আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

আমাদের চেনাজানা বৃত্তের মাৎস্যন্যায়

মাসকাওয়াথ আহসান  

রোজিনা আমার চোখে বাংলাদেশের সেরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদক; ছোটবোনের মতো স্নেহ করি তাকে; শ্রদ্ধা করি তার কাজ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যে অতিরিক্ত সচিব জেবুন্নেসা রোজিনা ট্র্যাজেডির নেতৃত্বে ছিলেন; উনি সিভিল সার্ভিসের বড় বোন। সরকারি চাকরি ছেড়ে দিলেও একটা পারিবারিক বন্ধন তো রয়ে যায়। উনার ব্যাচমেট বন্ধু আমার শ্রদ্ধাভাজন সহকর্মী একসময়ের। বাংলাদেশের মতো ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটা দেশে সবাই সবার চেনা। তবু কেন এদেশে সৌদি এমবিএস-এর রাজতন্ত্রের খাশোগজি হত্যার ক্রোধ চোখে পড়ে তা বুঝতে আমার খুব কষ্ট হয়।

রোজিনার স্বামী মিঠু, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেখা একজন অত্যন্ত কার্টিয়াস মানুষ, যে অবসরে সংগীত চর্চা করে। রোজিনার বিপক্ষে তার তথ্য পাবার অধিকারকে তথ্য চুরির তকমা দিয়ে যে মেধাবী আওয়ামী লীগের পলিসিমেকার হ্যাপিইনসাইডারে রোজিনা গ্রেপ্তারের জাস্টিফিকেশানের কলাম লিখেছে; সে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমাদের প্রতিষ্ঠিত বিতর্ক ক্লাব হাউজ অফ ডিবেটরস-এর প্রতিষ্ঠাতা সহ সভাপতি; যে আমাদের ক্লাবের জন্য সংবিধান রচনা করেছিলো।

যে সাংবাদিক ছোট ভাইটি আমার সুপারভিশনে একটি অনলাইন মিডিয়ায় কাজ করতো; যার জীবনের প্রথম ইন্টারভিউটি আমার নেয়া; সে গত ৭২ ঘণ্টা ধরে ভিক্টিম ব্লেমিং করছে। ভাইটি আমার মেধাবী। কিন্তু ড্রপ আউট হয়ে গিয়েছিলো রবীন্দ্রনাথের মতো। রবীন্দ্রনাথ অনেক পড়ালেখা করে রবির আলো জ্বাললেন। কিন্তু ভাইটি আমার কিছুই না করে অনলাইন সেলিব্রেটি হলেন। আমাদের রাজনীতির প্রবাদ পুরুষদের রেখে যাওয়া অর্ধ শিক্ষিত জমিদার মেজাজের ভাইয়া ও আপাদের চর্বিত চর্বণের মিমি চুইংগাম চিবিয়ে ইতিহাস নির্মাণের আগেই ইতিহাস নির্মাতার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে নিলেন।

ভাইটির একটি মিষ্টি মেয়ে আছে; সে বড় হচ্ছে; নিশ্চয়ই আমার ছোট ভাইটির লেখা ভিক্টিম ব্লেমিং সে পড়ে। রোজিনা একজন নারী সাংবাদিক; যে ১৯২৩-এর দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইনে তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ; সেই আইনে নারী ও শিশুকে জামিন দিতে হবে এটা স্পষ্ট করে লেখা আছে। কিন্তু অদৃশ্য পুতুল নাচের ইতিকথার এই দেশে বিচারক বাকি মহোদয়; রোজিনার জামিন বাকি রেখেছেন রবিবার পর্যন্ত। অথচ এই টেকাস্তানে সিকদারগ্রুপের এটেম্পট টু মার্ডার কেসের পুত্র 'রণ' অপরাধ করে দেশ থেকে এয়ার বাসে করে পালিয়ে; সুযোগ বুঝে আবার ফিরে পাঁচ ঘণ্টায় জামিন পেয়েছে।

