আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

সত্য বললে আসলেই কিছু লোক রাগ করে!

কবির য়াহমদ  

‘সত্য বললে কিছু লোক আছে খুব রাগ করে/ এখন থেকে আর সত্য বোলো না তসলিমা/ গ্যালিলিওর যুগ নয় এই যুগ, কিন্তু/ এই একবিংশ শতাব্দীতেও/ সত্য বললে একঘরে করে রাখে সমাজ/ দেশছাড়া করে দেশ/ গৃহবন্দী করে রাষ্ট্র/ রাষ্ট্র শাস্তি দেয়/ সত্য বোলো না/ তার চেয়ে মিথ্যে বলো’ [এখন থেকে আর সত্য বোলো না]

বাংলাদেশে কবিতার জন্যে দেশ ছেড়েছিলেন কবি দাউদ হায়দার, গদ্যের জন্যে দেশ ছেড়েছিলেন তসলিমা নাসরিন। এ দুজনের মধ্যে সম্পর্ক আর পার্থক্যের দিকে তাকালে দেখা যায় দাউদ হায়দার যত পরিচিত তারচেয়ে বেশি পরিচিতি রয়েছে তসলিমা নাসরিনের বিশেষ করে অনগ্রসর ভাবনার মানুষদের কাছে। দাউদ হায়দার মুলত কবি কিন্তু তসলিমা নাসরিন সত্তর দশকের শেষের দিকে কবিতা লেখার মাধ্যমে তাঁর সাহিত্য জীবন শুরু করলেও আলোচনায় আসেন ‘লজ্জা’ এবং ‘আমার মেয়েবেলা’র কারণে। অপরদিকে কবি দাউদ হায়দারের নির্বাসিত জীবনের শুরু হয় ১৯৭৪ সালে যখন তসলিমা নাসরিন লেখালেখিতে প্রবেশই করেননি। দুজনইকেই দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।

‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ কাব্যগ্রন্থের জনক কবি দাউদ হায়দার তাঁর এক বিখ্যাত কবিতায় লিখেছিলেন “জন্মই আমার আজন্ম পাপ,মাতৃজরায়ু থেকে নেমেই জেনেছি আমি/ সন্ত্রাসের ঝাঁঝালো দিনে বিবর্ণ পত্রের মত হঠাৎ ফুৎকারে উড়ে যাই/ পালাই পালাই সুদূরে”।

হ্যাঁ, তিনি পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁকে বাধ্য করা হয়েছিল দেশ ছাড়তে এক সরকারি আদেশে। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাঁকে কলকাতাগামী এক বিমানে সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় তুলে দেওয়া হয়েছিল।  কলকাতা থেকে জার্মানি এবং সেখানেই তিনি বর্তমানে অবস্থান করছেন। কবি দাউদ হায়দারকে ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ কাব্যগ্রন্থের জন্যে দেশ ছাড়তে হয়নি। ১৯৭৩ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি কবিতার জন্যে তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল বলে জানা যায়। সে কবিতায় তিনি সব ধর্মের প্রতি বিষোদগার করেছিলেন বলে অভিযোগ।

‘কালো সুর্যের কালো বন্যায়’ শিরোনামের কবিতায় কবি লিখেছিলেন- ‘অদ্ভুত আলখেল্লা পরিহিত মিথ্যুক বুদ্ধ/ বুধি বৃক্ষতলে/ যিশু ভন্ড শয়তান/  মোহাম্মদ আরেক বদমাশ/ চোখে মুখে রাজনীতির ছাপ’। এরপর সে কবিতা তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। মামলাও ঠুকে দেওয়া হয় তাঁর বিরুদ্ধে। বায়তুল মোকারমের সামনের এক সমাবেশ থেকে তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্রে জানা যায়,পরবর্তীতে কবি তাঁর কবিতা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। কিন্তু তাঁর শেষরক্ষা হয়নি, দেশ ছাড়তে হয়। দেশ থেকে কলকাতায় নির্বাসিত জীবন কাটানোর এক পর্যায়ে কলকাতাও ছাড়তে হয় এবং সর্বশেষ আশ্রয় নেন জার্মানিতে। সেখানে বর্তমানে অবস্থান করছেন।

