আজ শনিবার, ১১ মে, ২০২৪

Advertise

অতিমারি’তে রবীন্দ্রনাথ

হাসান মোরশেদ  

১৮৯৬ সালে বোম্বেতে শুরু হওয়া প্লেগ অতিমারি, রাজধানী শহর কলকাতায় এসে হানা দিলো দু’ বছর পর। ১৭ এপ্রিল ১৮৯৮ বাংলায় প্রথম প্লেগে মৃত্যু রেকর্ড হয়। ৩০ এপ্রিল প্রশাসন জানায়- প্লেগ মহামারির আকার ধারণ করেছে। পরের এক সপ্তাহের মধ্যে কলকাতা শ্মশানের রূপ ধারণ করতে থাকে।

অতি সংক্রমণের পাশাপাশি টিকাদানের বিরুদ্ধাচরণ আর ধর্মীয় গুজব পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তোলে।

ততদিনে টিকা আবিষ্কার হয়ে গেছে। পেটের কাছ থেকে মাংস তুলে নিয়ে সেখানে টিকা দেয়া হতো। রটে গেলো- মাংস তুলে সেখানে প্লেগের জীবাণু ঢুকিয়ে দিচ্ছে ব্রিটিশেরা। টিকা দেয়ার নাম করে ঘরে ঘরে ঢুকে অন্তঃপুরবাসিনী হিন্দু ও পর্দানশীন মুসলমান নারীদের ধর্মনাশের চক্রান্ত। ব্রিটিশ প্রশাসন জোর করে প্লেগ আক্রান্তদের আইসোলেশনে পাঠানো শুরু করলে হাজার হাজার মানুষ কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকলো, ফলের সংক্রমণও বাড়তে থাকলো হুহু করে।

বোম্বের অতিমারিতে মানুষের পাশে ভরসা  হয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন অভিজাত পার্সি নারী ভিকাজি রুস্তম কামা। কলকাতায় মানুষের পাশে দাঁড়ালেন আইরিশ নারী মার্গারেট এলিজাবেথ।

মাত্র তিনমাস আগে তিনি কলকাতায় এসেছেন স্বামী বিবেকানন্দের স্থায়ী শিষ্যত্ব গ্রহণে। বিবেকানন্দ তার নাম দিয়েছেন ভগিনী নিবেদিতা। রামকৃষ্ণ মিশন মাত্র গঠিত হয়েছে। মিশনের সদস্যদের নিয়ে নিবেদিতা নেমে এলেন কলকাতার অলিতে গলিতে। শুরু করলেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান, আন্তরিক ভাবে মানুষকে পরিস্থিতি বুঝানো, অসুস্থদের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। নিবেদিতা ব্রিগেডের সাথে কাজ করতে থাকলেন তখনকার বিখ্যাত বাঙ্গালী ডাক্তার  রাধাগোবিন্দ কর, যার বাবা দূর্গাদাস কর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঢাকা মিডফোর্ড হসপিটাল।

বোম্বেতে যেমন পার্সি সম্প্রদায় এগিয়ে এসেছিলেন সবার সহযোগিতায়, কলকাতায় এগিয়ে এলেন ব্রাহ্মরা। ব্রাহ্মরা তখন কলকাতার সবচেয়ে প্রগতিশীল গোষ্ঠী। তারা সবাই মিলে টিকা নিলেন অন্যদের উৎসাহিত করার জন্য। শুধু টিকা নিলেন- তাইনা, ব্রাহ্মদের সবচেয়ে উজ্জ্বল পরিবারটি এগিয়ে এলো নিবেদিতা সাহায্যে। ‘Calcutta Notes’ এ নিবেদিতা লিখেছেন, “A few great Hindu families, notably the Tagores, stood firm, in the hope of allaying the agitation.”

ঠাকুরবাড়ির উজ্জ্বলতম পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভগিনী নিবেদিতার সাথে ত্রাণকার্য্য অংশ নিলেন, পাড়ায় পাড়ায় ঘুরলেন, আর্তের পাশে দাঁড়ালেন। এদের দুজনের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সে সময়ে আরেক উজ্জ্বল মানুষ জগদীশ চন্দ্র বসু। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু ও তাঁর স্ত্রী অবলা বসু হয়ে উঠেছিলেন নিবেদিতার ব্যক্তিগত বন্ধু। আর রবীন্দ্রনাথ? সে আলাপ পরে আসুক।

বিখ্যাত ইংরেজ বামপন্থী দার্শনিক ই, পি, টমসনের পিতা এডওয়ার্ড টমসন জানিয়েছেন: ‘That year [1998] plague broke out in Calcutta; she [Sister Nivedita] organized relief work, assisted by Tagore’

