আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

মানুষ, মানুষ

জহিরুল হক বাপি  

আত্মীয়, স্বজন, সম্পর্ক, শিক্ষা, শিক্ষিত এ বিষয়গুলোর উপর আমার আস্থা চলে গেছে বহু আগেই। একেবারেই চলে গেছে। বৈবাহিক, রক্তের বিভিন্ন ধরণের সম্পর্কগুলো বাণিজ্যিক। স্বার্থের দ্বন্দ্ব, অকারণ প্রতিযোগিতায় কৃতঘ্নতা, চতুরতা, নির্লজ্জতার ভরা ফসলের মাঠ। কিন্তু আমার কঠিনতম আস্থা রয়ে গেছে ‘মানুষ’ শব্দটার উপর। এ করোনার সময়ে আত্মীয়, স্বজন দূরে সরে গেলেও ‘মানুষ’ কখনও সরেনি মানুষের কাছ, পাশ থেকে।

কয়েক হাসপাতাল ঘুরেও একজন কোথাও অক্সিজেন পায়নি। কোভিড কিনা নিশ্চিত না। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হবার পর একা একাই হাসপাতালের খোঁজে বের হয়েছিল। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার অবস্থা দেখে নিজেই দৌড়ে গেলেন অক্সিজেনের জন্য। অক্সিজেন লেভেল ৮৯! কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বললেন কোন সিলিন্ডার খালি নাই। অন্য কোন হাসপাতালে দ্রুত যাওয়ার জন্য। যেখানে অক্সিজেন পাবেন সেখানেই টেস্ট করানোর জন্য। সম্ভব হলে বেসরকারি হাসপাতালে যাবার জন্য। সেখানে কোন ব্যবস্থা হলেও হতে পারে। ডাক্তার চলে গেলেন।

রোগী হেঁটে পার্কিংয়ের কাছে যেতে যেতেই শ্বাসকষ্টে এক কোণায় বসে পড়ল। মুখে ফেনা। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নাই। তেমন কেউ নাইও সেবা শুশ্রূষা করবে। করোনার মৃদু লক্ষণ নিয়ে একা একাই ছিল। হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়াতে কষ্ট সহ্য না করতে পেরে বের হয়েছে। সরকারি হাসপাতালেও খরচ নেহাত কম না, অবস্থা গুরুতর হলে। হাসপাতালের সামনে প্রচণ্ড ব্যস্ততা। অ্যাম্বুলেন্স আসছে নিঃশব্দে। বেরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত সাইরেন বাজাতে বাজাতে। অক্সিজেন নাই। বেড নাই। অন্য কোন হাসপাতালের খোঁজে দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে। ইয়া নফসি, ইয়া নফসি।

২টা অ্যাম্বুলেন্স বসে আছে। যদিও দেশের কোথাও সহজেই অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যাচ্ছে না। হতে পারে এগুলো নষ্ট। যা এ মুহূর্তে স্বাভাবিক না। এখন ব্যবসার সময়। হতে পারে অ্যাম্বুলেন্স দুইটা বসে আছে লাশের অপেক্ষায় বা অন্য কোন কারণে। একলা রোগীর ইচ্ছা করলো কোন একটা অ্যাম্বুলেন্সে উঠে পড়তে। ওইখানে অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে। বাতাস। নিঃশ্বাস। একটু যদি পাওয়া যেত তবে গলা ব্যথা, গা ব্যথাটাও হয়তো বা কমতো। যদি অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতাল খোঁজা যেত। সেটা সম্ভব না। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এক ঘণ্টার অক্সিজেন ৫০ হাজার টাকার বেশি নেওয়ার খবর এসেছে। বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স খরচও কম হবার কথা না। হয়ত এখানে বসে এক ঘণ্টা অক্সিজেন দেবার চার্জ ধরবে ৫/১০ হাজার টাকা। তার ফেনা বের হওয়া বন্ধ এখন কিন্তু শ্বাসকষ্ট আগের মতো। কোনভাবে উঠে দাঁড়িয়ে রাস্তায় বের হল।

