প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জহিরুল হক বাপি | ০৯ জুন, ২০২১
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বাবু গয়েশ্বর রায় বলেছে জিয়াউর রহমান ৭১-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে যুদ্ধ করেননি। সত্য কথা বলার জন্য তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারা যাচ্ছে না। বাবু গয়েশ্বর রায় আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। উনি জেনে, বুঝে সত্য স্বীকার করেছেন নাকি কথার স্রোতে সত্য বলেছেন কে জানে। যে কারণেই হোক মোদ্দা কথা বিএনপি নেতা সত্য প্রকাশ করেছে। ভবিষ্যতে বাকিরাও হয়ত একে একে সত্য স্বীকার করবে।
হ্যাঁ, ৭১'এর ২৫ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমানের পোস্টিং ছিল চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে ইপিআর-এর মেজর রফিকুল ইসলাম যখন চট্টগ্রামে প্রতিরোধ শুরু তখন জিয়াউর রহমান নেভির গাড়িতে চট্টগ্রাম বন্দরে যাচ্ছিলেন অস্ত্রবাহী সোয়াত জাহাজের অস্ত্র খালাসের অসাধ্য সাধন করতে। এরআগে গুলি চালিয়েও বন্দর শ্রমিকদের দিয়ে অস্ত্র খালাস করতে পারেনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনী। শেষ ভরসা হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয় আইএসআই অফিসার (বেঙ্গল রেজিমেন্টে পদায়ন) মেজর জিয়াউর রহমানকে। সে রাতে জিয়াউর রহমান বেঁচে যান "গায়েবী" কারণে। ইপিআর-এর মর্টার জেসিও আইজউদ্দিন পাহাড়ের উপর ওৎ পেতে বসেছিল পাকিস্তানি শিকারের জন্য। নেভির গাড়ি আসতে দেখে জেসিও কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন রফিকের কাছে মর্টার চার্জের অনুমতি চায়। কিন্তু এটিকে অগ্রগতি দল মনে করে মেজর রফিক অপেক্ষা করতে বলে। ২৪ মার্চ সন্ধ্যার পর ক্যাপ্টেন রফিকের সাথে মেজর জিয়াউর রহমানের দেখা হয়েছিল। রফিক সে সন্ধ্যায় জিয়াউর রহমানকে যুদ্ধের প্রস্তুতির প্রস্তাব দিলে জিয়া পরোক্ষ ভাবে রফিককে তিরস্কার করেন।
২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকে ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে ইপিআর চট্টগ্রাম দখলে, নিয়ন্ত্রণে নিতে থাকে। মধ্যরাতের পরে চট্টগ্রামের বেশিরভাগ অংশ ইপিআর-এর দখলে চলে আসে। যদিও পাকিস্তানি, বিহারীরা মিলে চট্টগ্রামের বেশ কিছু জায়গায় গণহত্যা চালাচ্ছিল, চালিয়ে ছিল। সেনা ও নৌ মিলে চট্টগ্রামে পাকিস্তানিরা খুব একটা শক্তিশালী ছিল না। পাকিস্তানির চেয়ে বাঙালি সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনী ইপিআর-এর সংখ্যা ছিল কয়েকগুণ বেশি। যদিও ইপিআর-এর অস্ত্র সামরিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার উপযোগী ছিল না। ক্যাপ্টেন রফিকের আশা ছিল চট্টগ্রামের সিনিয়র বাঙালি সেনা অফিসার মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে দলবল নিয়ে ইপিআর যোগ দেবেন এবং জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম পুরো দখলে নেবে। সর্বোচ্চ দুই দিনের ব্যাপার। বেশিরভাগ এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো এর মধ্যে ইপিআর দখলে নিয়েছে। চট্টগ্রামের আশেপাশের বিভিন্ন ইপিআর পোস্ট থেকে সৈন্য অফিসাররা আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী চট্টগ্রামে দ্রুত পৌঁছে যাবে। চট্টগ্রাম পুরো দখলে নিতে পারলে পাকিস্তানিরা সহজেই আর চট্টগ্রাম দখল করতে পারবে না। পাহাড়ের কারণে এয়ার বা নৌ এট্যাক করে খুব একটা সুবিধা হবে না। ভৌগলিক কারণে বড় পরিকল্পনা ছাড়া কোনভাবেই চট্টগ্রাম ঢুকা সম্ভব না পাকিস্তান সেনাবাহিনীর। একবার চট্টগ্রাম দখলে নিতে পারলে ৬/৭ মাসেও পাকিস্তানিরা চট্টগ্রাম দখল নিতে পারবে না। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক সাহায্যও পাওয়া যাবে।
কিন্তু রফিকের আশায় পানি ঢেলে ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর জিয়া বেঙ্গল রেজিমেন্টে ও অন্যান্য কোরের হাজার খানেক বাঙালি নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে রওনা দেন। অথচ তখন চট্টগ্রাম বাঙালিদের নিয়ন্ত্রণে। সে রাতে জিয়াতো যোগ দেনইনি উপরন্তু পরবর্তী ক'দিন বিভিন্ন স্থান থেকে চট্টগ্রাম যুদ্ধ করতে আসা ইপিআরের বড়সড় বাহিনীকে পথিমধ্যে থামান। বিভিন্ন মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে তাদের চট্টগ্রাম যেতে দেননি।