নির্বাসিত জীবন কাটানোর এক পর্যায়ে কবি দাউদ হায়দারের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হলে ১৯৭৬ সালে তিনি কলকাতাস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে পাসপোর্ট নবায়নের জন্যে আবেদন করেন। কিন্তু  সে পাসপোর্ট নবায়ন না করে বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৯৭৩ সালে এই কবিতার জন্যে কবিকে জেলে যেতে হয়েছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ সরকার সে সময় মুসলিম বিশ্বের মুখাপেক্ষি ছিল বলে সরকার ইচ্ছা করেই তাঁকে দেশান্তর করেছিল। প্রবল নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন কবি দাউদ হায়দার। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তিনি যখন রাষ্ট্রের কাছে আশ্রয় চাইলেন সে সময় সরকার তাঁকে নিরাপত্তা না দিয়ে দেশছাড়া করেছিল যেখানে প্রকাশ পেয়েছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের দূর্বলতা।

তসলিমা নাসরিনের লেখালেখির বিকাশ মূলত গদ্যে। কবিতায় যাত্রারম্ভ হলেও গদ্যে তিনি ধর্মান্ধতা, মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং নারীর সম অধিকার নিয়ে লিখতে শুরু করেন। ব্যক্তি জীবনের নারীদের সামাজিক প্রতিবন্ধকতা যেখানে ধর্মের নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছিল তখন তিনি তাঁর লেখনিতে আগুন ছড়িয়েছিলেন। ফলে উস্কে ওঠে ধর্মান্ধতা। তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। আশ্রয় নেন কলকাতায় কিন্তু ওখানেও তাঁর স্থান হয়নি।

পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম মৌলবাদীদের তিব্র আপত্তির মুখে বামপন্থি সিপিএম সরকার তাঁকে কলকাতা ত্যাগে বাধ্য করে। এরপর তিনি পৃথিবীর অনেক দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন কিন্তু বাংলা আর বাঙালিদের টানে বারবার ফিরে আসতে চেয়েছেন বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে। কলকাতা থেকে নির্বাসিত হয়ে যাওয়ার পর তিনি ভারতের দিল্লিতে বসবাস শুরু করেন। অতি সম্প্রতি ভারতের সরকারের নরেন্দ্র মোদির বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর তাঁর আবাসিক ভিসা পালটে মাত্র দুই মাসের মাল্টিপল ভিজিট ভিসার পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়। তসলিমা নাসরিন এরপর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন। আবেদন করেন স্থায়ী ভিসার জন্যে। মন্ত্রীর উদ্যোগে ভারতের আবাসিক ভিসা পান তসলিমা নাসরিন।    

ভারতের আবাসিক ভিসা পেয়েছেন লেখিকা তসলিমা নাসরিন এটা স্রেফ একটা সংবাদ। এই সংবাদের পেছনে জড়িয়ে আছে জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জার ইতিহাস। কারণ তসলিমা নাসরিন ভারতের নাগরিক নন। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক এবং বাংলাদেশে ফিরে আসার জন্যে তিনি মুখিয়ে আছেন। যখন একটা দেশ আরেকটা দেশের নাগরিককে শুধুমাত্র থাকার নিশ্চয়তা দেয় তখন সেটা ঐ দেশের প্রতি করুণা ছাড়া আর কিছুই নয়। তসলিমা নাসরিনকে ভারতে থাকার নিশ্চয়তা দেওয়া বাংলাদেশের প্রতি ভারতের একটা করুণা। এই করুণা যুগপৎভাবে লজ্জা আর হতাশার। কারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্র টুঁটি চেপে ধরেছে তাঁর নাগরিক অধিকার,স্পষ্টত লঙ্ঘন করেছে সাংবিধানিক মত প্রকাশের অধিকারের অঙ্গীকার।

১৯৯৪ সালে মৌলবাদীদের হুমকির মুখে তসলিমা নাসরিনকে দেশত্যাগ করতে হয়েছিল। তাঁকে হত্যার হুমকি সহ হত্যাকারীদের নগদ পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছিল জঙ্গিগোষ্ঠী। উগ্র কাঠমোল্লাদের কেউ তাঁর কোন বই পড়েছিল বলে মনে হয়না এবং এক শ্রেণির সুবিধাবাদিগোষ্ঠী তাতে গলাও মিলিয়েছিল। ঐ গোষ্ঠীবদ্ধরা আগের মতো এখনও সক্রিয়। অনেকে হয়ত সে রকম মৌলবাদী দলগুলোর সাথে জড়িত নয় কিন্তু অন্তরে ধারণ করে আছে ভয়াবহ মৌলবাদ। তারা কোনক্রমেই মৌলবাদীগোষ্ঠীর চাইতে কম ভয়ঙ্কর নয় বরং ক্ষেত্রবিশেষে এই ভয়াবহতা হতে পারে মাত্রাতিরিক্ত।

