প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আলমগীর শাহরিয়ার | ১২ মে, ২০২১
‘‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই”; সভ্যতার ইতিহাসে তুলনারহিত এ বাণী মধ্যযুগের বাংলার এক কবি বড়ু চণ্ডীদাসের। অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী ধর্মপরিচয়ে হিন্দু না মুসলমান— আমি জানতামই না। সত্যি বলতে কোনোদিন এ প্রশ্নটি আমার মন ও মগজে জাগেওনি। মুগ্ধ হয়ে দেখি এই প্রতিভাবান মানুষটির অভিনয়। আহা! কী অসামান্য, কী দুর্দান্ত, কী জীবনঘনিষ্ঠ। কি মঞ্চে, কি টিভিনাটকে, কি রুপালি পর্দায়— সর্বত্র।
নীলক্ষেত সংলগ্ন বলাকা সিনেমা হলে যখন গিয়াসউদ্দিন সেলিম পরিচালিত 'মনপুরা' সিনেমাটি মুক্তি পায় ক্যাম্পাস থেকে দলবেঁধে দেখতে গেছি আমরা। কেননা, সিনেমায় আছেন আমাদের প্রিয় একজন অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। দেখেছি পরে তাঁর অভিনীত 'টেলিভিশন', 'আয়নাবাজি', 'দেবী'র মতো চলচ্চিত্র। অসংখ্য নাটকে তাঁর অভিনয় দেখতে দেখতে ভেবেছি একটা মানুষ এত বিচিত্র চরিত্রে এত সাবলীল, এত নিখাদ, এত পূর্ণাঙ্গ ও সম্পন্ন অভিনয় কিভাবে করতে পারে! পাবনার প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে উঠে আসা এ অভিনেতাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও দেখি অন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মতো শুধু ঠমক লাগানো পোস্ট নয়, বরং মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্তের আনন্দ-বেদনার গল্পগুলো সাবলীল ভঙ্গিতে শেয়ার করেন। তাঁর অনেক ভক্ত-অনুরাগীর মত বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়ি। ভালো লাগে। মনে হয় আহা, এতো আমাদেরই চেনা গল্প। এতো গ্রাম আর মফস্বলে হারিয়ে যাওয়া আমাদের শৈশব-কৈশোরের অভিন্ন স্বপ্ন ও সংগ্রামের কথা।
এদেশে রাতারাতি কিছু তারকাখ্যাতি পাওয়া অভিনেতা, অভিনেত্রী বা সেলিব্রেটিরা সেসব ফেলে আসা দিন ভুলে যান বা মেকি একটা আলো ঝলমলে জগতের প্রাচীর তৈরি করে নিজেকে অবরুদ্ধ করে রাখেন পাষাণ-প্রাসাদে। যেন তাঁদের কোনও অতীত নেই। বর্তমানই একমাত্র সত্য। চঞ্চল দেখি এখানেও উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার মেধাবী এ শিক্ষার্থী বাদ্যযন্ত্র বাজানো থেকে শুরু করে অভিনয়, গান, ছবি আঁকা সব কিছুতেই যেন সমান পারদর্শী। তাই ছাত্রাবস্থায়ই 'আরণ্যক' নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজের জায়গা করে নেন। মেধার পরিচয় দেন।
সমাজ-সংসারে মানুষের মতো দেখতে কিছু অমানুষ আছে তাদের মনে চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয় নয়, মেধা নয়, অসামান্য প্রতিভা নয়; সে হিন্দু না মুসলমান সে প্রশ্নই আগে জাগে। ব্রিটিশদের দুইশ বছর আর পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষফল আজও আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। বিশ্ব মা-দিবসে চঞ্চল চৌধুরীর মাকে নিয়ে ফেসবুকে এক পোস্টে কতিপয় সাম্প্রদায়িক মন্তব্যে চঞ্চল চৌধুরী ব্যথিত হয়েছেন। আহত হয়েছেন। এই ব্যথা আমাদেরও ছুঁয়ে গেছে। ছুঁয়ে গেছে কেননা মানুষের সমাজ এখনও আমরা বিনির্মাণ করতে পারিনি বলে। এখনও কেবল ধর্ম আর রাজনীতির নিক্তিতে আটকা পড়ে যায় মানুষের পরিচয়। পরাধীন ভারতবর্ষে সাম্য ও সম্প্রীতির কবি নজরুল বিভক্তি ও বিদ্বেষের এই রাজনীতি দেখে মুক্তির ব্যাকুল বাসনায় সখেদে বলেছিলেন,
‘‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানেনা সন্তরণ,
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?”
ঔপনিবেশিক আমলের কূটকৌশলের রাজনীতি নয়, স্বাধীন দেশে আজও দেখি মানুষে মানুষে সম্প্রীতির বদলে বিভক্তি। একমুখী নয়, বহুধা-বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা এই সাম্প্রদায়িক সঙ্কটের অন্যতম প্রধান কারণ। মান নয়, গুণ নয়; পরসিংখ্যান আর কংক্রিট-সর্বস্ব উন্নয়নের জোয়ারে ঢেকে যাচ্ছে আমাদের মন ও মননের সকল প্রগতি ও উন্নয়ন। অবরুদ্ধ ও অবিকশিত আমাদের মানবিক ও সাংস্কৃতিক জগত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এজন্য প্রায়ই কিছু মানুষের বিষেভরা নখদন্তের আঁচড় দেখা যায়। সাইবার বুলিংয়ের অপরাধে এদের কি আইনের আওতায় আনা জরুরি নয়?
এদেশে এটিএম শামসুজ্জামান, হুমায়ুন ফরিদীর মতো শ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের সার্থক-উত্তরসুরি একজন চঞ্চল চৌধুরী। সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেটার যেমন তেমনি চঞ্চলের মতো অভিনেতাও দেশের গর্ব। দুই অঙ্গনের মানুষ হলেও এরা জাত-পাত ধর্মের ঊর্ধ্বে ওঠে দেশের মানুষকে অভিন্ন অনুভূতির সুতোয় বাঁধেন।
চঞ্চল চৌধুরী ও তাঁর মায়ের জন্য নিরঙ্কুশ ভালোবাসা। এমন রত্নাগর্ভা মায়ের জন্য অপরিমেয় শ্রদ্ধা। মাগো, তোমার ওই সিঁথির সিদুর দেখে যে মন্দ মন্তব্য করেছে সে জানে না ও তোমার বিশ্বাসী সৌন্দর্য। তোমার নির্বোধ সন্তানেরে ক্ষমা করো।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য