিল পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে নিরীক্ষণ করে কোনো বিষয় বা সমস্যা বিবেচনা-উত্তর যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। কোনো বিষয়ে মতামত দিতে হলে বিষয়টি সম্পর্কে সে যথাসম্ভব ওয়াকিবহাল হয়েই তা স্থির করত। কোনো সমস্যার গভীরে গিয়ে আদ্যোপান্ত বিশ্নেষণ করে পূর্বাপর ভেবেচিন্তে সে পরবর্তী পদক্ষেপ নিত। তাতে যে শুধু তার দক্ষ কর্মক্ষমতার প্রকাশ হতো তা নয়- এই গুণ তাকে আস্থা-সৃষ্টিকারী নির্ভরযোগ্য বিশ্বাসভাজন করে তুলত। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে কেবিনেট সেক্রেটারি হয়ে সে সম্পূর্ণ মুজিবনগর সরকারকালীন এবং পরবর্তী সময়ে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন পুরো সময়টিতেই পেশাদারি নৈপুণ্য দেখিয়ে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে কেবিনেট সেক্রেটারির গুরুদায়িত্ব সুচারুরূপে সম্পাদন করেছিল।
যে কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কেবিনেট সেক্রেটারি বা এ জাতীয় দায়িত্ব সম্পাদনকারী কর্মকর্তা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্ম সম্পাদন করেন। ব্রিটিশ-প্রশাসন ব্যবস্থার প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকারী পাক-ভারত-বাংলা উপমহাদেশে অন্যতম জ্যেষ্ঠ, দায়িত্বশীল ও প্রশ্নাতীতভাবে দক্ষ কর্মকর্তাকে ওই পদে সমাসীন করা হয়। পুরো সরকারের কর্মক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই এই আমলার কর্মতৎপরতা ও নৈপুণ্যের ওপর নির্ভরশীল। তওফিক কেবিনেট সচিব থাকাকালীন তার চেয়ে বহু সিনিয়র ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা-সিএসপি অফিসারও সরকারে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু তওফিকের কর্মনৈপুণ্য, অমায়িক ব্যবহার, প্রচার-বিমুখতা, ঔদ্ধত্বহীন বিনয়ী মনোভাব এবং সহায়তা-সহযোগিতা প্রদানে সদাপ্রস্তুতি তাকে সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল। তওফিক ইমামের আরেকটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল- যখন যে ভূমিকা বা যে কর্তব্য তাকে সম্পাদন করতে হতো, অত্যন্ত গুরুত্ব ও নিবিড় পরিচর্যা দিয়ে তা সে পালন করত। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তা দেখেছি। প্রশাসনের দায়িত্ব পালনে সে পুরোপুরি একজন কর্মতৎপর যথাযোগ্য ব্যুরোক্র্যাট ছিল। মুক্তিযুদ্ধে সে মন-প্রাণ দিয়ে অংশগ্রহণ করে। আক্রমণাত্মক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামে সে সমন্বিত গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। আগরতলায় অবস্থান করে সে একজন সফল জোনাল প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করে।
প্রধানমন্ত্রী (শহীদ) তাজউদ্দীন আহমদ তাকে সম্ভবত '৭১-এর জুন মাসে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদে নিয়োগ দেন। ঢাকাতে বঙ্গবন্ধুর প্রথম সরকার গঠনের পর তওফিক কেবিনেট সচিব হিসেবে অব্যাহতভাবে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করে। পর্বতসমান প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এই ভূমিকায় তওফিকের কৃতিত্ব সর্বজনবিদিত। বঙ্গবন্ধুর এই নৈকট্য ও আস্থাভাজন হওয়ার খেসারত তাকে দিতে হয় অনেক দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে। আগস্ট ১৯৭৫ সালে জাতির জীবনে কলঙ্কতম অধ্যায়ের পরবর্তী