সুনসান রাস্তা। একটা রিকশা দরকার। নাই। একবার ইচ্ছা জাগলো বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের(?!) কাছ থেকে ধার টার করে বেসরকারি হাসপাতালে যাবার। শরীর ভরা বড় কষ্ট। ধার চাইলে বা চিকিৎসার টাকা সমস্যা না। সে যতই হোক। সমস্যা মারা গেলে এ ধার শোধ করার কেউ নাই। আর বেঁচে থাকলেও মোটা ধার শোধ কবে করতে পারবে তার কোন নিশ্চয়তা নাই। আদৌ পারবে কিনা তাও জানা নাই। গলা দিয়ে শাঁস টানার শিসের শব্দ হচ্ছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। শরীরে এ ভয়ঙ্কর কষ্ট না থাকলে এ রাস্তাটা সুন্দর লাগতো। হঠাৎ তার চোখে গাড়ির অসভ্য আলো এসে পড়লো। তার কষ্ট বেড়ে গেল। গাড়ির উপর লাল নীল লাইটের ঝলকানি তার চোখের বিভ্রম কিনা জানে না। সে যে জানে না তাও সে জানে না।

একজন সামনে এসে দাঁড়াল।
- আপনি অসুস্থ? অ্যাম্বুলেন্স আছে। যাবেন?
না সূচক মাথা নাড়ল । যদিও ইচ্ছা করছে উঠে শুয়ে পড়তে।
- আপনার তো মনে হয় অক্সিজেন জরুরি। চলেন কোন হাসপাতালে নিয়া যাই। অ্যাম্বুলেন্স চালাইতে চালাইতে আইডিয়া হই গেছে।
আবার না সূচক হাত নাড়ানো।
- আপনার তো অক্সিজেন লাগবে। সাথে কেউ নাই? অ্যাম্বুলেন্স অল্প অক্সিজেন আছে। আপনি আসেন।
- কত টাকা দিতে হবে?
- ড্রাইভার দিতে হবে না আসেন।
- না।
- আরে ভাই কত রোগী ফ্রি নিছি চলতি পথে।
- না।
- আপনি তো দেখি সিরিয়াস ঠেডা/ডেডা। মুখ দিয়ে ফেনা বের হইতেছে। দিয়েন। বেশি নাই। আর কই যাবেন?
পনর মিনিট পর অক্সিজেন শেষ। শরীরের কষ্ট একটু কম। কিন্তু অক্সিজেন দরকার আরও আরও।
- আপনি কই যাবেন। নামিয়ে দিয়া যাই।
- এখানে নামিয়ে দেন। কয় টাকা দিব?
- কিছু দিতে হবে না। দেখেন কোথায় কিছু ব্যবস্থা করতে পারেন কিনা। মালিক ফোন দিছে নাইলে আরও কিছুক্ষণ থাকতাম।
- ৫০০ টাকা দিলে হবে?
- কিছু দিতে হবে না। গাড়ি থেকে আপনারে দেখে বুঝছি অক্সিজেন দরকার। আমার সিলিন্ডারে কিছু ছিল। তাই থামছিলাম।
৫০০ টাকা রেখে সে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামল। ড্রাইভার, হেল্পারও নামল। কেন কে জানে। প্রায় মিনিট দশেক অ্যাম্বুলেন্সে বসতে দিল। এর মধ্যে মালিকের ফোন।

বেলা শেষে ‘মানুষই’ দাঁড়িয়েছে মানুষের পাশে।

বেলা শেষে একেবারেই সাধারণ মানুষ, অর্ধ শিক্ষিত, অশিক্ষিত মানুষ প্রমাণ করেছে তারা ‘মানুষ’।

জহিরুল হক বাপি, লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