গত ২০ বছরে বাংলাদেশ শাসন করে গেছে আওয়ামীলীগ-বিএনপি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই সময়ে কেউই তসলিমা নাসরিনের দেশে ফেরার আকুতিকে গ্রহণ করেনি। উলটা মৌলবাদীদের ভোটের লোভে তারা ফিরিয়ে দিয়েছে তাঁর আবেদন। বিএনপির সাথে মৌলবাদীদের সম্পর্ক নিবিড়, অনেকেই আওয়ামীলীগকে মৌলবাদবিরোধী শক্তি হিসেবে ভাবতে পছন্দ করেন।  কিন্তু তসলিমা নাসরিন প্রশ্নে আওয়ামীলীগের অবস্থান হতাশার,অনেক ক্ষেত্রে মৌলবাদি চিন্তার সাথে সমার্থক!

আমাদের সংবিধান নাগরিকের মত প্রকাশের অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে। তসলিমা নাসরিনের লেখালেখি এবং দেশে থাকার বিরোধিতা করা মানে সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিক অধিকারের প্রতি সুস্পষ্ট বিরোধিতা। যারা হুমকি দিচ্ছে, যারা দেশে থাকতে বাঁধা দিচ্ছে তারা কী সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত হবে না?

বর্তমানে সরকারে আছে আওয়ামীলীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। আওয়ামীলীগ সরকার যদি জেনেশুনে অমান্য করতে চায় ৩১শে ডিসেম্বর, ১৯৭০ সালে ইত্তেফাক গ্রুপ অফ পাবলিকেশান্সের সাংস্কৃতিক ও চলচ্চিত্র বিষয়ক সাপ্তাহিকী 'পূর্বাণী’র ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ঢাকার হোটেল পূর্বাণীতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সে মত প্রকাশ সম্পর্কিত ভাষণের কথা তাহলে জাতির পিতার প্রতি তাদের ভয়াবহ রকমের অবমাননা করা হবে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- "জনগণের স্বার্থে এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্যে সাহিত্যিকদের প্রাণ খুলে আত্মনিয়োগ করার জন্যে আমি আবেদন জানাচ্ছি। আমি তাঁদের আশ্বাস দিচ্ছি, শিল্পী, কবি এবং সাহিত্যিকবৃন্দের সৃষ্টিশীল বিকাশের যে কোন অন্তরায় আমি এবং আমার দল প্রতিহত করবে। [সূত্রঃ আজাদ, ইত্তেফাক, ১লা জানুয়ারি, ১৯৭১]"

প্রশ্ন আসতে পারে বঙ্গবন্ধুর সময়ে দাউদ হায়দারকে দেশান্তরিত হতে হয়েছে। এটাকে দিয়ে তসলিমা নাসরিনের দেশান্তরকে কেউ যদি যৌক্তিকতা খুঁজেন তাহলে বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন। দাউদ হায়দার যদি বাংলাদেশে আসতে চান তাহলে অবশ্যই বাংলাদেশের উচিত হবে তাঁকে সে সুযোগ দেওয়া কারণ এই দেশটা তাঁরও। তিনিও দেশদ্রোহী কেউ নন।

তসলিমা নাসরিনের কী অপরাধ, লেখালেখি? লেখালেখি যদি অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে এটা রাষ্ট্র পরিষ্কার করে দিলেই পারত। অথচ আমাদের সংবিধান সংবিধান এবং মানবাধিকারের বিশ্বজনীন ঘোষণাপত্রে বর্ণিত বাক স্বাধীনতা দিয়েছে এর সুস্পষ্ট নিশ্চয়তা।  ১৯৪৮ সালে গৃহীত Universal Declaration of Human Rights এর আর্টিকেল ১৯ এ রয়েছে-Everyone has the right to freedom of opinion and expression; this right includes freedom to hold opinions without interference and to seek, receive and impart information and ideas through any media and regardless of frontiers. এই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকেও বাক এবং ব্যক্তির স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিতে হবে।