সময়ে প্রায় দেড় বছর তাকে কারারুদ্ধ থাকতে হয়। তার বিরুদ্ধে বহু অলীক কল্পনাজাত মামলার অভিযোগ মিথ্যা ও অসার প্রতিপন্ন করে বেকসুর খালাস পেয়ে তাকে পরবর্তী দায়িত্বপ্রাপ্তিতে অনেক প্রতিকূলতা ও ষড়যন্ত্র সামলাতে হয়। সেসব দায়িত্ব সম্পাদনেও সে অশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছে। লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সে শুধু প্রজেক্ট ডিরেক্টরই ছিল না, যথার্থভাবে তার নিজেরই ভাষায়- ্তুচঅঞঈ্থ- 'এই প্রকল্পের উদ্ভাবক আমি, প্রকল্প প্রণয়নকারী আমি এবং সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন ও উদ্বোধন আমার দ্বারাই। এটি আমার গর্বের বিষয়।' পরবর্তী সময়ে সড়ক ও সড়ক-যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং পরিকল্পনা সচিব ও কমিশনের সদস্য হিসেবে সে তার দক্ষতার পরিচয় দেয়। শেষোক্ত পদ থেকে সে অকালেই অবসর গ্রহণ করে সরকারি চাকরি থেকে বিদায় নেয়। ঘটনাক্রমে আমাকেই সে চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে যায়। তখন সে দায়িত্ব পালনকালে আমি দেখেছি, কী সুচারুরূপে সে তার কর্তব্যকর্ম সুবিন্যস্ত করে রেখেছিল।
পরে সে যখন রাজনীতিতে যোগদান করল, অতুলনীয় দক্ষতার সঙ্গে সে আরোপিত দায়িত্ব পালন করে স্বীয় মেধা ও দক্ষতার জন্যই প্রধানমন্ত্রী বঙ্গদুহিতা জননেত্রী শেখ হাসিনার পরম আস্থাভাজন হয়ে দাঁড়াল। অর্পিত দায়িত্ব যথাযোগ্য এবং ফলপ্রসূ করে পালনে তার ভূমিকা অদ্বিতীয় বললেও অত্যুক্তি হবে না।
তওফিক ইমাম একজন প্রাবন্ধিক এবং সুলেখকও ছিল। তার রচিত 'বাংলাদেশ সরকার-১৯৭১' মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি অত্যন্ত 'অবজেকটিভ' বস্তুনির্ভর দালিলিক প্রামাণ্য গ্রন্থ। মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং প্রারম্ভিক দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকালীন সময়ে রাষ্ট্রীয় এবং জাতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে সে তাতে অংশগ্রহণ করেছে। আবার সিভিল সার্ভিস থেকে অবসর গ্রহণ করার দুই দশকাধিক পরেও বঙ্গদুহিতা জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার সফল প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করেছে প্রথমে প্রশাসনিক উপদেষ্টা এবং পরে রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে। যে কোনো জীবনের জন্যই এটি একটি ব্যতিক্রমী ও বিরাট অর্জন।
ব্যক্তিগত জীবনেও একজন সহৃদয় আন্তরিক বন্ধুবৎসল স্বজন হওয়া ছাড়াও সে ছিল একজন আদর্শ পরিবারপ্রধান। জান্নাতবাসিনী স্ত্রী ইসমাতকে স্মরণ করে প্রত্যেক বছরই তার মৃত্যু দিবসে তার কাছে দীর্ঘ খোলা চিঠি পাঠাত। একমাত্র পুত্র তানভীর (জামিল) একজন তরুণ সাংসদ, আর তিন মেয়ে- মুনমুন, মিতু আর মুক্তি তার নয়নের মণি। তওফিকের নিজের কথায়ই- 'তার ও শহীদ কর্নেল এসএ হাই-এর নাতনি প্রিয়াঙ্কাকে আমেরিকার স্কুলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচনা লিখতে সহায়তা করতে গিয়েই রচিত হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের ওপর তার প্রামাণ্য গ্রন্থ বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১।'
ইহলোকে আজ তওফিক নেই বটে, তবে বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এইচ টি ইমাম আমাদের কাছে আজীবন অবিস্মরণীয়ই থাকবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য