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ গ্রন্থে লিখেছেন, “সেই সময়ে কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারদিকে মহামারী চলছে, ঘরে ঘরে লোক মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা এবং আমরা এ বাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছি, চুন বিলি করছি। রবিকাকা ও সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইন্সপেকশনে যেতেন। নার্স ডাক্তার সব রাখা হয়েছিল।” জগদীশচন্দ্র বসু প্লেগের ভয়ে বাড়ি পরিবর্তন করেছিলেন। তার নির্দিষ্ট কারণ অবশ্য ছিল। ১৩৯ নম্বর ধর্মতলা স্ট্রিট থেকে তিনি সুহৃদ রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, “উপরের ঠিকানা থেকে বুঝিতে পারিয়াছেন যে, আমি পলাতক—প্লেগের অনুগ্রহে। আমার একজন ভৃত্য ছুটি লইয়া একদিন বড়বাজার গিয়াছিল। সেখান হইতে আসিয়া একদিন পরেই প্লেগ হয়। আর ৩০ ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যু। বাড়ি ছাড়িয়া আসিয়া উক্ত ঠিকানায় আছি—কতদিন পলায়ন চলিবে জানি না।”

এ কেবল জগদীশচন্দ্র বসুর ক্ষেত্রেই নয়, প্রায় সকল কলকাতাবাসীর এমন অবস্থা দেখা দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথও চিঠিতে পরিচিত সকলকে সাবধান করতেন। পাড়ায় পাড়ায় নজরদারিতে যাওয়ার সময়েও প্রত্যেককে  স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পরামর্শ দিতেন।

ঠাকুরবাড়ি যখন প্লেগ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে, সে সময়েই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নয়-দশ বছরের মেয়ে প্লেগ আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বাধ্য হয়ে তারা চৌরঙ্গীর একটা বাড়িতে পালিয়ে যান। সেখানেই তিনি বিখ্যাত ‘শাহজাহানের মৃত্যু’ ছবিটি আঁকেন। অবনীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, “মেয়ের মৃত্যুর যত বেদনা বুকে ছিল সব ঢেলে দিয়ে সেই ছবি আঁকলুম।”

প্লেগ অতিমারী মোকাবেলা করতে গিয়ে ভগিনী নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে নৈকট্য গড়ে উঠে তা পরে নানা বাঁক নেয়। সে আলাপ তোলা থাক আপাতত।

অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভগিনী নিবেদিতার সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অংশ নিলেও, এই অবরুদ্ধ অসহনীয় সময়ে তাঁর সৃষ্টিশীলতাকে তিনি থামতে দেননি মোটেও। অতিমারীর ছায়ার মধ্যেই  তিনি লিখে গেছেন গল্পগুচ্ছের অনেক গল্প, চতুরঙ্গের মতো উপন্যাস। সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ মানবিক  চরিত্র  জগমোহন।

জগমোহন আস্তিক বা নাস্তিক সে পরিচয় গৌণ। তার পরিচয় তিনি প্লেগের দুঃসময়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজের জীবনের তোয়াক্কা করেননি। এক-অর্থে, নাস্তিক জগমোহন আস্তিক নিবেদিতার কাউন্টার-পয়েন্ট। অতিমারি মোকাবেলায় বাস্তবের নিবেদিতা রাস্তায় নেমেছিলেন, উপন্যাসের জগমোহনও । নিবেদিতা বেঁচে গিয়েছিলেন, কিন্তু জগমোহন মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর বিবরণটা এই :

“যে বছর কলিকাতা শহরে প্রথম প্লেগ দেখা দিল তখন প্লেগের চেয়ে তার রাজ-তকমা-পরা চাপরাসির ভয়ে লোক ব্যস্ত হইয়াছিল। শচীশের বাপ হরিমোহন ভাবিলেন, তার প্রতিবেশী চামারগুলোকে সকলের আগে প্লেগে ধরিবে, সেই সঙ্গে তাঁরও গুষ্টি সুদ্ধ সহমরণ নিশ্চিত।

ঘর ছাড়িয়া পালাইবার পূর্বে তিনি একবার দাদাকে গিয়া বলিলেন, দাদা, কালনায় গঙ্গার ধারে বাড়ি পাইয়াছি, জগমোহন বলিলেন, বিলক্ষণ! এদের ফেলিয়া যাই কী করিয়া?
কাদের?

ঐ-যে চামারদের।“

হাসান মোরশেদ, লেখক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০৪ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৮ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