অনুরূপভাবে International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR) এর আর্টিকেল ১৯ ও কথাবলার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। "the right to hold opinions without interference. Everyone shall have the right to freedom of expression".  আমাদের সংবিধান ব্যক্তির মতপ্রকাশ এবং বাক স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতা প্রসঙ্গে লেখা আছে এভাবে-“Freedom of thought and conscience is guaranteed” (চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইলো)। সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদে আছে-“Subject to any reasonable restrictions imposed by law in the interests of the security of the State, friendly relations with foreign relations with foreign states, public order, desency or morality, or in relation to contempt of court, defamation or incitement to an offence-
(a) the right of every citizen to freedom of speech and expression
(b) freedom of press are guaranteed.
“রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানী বা অপরাধ, সংগঠনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে-
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের,
(খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হলো।
 
তসলিমা নাসরিনের পাসপোর্ট কেন নবায়ন করা যাবে না, কেন তিনি বাংলাদেশের নাগরিক ও মত প্রকাশের সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন না? তিনি বাংলাদেশ বিরোধি কোন লেখা কিংবা উক্তি করেছেন এমন শোনা যায়নি, এরকম কোন অভিযোগও নাই তাঁর বিরুদ্ধে। শুধু লেখালেখি স্টাইল যদি তাঁর অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে কী রাষ্ট্র একটা 'সাহিত্য নীতিমালা'র দিকে এগুবে? তাছাড়া বাংলাদেশ কোন ধর্মরাষ্ট্র নয় যে ধর্মপালন সেখানে অবশ্যকর্তব্য হয়ে যাবে। সবার সব লেখা যে সমালোচনার উর্ধ্বে ওঠে যাবে তা না এটা নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে কিন্তু জোর করে টুঁটি চেপে ধরা ধরা কিংবা হত্যার হুমকি অথবা দেশে বসবাস করার অধিকার রহিত করা কোন সভ্য সমাজ-রাষ্ট্রের আচরণ হতে পারেনা।

তাঁর পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে রিপোর্ট করেছে BBC ১৬ জুলাই, ২০১৪ তারিখে। রিপোর্টে বলা  হয়েছে ‘Her Bangladeshi passport was revoked soon afterwards - a move Ms Nasreen has always considered the highest affront and a denial of her rights.’ যার সত্যতা মেলে তসলিমা নাসরিনের বিভিন্ন সময়ে দেওয়া সাক্ষাৎকার এবং লেখালেখিতে। ১৯৯৪ সালে দেশত্যাগে বাধ্য হওয়ার পর ২০০১ সালে তাঁর পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়। যথারীতি তিনি পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন করেন কিন্তু তাঁকে পাসপোর্ট নবায়ন করে দেওয়া হয়নি। শুধু ভারত নয় পৃথিবীর যেখানে গেছেন সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসে তিনি আবেদন করেছেন এবং একইভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। বাংলাদেশের সরকারগুলো মৌলবাদি চক্রের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে তাই তারা একজন নাগরিকের ন্যায্য অধিকার দিতে চায়না। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত।

ভারত ছাড়াও তসলিমা নাসরিন সুইডেনে থেকেছেন। বিবিসি রিপোর্ট অনুযায়ি তিনি সুইডেনেরও নাগরিক। সেখানকার পাসপোর্ট থাকার পরও তিনি চাইছেন তাঁর দেশ বাংলাদেশের পরিচয় তাই বারবার আবেদন করছেন। বারবার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরও বলছেন তবু বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয় চাইবেন তিনি।বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে বলেছেন- "I visit Bangladesh's embassies and high commissions all over the world frequently to try to renew my passport and return empty handed. No reason is supplied why my application is refused. Some of the embassy staff are even sympathetic to me, but they can't go against the government diktat," সুইডেন কিংবা ইউরোপের পাসপোর্টধারীদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে আসা-যাওয়ার জন্যে কোন ভিসার দরকার পড়ে না, এটা সত্য।

অনেকেই মনে করেন সুইডেনের পাসপোর্ট থাকলে বাংলাদেশে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো বাংলাদেশে থাকা কিংবা যাতায়াতের জন্যে এই মুহুর্তে যতটা না নিরাপত্তার প্রশ্ন তারচেয়ে বেশি প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার কী আদৌ তাঁকে বাংলাদেশে ঢুকতে দিচ্ছে? কারণ ইউরোপের পাসপোর্টধারীদের জন্যে ভিসার প্রয়োজন না হলেও সংশ্লিষ্ট দেশস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ‘No Visa required’ সিলমোহর নিতে হয়। বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে কোন দেশেরই বাংলাদেশ দূতাবাস সেটা দিতে আগ্রহী নয়। ফলে চাইলেও তাঁর বাংলাদেশে আসা অসম্ভব!   