'আছেন আমার মুক্তার; আছেন আমার ব্যারিস্টার; শেষ বিচারের হাইকোর্টেতে তিনি আমায় করবেন পার'-এই গানের উপায়হীন মানুষটি হচ্ছি আমরা। 'অন্যায় যে করে, আর অন্যায় যে করে' তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সমদহে' কবিতার লাইনটি আমাদের কানে বাজতেই থাকে। ঘুমাতে দেয় না। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের রাত জাগা পরাজিত মেঘদল হয়ে আমরা বেঁচে থাকি।

কিছুকাল ক্যাডেট কলেজে পড়ার সূত্রে বন্ধু বৃত্তের একটি বড় অংশ সামরিক বাহিনীতে। এরাও কলেজ জীবনে আমাদের সঙ্গে বসে গিটার বাজিয়ে গাইতো, চলো না ঘুরে আসি অজানাতে; যেখানে নদী এসে মিশে গেছে। সামরিক বাহিনীতে তারাই এখন বস; আর তাদের শিষ্যরা ফেসবুকে আমাকে এসে, অমুক তথ্যের লিংক চায়; তমুক কথা কেন বললাম তার প্রমাণ চায়। জলপাই জিপের সামনে দাঁড়ানো নায়কোচিত প্রোপিকের এক তরুণ সেদিন লাইভ শো'তে আমাকে সরাসরি ভণ্ড বললো। বললো, রোজিনার কোন দোষই দেখতে পাচ্ছি না কেন? রোজিনা কেন এতো 'গোপনীয় রাষ্ট্রীয় তথ্য' চুরি করে ধরা পড়লো। এতো অনুজপ্রতিমকে কী করে বলি, ভাই স্বাস্থ্য-মন্ত্রণালয়ের মতো 'চোরের খনি'-র 'উলঙ্গ মন্ত্রকে'-র কী এমন গোপনীয়তা যা রোজিনা চুরি করতে পারে!
সেনাবাহিনীতে চান্স পাওয়ার পরে মানুষ একবার ম্যাগালোম্যানিয়ায় ভুগে; দ্বিতীয়বার সেনাপ্রধান হয়ে সেই একই অহমে ভুগে। সামরিক বাহিনীর ২২তম লং কোর্সে আমি চান্স পেয়েছিলাম। মনে মনে সেনাপ্রধান হয়ে এরশাদকে ফেলে দেয়ার দিবাস্বপ্ন দেখার সময় আম্মা কান ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিলেন। আর ভয় দেখালেন, বেশি বাড়াবাড়ি করলে বাড়ির অদূরে পাবনা মানসিক হাসপাতালে রেখে আসবেন। মা-ই যার এমন ফ্যাসিস্ট; সে আর প্রধানমন্ত্রীকে ফ্যাসিস্ট বলবে কোন মুখে! পারিবারিক জীবন-সমাজ জীবন-ফেসবুক জীবন-রাষ্ট্রীয় জীবন এমনকি দাম্পত্য জীবনে আমরা ফ্যাসিজমের স্বীকার ও শিকার। 'এ খাঁচা ভাঙ্গবো আমি কেমন করে'-এই গানটিই জীবনের থিম সং।

জেবুন্নেসা আপা মেধাবী ছাত্রী ছিলেন; পরে এতো প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন; হয়তো বিদেশ সফরে গিয়ে খিচুড়ি রান্না শিখে এসেছেন, স্কুলে বাচ্চাদের দুপুরের খাবার পরিবেশন প্রকল্পের প্রশিক্ষণে। তিনি তিন দশকের সুশীল সেবক বা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর জীবনে এটুকু ওজন করতে শেখেননি যে, প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। উনার অধীনের কনস্টেবল মিজান বা পিয়ন পলির সমালোচনা আমি করি না। কারণ ছোটবেলায় শিশুরা পুষ্টি না পেলে; মস্তিষ্ক বৃদ্ধি পায় না। ফলে 'হু ইজ হু', কাকে আঘাত করলে কতটা প্রত্যাঘাত আসবে ঐসব মিজান-পলি বোঝে না। মাতবর সাহেব কইলে তারা গিয়া সাংবাদিকের গলার টুটি চেপে ধরে দুর্নীতির খবরের সোর্সের নাম জেনে নেবে।

