আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বাক স্বাধীনতা ও প্রথম আলোর উপর আঘাত

ইমতিয়াজ মাহমুদ  

প্রথম আলোর উপর একটা আঘাত এসেছে। আমাদের পুলক ঘটক সহ কয়েকজন ফেসবুকে লিখেছেন, আমাদের সওগাত আলী সাগর ওর অনলাইন কাগজে লিখেছেন,  আরও কয়েকটা সূত্রে জেনেছি যে সরকারের একটা সংস্থা চাপ দিয়ে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান আর দেশীয় বড় প্রতিষ্ঠানগুলির বিজ্ঞাপন প্রথম আলো থেকে প্রত্যাহার করিয়ে নিচ্ছে।

সকালে প্রথম আলো আর ডেইলি স্টার আসে আমার বাসায়, তখন লক্ষ্য করিনি, সন্ধ্যায় বাসায় এসে দেখলাম- গ্রামীণফোন, বাংলালিঙ্ক, লিভার ব্রাদারস, নেসলে এদের কোন বিজ্ঞাপন নাই শনিবারের (২২ আগস্ট) প্রথম আলোতে। ওরা কি তবে প্রথম আলো বন্ধ করে দিতে চাইছে?

সেই পুরনো কথা বলতে হচ্ছে আবার। কণ্ঠরোধ করা অন্যায়। সে যার কণ্ঠই হোক। মানুষের মতপ্রকাশে বাধা দেওয়া অন্যায়। কারো মতামত আমার পছন্দ নাও হতে পারে। এবং এখানে বলতেই হয় প্রথম আলোর অনেক কিছুই আমাদের অনেকেরই পছন্দ না। প্রথম আলোর আর এর সম্পাদক মতিউর রহমানকে ব্যঙ্গ করে মতিকন্ঠে যে সব নকশা পোস্ট করা হতো সেগুলি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। প্রথম আলোর অবস্থানে বিরক্ত হয়ে মুহম্মদ জাফর ইকবাল সেখানে লেখা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন রীতিমত ঘোষণা দিয়ে। প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতি যেটা কাগজ পড়ে দৃশ্যমান হয় সেটা আমার পছন্দ না। বুঝাই যাচ্ছে সরকারের বা সরকারের পৃষ্ঠপোষকদেরও প্রথম আলো পছন্দ হচ্ছে না। সুতরাং প্রথম আলো বন্ধ করে দিতে হবে। এটা অন্যায়।

দেখেন, একই কথা বারবার বলতে হচ্ছে, কেননা একই রকম পরিস্থিতি বারবার তৈরি হচ্ছে। এই যে একই রকম পরিস্থিতি বারবার তৈরি হচ্ছে, সরকার ইচ্ছামত মানুষের কণ্ঠরোধ করে দিচ্ছে, ভিন্নমতের জন্যে মানুষকে অত্যাচার করছে এইসব করে সরকার পার পেয়ে যাচ্ছে কিভাবে সেটা কি ভেবেছেন?

আমার বিনীত মতামত যদি শুনতে চান তাহলে বলি, আপনাদের নিজেদের ভিতর বসবাস করছে একেকটা কুট্টি ফ্যাসিস্ট। আপনারা যারা রাজনীতি করেন, সংবাদপত্রে কাজ করেন বা এক্টিভিজম করেন আপনাদের কথা বলছি। আপনারা মুখে স্বাধীনতার কথা বলেন ঠিকই, লিবার্টির কথা বলেন ঠিকই, বাক ও চিন্তার স্বাধীনতার কথা বলেন ঠিকই কিন্তু সেটা বলেন কেবল আপনার নিজের জন্যে অথবা আপনার বন্ধুর জন্যে। আপনার প্রতিপক্ষের গলা যখন কেউ চেপে ধরে তখন আপনারা মনে মনে খুশী হয়ে যান। সকলেই মনে মনে একেক জন ফ্যাসিস্ট!

এমনিতে মুখে মুখে সবাই একেক জন গণতন্ত্র লিবার্টি ইত্যাদি নিয়ে খই ফোটান। দৈনিক আমার দেশ যখন সরকার কায়দা করে বন্ধ করে দিয়েছিল তখন আপনি প্রতিবাদ করেছিলেন? আমার দেশ মন্দ পত্রিকা। ওরা মিথ্যাচার করেছে। মিথ্যাচারের জন্য ওর সম্পাদক প্রতিবেদকের জেল জরিমানা হবে, হোক। কিন্তু যে কায়দায় কাগজটার ছাপা বন্ধ করেছে সরকার সেটা কি ঠিক ছিল? যে কয়জন আমার দেশের পক্ষে মিনমিন করে একটু প্রতিবাদ করেছে ওদেরকে উল্টা গালাগালি করেছেন। সরকারের একটা অন্যায় যখন আপনি সমর্থন করবেন তখন সে আরেকটা অন্যায় করবে, তারপর আরেকটা করবে। এইভাবে একদিন আপনার ঘাড়ের উপর এসে কোপটা পড়বে। এখন প্রথম আলোর উপর পড়েছে আঘাত।