লেখালেখির ক্ষেত্রে অন্য সবার মতো তসলিমা নাসরিনও চাচ্ছেন মত প্রকাশের অধিকারের নিশ্চয়তা। তিনি শুধু তাঁর নিজের জন্যেই বলছেন তা না। বলছেন- "Remember, this is not about me as an individual. This is about freedom of expression" এটাই সত্য! ফলে বলা যায়, ব্যক্তি কেউ অন্যের লেখার প্রতি সবিশেষ একাত্মতা ঘোষণা করবে তা না। লেখালেখি কোন সময়েই অবিসংবাদিত সত্য হতে পারেনা। এর মধ্যে থাকতে পারে যুক্তি, পাল্টা যুক্তি! কিন্তু নিজস্ব মতামত চাপিয়ে দিতে গিয়ে অন্যের কলম ভেঙে দেওয়া, টুঁটি চেপে ধরা ফ্যাসিবাদি মানসিকতা। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র এই ভয়াবহ অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছে এবং নিজেও তা লালন করছে।

লেখালেখি জীবনে তসলিমা নাসরিন প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এই দুঃসাহসী ঝড়। তাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ তিনি ধর্মের বিরুদ্ধে লিখছেন। পুরুষবাদ আর নারী অধিকার বিষয়ে লেখালেখি যদি ধর্মের বিরুদ্ধে যায় তাহলে কী ধর্ম নারীকে মূল্যায়ন করে না? খেয়াল করলে দেখা যায়, ইসলাম ধর্মাবলম্বী আলেম-ওলামা এবং সাধারণ মানুষেরা গলা উঁচিয়ে বলে থাকে ইসলাম নারীকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছে। এই সর্বোচ্চ মর্যাদার স্বরূপ মুখে মুখে কানে কানে কিন্তু যখনই কেউ নারী অধিকার নিয়ে কথা বলে তখনই ধর্ম গেল, ধর্ম গেল বলে সুর তুলে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এবং তাদের সাথে একই সুরে কথা বলে বর্ণচোরা প্রগতিশীলেরা। ফলে স্বভাবত প্রশ্ন জাগে ধর্ম কী এতই ঠুনকো যে কয়েক প্রস্থ লেখা লিখলেই পৃথিবী থেকে কিংবা দেশ থেকে ধর্ম চলে যাবে? আদতে ধর্ম যেখানে বিশ্বাসে স্থিত হওয়ার কথা ছিল সেখানে চলে এসেছে লৌকিকতার আবরণে। এর মাধ্যমে কী ধর্মান্ধরা তাদের বিশ্বাস এবং ধর্মকে হালকা করছে না?  

ধর্মবোধ ঠুনকো কি, ধর্ম ব্যক্তিকেন্দ্রিক কিছু কি? ধর্মে যদি কেউ বিশ্বাস করে থাকে তাহলে বলা যায় ধর্ম মানুষকে মহান করেনি, উলটো মানুষ ধর্মকে মহান করেছে। ধর্মবিশ্বাস মানুষের আচরণ, জীবনধারণের সার্বক্ষণিক অনুষঙ্গ নয়। লেখালেখির মাধ্যমে ধর্মের প্রচলিত আচার-আচরণকে যদি প্রশ্নের মুখোমুখি করা হয় তাহলে এর প্রতিক্রিয়ায় লেখালেখি দিয়েই তার জবাব দেওয়া সম্ভব। কিন্তু তা না করে অন্যায় এবং অযৌক্তিকভাবে দেশছাড়া করা, হত্যার হুমকি দিয়ে, হত্যা করে কি ধর্মের প্রতি সুবিচার করা হয়?  