এই যে সোর্স; যার নাম জানার পর থেকে ছোট চুল-সুঠামদেহীরা নিশ্চয়ই তাকে উন্নয়নের ব্লেন্ডারে ভরে বাতাবি লেবুর জুস বানিয়ে খাওয়ার জন্য ঘুরছে। এইসব ছোট চুল সুঠাম দেহীদের বসেরাও আমাদের ইউনিভার্সিটির আমার চেয়েও বেশি সাম্যভাবনার লোক ছিলেন। যারা এখন 'খাশোগজি'-র কাগজি লেবুর জুস খেতে চান রাজকেল্লার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের ঘূর্ণায়মান চেয়ারে বসে।

মাও সে তুং এর সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিলো মাৎস্যন্যায় ; কার পেশী শক্তি বেশি! কার টিকে থাকার ক্ষমতা বেশি! এসব মাওলানা সাহেব দেখতেন তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে মাছ ধরা শেখানোর ভোর থেকে পলিট বুড়োদের মিটিং হয়ে; রাতে তেলাঞ্জলির বিদূষক বৈঠক শেষে ঘুমানো পর্যন্ত। মাও সে তুং এর একদলীয়-এক চিন্তার যন্ত্র চীনের টেকাটুকা হয়েছে; কিন্তু আমি মরে যেতে রাজি তবু; চীনের মতো বাক-স্বাধীনতাহীন দেশে বাস করবো না।

ওপিয়াম ওয়ারের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারে পাখির মতো মানুষ মেরেছে মাও-য়ের প্রদীপ; তাতেও কিন্তু চীন নেশামুক্ত হয়নি। টাকার নেশায় করোনাভাইরাসের নেশা ছড়িয়ে বেড়ায় চীনারা। বিশ্বের যে কোন জায়গায় গিয়ে পাগলের মতো ছবি তোলে। সিম্পটম সবই মিলে যায় আসল মদিনার খাশোগজিফোবিয়া থেকে ফেইক মদিনা'র রোজিনাফোবিয়ার; আসল চীনের 'ফাঁপা-জীবন' ফোবিয়া থেকে ফেইক চীনের 'ফাঁপা-জীবন' ফোবিয়ার।

আমাকে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো উগান্ডা; যার লাইলাতুল ইলেকশান, ভোটসমনিয়া, ইদি আমিনকে চেয়ারে তুলে উচ্চে দোলা দেয়া; সহমত ভাইয়ের আকুলি বিকুল লোকজ কাম্পালা; যেখানে আগে বাড়ির সামনে বাঁধা থাকতো বলদ; এখন বাঁধা থাকে উন্নয়নের প্রাডো। উগান্ডার লুণ্ঠক সমাজের লোকেরা আমাদেরই পরিচিতজন; আগে পান্তা খাইতো; এখন পাস্তা খায়। আগে সবুজ লুঙ্গি পরতো; এখন থ্রি পিস স্যুট পরে; আগে খালে বিলে ইঁচা মাছ ধরতে ঝাঁপ দিতো; এখন পাঁচ তারকা হোটেলের সুইমিংপুলে মারমেইড ধরে। সুগার এসোসিয়েশান অফ ড্যাড; স্যাড সদস্যরাও আমাদের খুব চেনা। এরা আমাদের ডিবেট ক্লাবে বসিয়ে রেখে লিটনের ফ্ল্যাটে যেতো। ফিরে এসে যুদ্ধে হারার গল্পটাই বানিয়ে ছানিয়ে বলতো।

এসবই স্প্যানিশ ট্র্যাজেডি; আমাদের চেনাজানা বৃত্তের মাৎস্যন্যায়। মুনিয়া হত্যার দুঃখ কিছুটা ভুলে, সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে মুনিয়ার স্মরণে বৃক্ষরোপণ করে; ঈদের তিনটা দিন ছুটি পেলাম। সেই ছুটি থেকে মন ভালো করে জীবনে ফিরতেই রোজিনা নিগ্রহের বিষাদ-যমুনা। দক্ষিণ এশিয়ার দোজখে জন্মেছি। শান্তি আমাদের কপালে নাই। মৃত্যু ছাড়া মুক্তি নাই। শুধু বিষ শুধু বিষ দাও; অমৃত চাই না।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