তসলিমাকে দেশ থেকে বের করে দিল। দেশে থাকলে ওর জীবন সংশয়পূর্ণ হয়। মুক্তকণ্ঠে প্রতিবাদ করেছিলেন কয়জন? নাস্তিক ব্লগারেরা দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে বিদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আপনারা প্রতিবাদ করেছেন? চার জন ব্লগারদেরকে যখন মামলা দিয়ে হয়রানি করা হলো,  কয়জন প্রতিবাদ করেছিলেন? আর যারা প্রতিবাদ করেছিলেন তারাও মিনমিন করে বলতে চেয়েছেন যে, না, ওরা তো আসলে সে রকম নাস্তিক না ধর্মকে আঘাত করে না ইত্যাদি। স্পষ্ট করে বলতে পারেন নাই যে- ধর্মের বিরুদ্ধে লেখার অধিকারও সকলের আছে।

এরকমই হতে থাকবে। আপনি আমি যতদিন না মুক্তকণ্ঠে বলতে পারবো যে কারো কণ্ঠই রোধ করা যাবে না ততদিন পর্যন্ত এরকমই চলতে থাকবে। একজনের কণ্ঠরুদ্ধ হলে আপনি আনন্দিত হবেন আর আপনার কণ্ঠরুদ্ধ হলে আমি আনন্দিত হব!

এ কথা আপনিও পড়েছেন, আপনিও হয়তো বলেন। কিন্তু অনেকেই সর্বান্তকরণে মানেন না। লিবার্টি জিনিসটাকে শর্তযুক্ত করা যায় না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একটা পরম স্বাধীনতা। ইংরেজিতে বলে-  এবসোল্যুট ফ্রিডম? মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হচ্ছে সেরকম একটা এবসোল্যুট ফ্রিডম। একটা কন্টেন্ট- নিউট্রাল ব্যাপার। মানে হচ্ছে আমার মতপ্রকাশ করা যাবে কি যাবেনা সেটা নির্ধারণের জন্য আমার মতের কন্টেন্ট বিবেচনার কোন সুযোগ নাই। আমার মত যাই হোক না কেন, যত পাগলামিই মনে হোক সকলের কাছে, সেটা প্রকাশে বাধা দেওয়ার অধিকার কারো নাই।

যারা বলতে চান যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নাকি সাবজেক্ট টু মোরালিটি ইত্যাদি, ঐসব কথাবার্তা হচ্ছে বলদের গোবরমার্কা কথা। আপনাদের সকলের মোরালিটির বিরুদ্ধে বৃদ্ধাঙুলি প্রদর্শনের স্বাধীনতা যদি আমার না থাকে তাহলে এই দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নাই।

কথাটা রোজা লুক্সেমবার্গ বলেছিলেন রাশিয়ার বিপ্লবের সময়-  শুধুমাত্র সরকারের সমর্থকদের জন্য স্বাধীনতা, শুধু একটা দলের সদস্যদের জন্য-  ওদের সংখ্যা যত বড়ই হোক না কেন  সেই স্বাধীনতা কোন স্বাধীনতাই না। স্বাধীনতা সবসময়ই আর একান্তভাবেই কেবল তার জন্যেই দরকার যে ভিন্ন চিন্তা করে।

এই যে ভিন্নমতের জন্যে স্বাধীনতা এটাকে বলে শুদ্ধ 'ন্যায়' নামক তত্বের জন্য না। বরং রাজনৈতিক স্বাধীনতার যা কিছু সারবস্তু আছে সব কিছুই নির্ভর করে এই শর্তের উপর। এবং যখন স্বাধীনতার এই বৈশিষ্ট্য থাকে না সেখানে স্বাধীন তা হয়ে যায় একটা প্রিভিলেজ মাত্র।

চিন্তা করে দেখেন- যারা প্রচলিত মত প্রচলিত বিশ্বাস, প্রচলিত প্রথার পক্ষে কথা বলে বা প্রচলিত সীমারেখা মেনে কথা বলে তার তো স্বাধীনতার দরকার নাই। সে তো মেজরিটির পক্ষেই আছে,  তাকে তো কেউ বাধা দিচ্ছেনা। স্বাধীনতা দরকার সেই ব্যক্তির যে প্রচলিত বিশ্বাসকে আঘাত করে। আর প্রচলিত বিশ্বাসকে যে আঘাত করে তাকে যদি রক্ষা করতে না পারেন তাহলে সেই সমাজে আর বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা থাকলো না। রাষ্ট্র তখন হয়ে যায় মানুষের চেতনার রুচির ও চিন্তার পুলিশ। সমাজে যখন সেই পরিস্থিতি হয়,  তখন প্রথম আলো জাতীয় জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান ও সেই রকম রাষ্ট্রীয় পুলিশি আচরণের শিকার হবে।

এতো লম্বা লম্বা কথা আপনাদেরকে শুনিয়ে কি লাভ। আপনারাও তো মনে মনে একেক জন কুট্টিহিটলার। আপনারা নিজেরা নিজেরা মনে মনে মরাল স্ট্যান্ডার্ড সেট করেছেন। এর বাইরে কেউ কিছু বললেই বলবেন,  বাক স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছা তাই বলার স্বাধীনতা না। এই ভুল থেকে বেরিয়ে আসুন-  বাক স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছা তাই বলার স্বাধীনতা। এই কথাটা যদি এখনই বুঝে নিতে না পারেন,  আগামীকাল না হলেও পরশুদিন আপনার গলাও কেউ না কেউ চেপে ধরবে।

ইমতিয়াজ মাহমুদ, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