আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

কর্নেল তাহেরের ভূমিকা, বিতর্ক

জহিরুল হক বাপি  

মেজর আবু তাহের পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দেন। পালানোর চিন্তায় গর্ভবতী স্ত্রী লুৎফাকে তাহের আগেই দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানী সিনিয়র অফিসারদের সাথে কৌশল করে। নিজেও পালান প্রাণান্ত চেষ্টা করে। কলকাতা আসার পর তাহেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয় নতুন তৈরি হওয়া ১১ নম্বর সেক্টরের। কামালপুর যুদ্ধ/স্যাবোটাজের পর লে. কর্নেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন জেড ফোর্স ভেঙে দিয়ে সেই অঞ্চলেই গঠন করা হয় ১১ নম্বর সেক্টর।

১১ নম্বর সেক্টরকে মেজর তাহের অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যান। সম্ভবত ১৪ নভেম্বর তাহের ধনুয়া কামালপুর সম্মুখ যুদ্ধে তার পা হারান। হাঁটু থেকে পা আলগা হয়ে ঝুলে ছিল। আহত তাহেরের কাছে প্রথম পৌঁছান ফেলু মিয়া ও হামদু। দুই জনই তাহেরের কাছাকাছি যুদ্ধ করছিলেন। হামদু ছিলেন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। তাহেরকে প্রথম চিকিৎসা দেন ১১ নম্বর সেক্টরের ডা. প্রেমাঙ্কুর রায়। এই তিন জনই সপ্তাহ দুয়েক আয়ুর জেড ফোর্সেরও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

১৯৭৫ সালের নভেম্বরে গৃহবন্দি জিয়াউর রহমান কৌশলে তাহেরের কাছে প্রাণ বাঁচানোর জন্য সহযোগিতা চান। জিয়ার সাথে তাহেরের পুরনো সখ্যতা। ৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত জিয়াউর রহমান বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট পরিদর্শনে যেতেন কৌশলে অসন্তোষ সৃষ্টির জন্য। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিতেন ইংরেজি মেশানো উর্দুতে। ইংরেজির সে সব কী-পয়েন্ট লেখে দিতেন তাহের। তাহের অবশ্য জানতেন না জিয়াউর রহমান এগুলো কৌশলে অসন্তোষ সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করছেন। তাহেরের লক্ষ্য ছিল পিপলস আর্মি। সমাজতন্ত্র।

জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে প্রাণ বাঁচানোর আবেদন পাওয়ার সাথে সাথে তাহের সক্রিয় হয়ে উঠেন জিয়াকে বাঁচানোর জন্য। জাসদের সামরিক দুই শাখা গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে তাহের জিয়া উদ্ধারে নামান। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বড় অংশটা ছিল পাকিস্তানফেরত, পাকিস্তানপন্থী। মিলিট্যান্ট গ্রুপের দায়িত্ব আয়ত্ত করার সাথে সাথে তাহেরের লক্ষ্য ছিল সদস্য বাড়ানো, দল বড় করা। এমন না পাকিস্তানফেরত, পাকিস্তানপন্থীরা কৌশলে, পরিচয় গোপন করে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা বা গণবাহিনীতে ঢুকেছিল। জাসদ তখন মূলত হয়ে উঠে লে. কর্নেল আবু তাহের ও তাহেরের পরিবারের কৈশোরের স্বপ্ন পূরণের জায়গা।

৫ নভেম্বর খালেদের অভ্যুত্থানের বিপরীতে জাসদের পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি, পরিকল্পনা, অবস্থা, সাংগঠনিক ব্যবস্থা কিছুই ছিল না। জাসদ বলতে তখন তাহের ও তার পরিবার। জাসদ বলতে তখন কেবল গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। দুইটাই মিলিট্যান্ট গ্রুপ। জাসদের প্রতিষ্ঠাতারা, নেতারা নিজেরাও বুঝতে পারেননি জাসদ কখন তাদের শাখা দুইটা মিলিট্যান্ট গ্রুপে বিলীন হয়ে গেছে। যাইহোক, ৫ নভেম্বরের পর তাহের সুযোগে সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। তাহেরের লক্ষ্য ছিল জিয়ার হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তুলে দিয়ে প্যারালাল সরকার চালানো। জিয়াকে হাতের পুতুল বানানো।

তাহেরের ভাষায় এটা বিপ্লব। কিন্তু অবস্থা হল বিপ্লবীরা জানে না বিপ্লব হচ্ছে। নেতা কে? খালেদ মোশাররফদের সরিয়ে জিয়াকে মুক্ত করার পর কার নামে সশস্ত্র বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও গণবাহিনী স্লোগান দেবে এ নিয়ে সভা করে সিদ্ধান্ত নিতে জাসদের সময় ব্যয় করতে হয়েছে! যদি এটা বিপ্লব হয় তবে স্বাভাবিকভাবেই জয়ের পর বিপ্লবীদের স্লোগান দেবার কথা জাসদের সভাপতির নামে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাবার কথা জাসদের কোন নেতার।