চট্টগ্রামে জিয়াউর রহমানের কাহিনী বিচিত্র ও সন্দেহজনক। চট্টগ্রামে কাছে বিরাট সৈন্য বাহিনীর বসিয়ে রেখে সন্দেহজনক চরিত্র ভারতীয় মাহমুদের কথায় কক্সবাজার যাওয়ার পথে জিয়া গণপিটুনিতে মরতেন যদি ক্যাপ্টেন অলি সাথে না থাকতেন। জিয়া বাংলা বলতে না পারাতে জিয়াকে কক্সবাজারের কাছের মানুষ বিহারী ভেবেছিল। এই একই কারণে গণপিটুনিতে মাহমুদ নিহত হন। মাহমুদ ছিলেন ভারতীয় বিতর্কিত রাজনৈতিক নেতা মোরারজি দেশাইয়ের মেয়ে বা ভাসতি জামাই। দেশাইকে সিআইএই'র এজেন্ট হিসাবে সন্দেহ করা হতো।
চট্টগ্রামের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য চট্টগ্রাম থেকে জিয়াকে অফিসিয়ালি বদলী করা হয়। সেক্টর গঠনের পর প্রত্যেক বাঙালি অফিসারকে স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় সামরিক বাহিনী স্ক্রিন টেস্টের আওতায় নেয়। অফিসারদের বিভিন্ন তথ্য যাচাই বাছাই করে সামরিক ইন্টেলিজেন্স ও র। জিয়া ছাড়া প্রায় প্রত্যেক অফিসারই তিন থেকে সাতদিনের মধ্যে উত্তীর্ণ হন। এ সময়টা তারা এক ধরনের কাস্টডিতে ছিলেন। তিন সপ্তাহ পার হওয়ার পরও যখন জিয়াকে ছাড়া হচ্ছিল না তখন ওসমানী ও তাজউদ্দীন হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হন।
জুনের শেষ দিকে জেড ফোর্স গঠন হয় কলকাতায়। এই ফোর্স গঠনের সময়ও লে. কর্নেল জিয়াউর রহমান বিতর্ক সৃষ্টি করেন। জেড ফোর্স সৃষ্টি হওয়ার দু'তিন দিনের মাথায় জিয়া জামালপুর জেলার সীমান্তবর্তী ধানুয়া কামলপুর বিওপি ঘাঁটি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। কামালপুরের ঘাঁটি ছিলে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের ঘাঁটিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও সুরক্ষিতদের একটি। এটি এতই শক্তিশালী ছিল যে তখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বলা হয়ে হতো- kamalpur is get way to Dacca; কামালপুর যার দখলে থাকবে ঢাকাও তার। এতই দুর্ভেদ্য দুর্গ ছিল ধনুয়া কামালপুর ঘাঁটি।
মহেন্দ্রগঞ্জ ঘাঁটি থেকে মেজর মঈনের নেতৃত্বে ভারতীয় বিএসএফের সহযোগিতায় ঐ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ করছিল। তাদের অভিজ্ঞতা, ভারতীয়দের অনুরোধ উপেক্ষা করে জেড ফোর্স কমান্ডার জিয়াউর রহমান ধনুয়া কামালপুর আক্রমণের নির্দেশ দেন। ধনুয়া কামালপুর এট্যাকের জন্য দরকার ছিল একসাথে ট্যাঙ্ক এট্যাক ও এয়ার এট্যাক। তার সাথে দীর্ঘ প্রস্তুতি। কিন্তু জিয়া কোন কিছুই শুনতে রাজি ছিলেন না। ফলত আক্রমণ এবং ফলাফল: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সম্মুখ যুদ্ধে সবচেয়ে বড় ক্ষতি। যা পরবর্তীতেও আর পূরণ করা তো যায়নি উপরন্তু যুদ্ধ একটা ঝাঁকিও খায়। এ যুদ্ধে মারা যান ৬৭ জন মুক্তিযোদ্ধা। এরমধ্যে ৩৬ জন সামরিক বাহিনীর অফিসার, সৈন্য। আহত শতাধিক। তখন সামরিক বাহিনীর প্রতিটিই সদস্য যুদ্ধের জন্য অমূল্য সম্পদ। গণযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, প্রাথমিক নেতৃত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল সামরিক অফিসারও সৈন্যরা। এই আক্রমণকে স্যাবোটাজ ভাবার অনেক কারণ আছে। সে যুদ্ধের অনেকে এখনও জীবিত। তাদের কারো কারো ভাষ্য- পাকিস্তানিরা মুক্তি বাহিনীর জন্য আগে থেকে রেডি হয়ে ছিল।
কামালপুরের যুদ্ধের পরপর লে. কর্নেল জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে পালিয়ে যান। ওসমানী অবস্থা দেখতে কলকাতা থেকে মহেন্দ্রগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা ঘাঁটিতে আসেন এবং জিয়াকে মৌখিক বহিষ্কার করেন। এরআগে ও পরে লে. কর্নেল জিয়াউর রহমান মৌখিক বহিষ্কার হয়েছিলেন। ওসমানী মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে কলকাতা ফিরে জেড ফোর্স বিলুপ্ত ঘোষণা করে জিয়াকে সিলেটের কাছে মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং সেন্টারে বদলী করেন। রণাঙ্গনে জিয়ার চলাচল এখানেই শেষ মোটামুটি। মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে জিয়ার মূল কাজ ছিল ঘুরে ঘুরে আওয়ামী লীগ নেতা ও ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়া। এর জন্য জিয়াউর রহমানকে কয়েকবার আন-অফিসিয়াল কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি হতে হয়। কয়েকবার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নাজেহাল, লাঞ্ছিত হতে হতে বেঁচে যান।
জিয়াউর রহমান যে বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধে যোগ দেননি এটা নিশ্চিত। গয়েশ্বর রায় শতভাগ সত্য বলছেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাসের জিয়ার কর্মকাণ্ডও গয়েশ্বর রায়ের বক্তব্য সমর্থন করে। মুক্তিযুদ্ধের বারবার ক্ষতিই করে গেছেন জিয়াউর রহমান।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য