তসলিমা নাসরিনের বাংলাদেশে ফেরার নিশ্চয়তার দাবি জানানো মানে তার সাহিত্যকে অবিসংবাদিত সত্য কিংবা সমালোচনার উর্ধ্বে তা প্রমাণ করা নয়। পৃথিবীর কিছুই অবিসংবাদিত সত্য আর সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। মত-প্রতিমত-ভিন্নমত আছে বলেই আমরা নিজেদেরকে মুক্তচিন্তার মানুষ বলে দাবি করতে পারি। বাংলাদেশের একজন নাগরিক তাঁর বাংলাদেশে ফেরার নিশ্চয়তা চাচ্ছে এবং সংবিধান প্রদত্ত নাগরিক অধিকারের দাবি জানাচ্ছে- এই দাবির প্রতি সমর্থন আমাদের মানবিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব। একজন বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে তিনি চান বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয় এই বোধের মুখোমুখি দাঁড়ালে মনে হয় কত হালকা একটা বিষয়কে বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশ রাষ্ট্র ক্রমে জটিল করে তুলছে।

বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয় সুবিন্যস্তভাবে পাওয়ার পর তিনি নিজেই নির্ধারণ করবেন  তাঁর কোথায় আর কীভাবে থাকা উচিত। এটা শুধু মানবিক বোধই নয়, নাগরিক অধিকার। বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নাগরিক অধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; কোনক্রমেই এর ব্যত্যয় কাঙ্ক্ষিত নয়! বাংলাদেশ যদি তসলিমা নাসরিনকে তাঁর প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জার খতিয়ান দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত হবে।

তসলিমা নাসরিন তাঁর সাম্প্রতিক অবস্থা সম্পর্কে লিখেন- তোমরা সবাই মিলে কিছু একটা দোষ আমার বার করো,/ কিছু একটা দোষ তোমারা সবাই মিলে বার করো, / না হলে অকল্যাণ হবে তোমাদের।/ সবাই মিলে তোমরা বলো কি কারণে আমাকে নির্বাসন  দিয়েছো।/ আমার জন্য কোথাও মড়ক লেগেছে, কোথাও শিশুমৃত্যু,/ ধর্ষণ বা গণহত্যার মতো কোনও অপরাধ আমি করেছি,/এরকম কিছু একটা বলো,/ নির্বাসনের পক্ষে অন্তত দুটো তিনটে যুক্তি হলেও দাঁড় করাও। [মুক্তি/ তসলিমা নাসরিন] সবাই ব্যস্ত হয়ে আছে দোষ ধরতে। যার যার মতো করে লেখালেখি বিশ্লেষণে কারণ তাঁকে রুখতে হবে!

কবি দাউদ হায়দার এবং লেখিকা তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশের মানুষ। বাংলাদেশের নাগরিকেরা দেশে দেশে আশ্রয়ের জন্যে ভিক্ষা চাইবে এটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্যে লজ্জার। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তাঁদের বাংলাদেশে থাকার যেমন অধিকার রয়েছে তেমনি অধিকার রয়েছে নাগরিক হিসেবে পরিচয় দেওয়ারও।  বাংলাদেশের সংবিধান নাগরিকের মত প্রকাশের অধিকার দিয়েছে এবং রাষ্ট্রের শাসকগণ নাগরিকদের প্রতি সংবিধানে উল্লেখিত সে সব অধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

সুস্থ রাষ্ট্রের কাছে গণদাবি হতে পারে এই নাগরিক অধিকার- এটা চিরন্তন সত্য। কিন্তু এই সত্যদাবি যখন প্রকাশ হয় তখন কিছু লোক রাগ করে, কিছু লোক ক্ষোভে ফেটে পড়ে আর কিছু লোক তেড়ে আসে। মানুষের মধ্যকার এই পশুপ্রবৃত্তি যুগ যুগ ধরে বহমান। পশুপ্রবৃত্তিভুক্ত মানুষদেরকে সুকুমার প্রবৃত্তিতে নিয়ে আসা সুস্থ রাষ্ট্রের অবশ্যকর্তব্য।

পশুপ্রবৃত্তির মানুষের আচরণ রাষ্ট্র ধারণ করলে সমস্যা, লজ্জাজনক সমস্যা। বাংলাদেশ মুক্তি পাবে এই ভয়াবহ অমানিশা থেকে, মুক্তচিন্তা আর বাক স্বাধিনতাকে সমর্থন দিয়ে। নাগরিকের নাগরিক অধিকারের সাথে এটা রাষ্ট্রের কর্তব্য!

কবির য়াহমদ, প্রধান সম্পাদক, সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর; ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