এলিফ্যান্ট রোডের নোয়াখালী গলিতে কর্নেল তাহেরের বাসায় দীর্ঘ মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় জয়ের পর তারা একজন সেনা কর্মকর্তা যার সাথে গোপন বা প্রকাশ্য সমাজতন্ত্রের কোন সম্পর্ক ছিল না এবং একটি রাজনৈতিক দলের সামরিক শাখার প্রধানের নামে। বিষয়টা হাস্যকর, অযৌক্তিক, অনৈতিক হবার পরও সিদ্ধান্ত হয়ে ছিল জিয়া ও তাহেরের নামে স্লোগান হবে।

কর্নেল তাহের শেষ পর্যন্ত জিয়ার কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি চালাতে পারেননি স্বাভাবিক কারণেই। ক্যু, পাল্টা ক্যু চলছিল। যা করা উচিত জিয়াউর রহমান তাই করেছিলেন, তাহেরকে এড়িয়ে চলা থেকে শুরু করে। জিয়াউর রহমানের সাথে মৌখিক বা লিখিত কোনধরনের চুক্তি ছিল না তাহেরের। এমন না যে তাহের শর্ত দিয়েছিলেন জিয়া শর্ত ভঙ্গ করেছেন। জিয়া প্রাণ বাঁচানোর জন্য তাহেরের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন, আর কিছু না। জিয়াকে সেনাপ্রধান, রাষ্ট্রপতি বানিয়ে তাহেরের কথামত লেফট রাইট করাবে, সমাজতন্ত্র কায়েম করবে এগুলো ছিল তাহের ও তার পরিবারের একান্ত নিজস্ব ভাবনা। এমনকি এ ভাবনা জাসদেরও না। জিয়া একটু থিতু হবার পর তাহের ও জাসদকে জাসদের নিয়মেই দমাতে থাকেন।

তাহেরকে জিয়া জুডিশিয়াল কিল করেন নগ্নভাবে। যে অপরাধে তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয় তার সর্বোচ্চ সাজা ছিল ৭ বছর কারাদণ্ড। অথচ রায় হয় ফাঁসি। রায় হবার স্বল্প সময়ের মধ্যে তাহেরের ফাঁসি কার্যকর হয় এবং এর দু সপ্তাহ পর আইন সংশোধন করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন বেঈমানির ঘটনা নতুন না, আবার খুব বেশিও না।

তাহের হত্যার বিচার হয়নি। কিন্তু বিচারের দাবি উঠছে। আন্তরিক সমর্থন। তার সাথে ৭৬-এ কর্নেল তাহের খুন হবার আগে ৭৫ এর নভেম্বরের ৫-৭ তারিখ পর্যন্ত আরও কিছু খুন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ঘটনাগুলো ক্যান্টনমেন্টের। প্রায় সবাই মুক্তিযোদ্ধা অফিসার। ধর্ষণের শিকারও তাদের পরিবারও। অনেকে বেদম মার খান। ক্যু'র সাথে এদের দু'একজন ছাড়া কেউই জড়িত ছিলেন না। তারা খুন হন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও গণবাহিনীর হাতে। মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা ছিল টার্গেট। এসব খুনিরা যখন নৃশংসতা চালাচ্ছিল তখন কর্নেল তাহের দৃঢ় কণ্ঠে জিয়ার সাথে দেন দরবার করছিলেন পাকিস্তানফেরত সৈনিক অফিসারদের (প্রায় সবাই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য) পাকিস্তান বন্দিকালীন বেতন ভাতা নিয়ে। বি. খালেদও খুন হন। সেনাবাহিনীতে, বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা সেই শুরু। শুরুটা হলো যুদ্ধাহত একজন মুক্তিযোদ্ধা সামরিক কর্মকর্তার হাত ধরে।

৫-৭ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টে যতগুলো খুন হয় সব করেছে তাহেরের নেতৃত্বাধীন বাহিনী। তাহেরের নির্দেশে, পরিকল্পনায় মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলো ক্যান্টনমেন্টের ভিতর তছনছ শুরু করে। কোঁত ভেঙে অস্ত্র নিয়ে আসে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। সেই অস্ত্র যায় গণবাহিনীর হাতেও। ক্যান্টনমেন্টের ভিতর মুক্তিযোদ্ধা হত্যা ও নারী নিগ্রহের ঘটনার সাথে জড়িত সবার বিচার জরুরি। এই দায় কি জাসদ নেবে নাকি কর্নেল তাহের নেবেন তা আইন, রাষ্ট্রকেই ঠিক করতে হবে। তবে এ খুনগুলোর বিচার চাই।

এ খুনগুলো নিয়ে জাসদ, তাহেরের কখনও কোন আক্ষেপ দেখিনি। যেন কিছুই হয়নি। ৭৬-এ তাহের হত্যার বিচার হওয়া জরুরি। জরুরি ৮১-তে জিয়া হত্যার বিচার। তারও আগে জরুরি ৭৫-এ তাহেরের হাতে, কারণে, নেতৃত্বে খুন ও ধর্ষণের বিচার। সময়ের হিসাবে ৭৫-এর নভেম্বরের গণহত্যা আগে ঘটেছে। তাছাড়া বাকি তাহের ও জিয়া হত্যার সূতিকাগার ওই ৭৫-এর নভেম্বরেই।

জহিরুল হক বাপি, লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