প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রহিম আব্দুর রহিম | ০১ আগস্ট, ২০২১
একসময় বায়ুবাহিত ভাইরাসজনিত ‘গুটিবসন্ত’ নামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মারা গেছে। কোন গ্রামে ওই রোগ দেখা দিলে গ্রামের পর গ্রামের মানুষ মরে সাবাড় হয়ে যেতো বলে শুনেছি। পানিবাহিত ‘ডায়রিয়া-কলেরা’ নামক রোগে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা শুধু শুনিনি, দেখেছিও। এখনও ‘জলবসন্ত’ এবং ‘চোখ ওঠা’ নামক ভাইরাসজনিত রোগ-ব্যাধিতে জনমানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। তবে তেমন না। আধুনিকতার পরম ছোঁয়া, উন্নত ধ্যান-ধারনায় চিকিৎসা সেবায় আমরা এখন নিরাপদ। ওই সময় ‘কলেরা’, ‘ডায়রিয়া’ মহামারি ঠেকানোর জন্য পানি ফুটিয়ে বা আক্রান্ত রোগীদের জন্য হাতে তৈরি ‘গুড়-লবণে’র স্যালাইন পান করাটাকে নিরামক হিসেবে গ্রামের সবাই গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করত। তখন মহামারি ঠেকাতে একসময় বিশুদ্ধ পানির জন্য টিউবওয়েল স্থাপনসহ আধুনিক প্রযুক্তি আমরা গ্রহণ করেছি, ফলে এখন আমরা নিরাপদ। কাল-কালান্তরে ‘রোগ-বালাই’ দুর্যোগ-মহামারির আবির্ভাব ঘটেছে। আবার তা থেকে বাঁচার জন্য উপায়ও বের হয়েছে।
জগৎ-পরিমণ্ডলের সকল দুঃসময় ঘিরে মানবজাতি পরিত্রাণের জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা চালিয়েছে। অন্ধকারে আলোর পথ খুঁজেছে। যে যুগে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না ওই যুগেও মানুষ মানুষকে জাগিয়ে তুলেছে। এখন আধুনিক যুগ, সেকেন্ডে তথ্য-উপাত্ত ‘উদঘাটন’ বা ‘সরবরাহ’ সম্ভব। এরপরও অন্ধকার কাটিয়ে আলোর পথ না পাওয়ার কারণ বহুবিধ। ‘রাজনৈতিক হেয়ালিপনা’, ‘অজ্ঞতা’, ‘একঘেয়েমি’, ‘অহংকার’, ‘হিংসা’, ‘কুসংস্কার’, ‘ধর্মীয় অন্ধত্ব’, ‘অশিক্ষা-কুশিক্ষা’। বিশ্ব এখন বৈশ্বিক ব্যাধি কোভিড-১৯ ‘করোনা’ নামক ‘মহামারি’ থেকে ‘অতিমারি’ সময় পার করছে। এই ‘মহামারি’ বা ‘অতিমারি’র হাত থেকে উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ বাদ যায়নি। বরং দেশটাতে অপরিকল্পিত প্রচারণা, বিশৃঙ্খল পরিকল্পনা, অতিউৎসাহীদের অতিকথন, গুটিকয়েক মিডিয়ার দায়িত্বজ্ঞানহীন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডই ‘গুদের ওপর ফোড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
গত ২৪ জুলাই একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের এক সংবাদকর্মী গবেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘যদি একদিন দেশের উৎপাদন বন্ধ থাকে, অর্থাৎ লকডাউন রাখা হয় তবে দেশের দৈনিক লোকসান ৩ হাজার ৩ শ’ কোটি টাকা।’ সে হিসেবে এবার দেশের ৫০ হাজার কোটি টাকা লোকসানের একটি লকডাউন চলছে। এর আগে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ‘ছোট’, ‘বড়’, ‘মাঝারি’ কয়েক কিস্তির লকডাউনে এদেশের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা অপূরণীয়। হাজার বছর পেছানোর ইতিহাস। যেখানে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত। আজ আমরা যে অবস্থার সম্মুখীন হয়েছি এর খেসারত বহন করতে হবে যুগ যুগ। এ থেকে পরিত্রাণের পথ উন্নয়নশীল এই দেশের জ্ঞানী-গুণী, বিশেষজ্ঞ, গবেষক, বুদ্ধিজীবীমহল আবিষ্কার করতে পারেনি। তবে চীনে আবিস্কৃত কোভিড-১৯ এর হাত থেকে রক্ষা পেতে সহজ পদ্ধতি ‘লকডাউন’ প্রেসক্রাইব সারা বিশ্ব গ্রহণ করেছে। অথচ এই লকডাউন করোনা প্রতিরোধের একমাত্র উপায় নয়। এটি একটি অনুটিপস, যা উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নের স্বার্থে এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। তবে উপায় কোনটি? এমন প্রশ্ন মাথায় রেখে প্রতিবেশী দেশ ভারতের ‘হিডকো’ নামক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিকল্প উপায় খুঁজে বের করেছেন। ‘এর মধ্যে করোনা প্রতিরোধে টিকা প্রদান, আক্রান্তদের পুষ্টিকর খাবার প্রদান এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের নিয়মিত শারীরিক ব্যায়ামে সম্পৃক্ত করা।’ সম্প্রতি ওই সংস্থার চেয়ারম্যান দেবাশীস সেন এক মিডিয়ায় দেয়া সাক্ষাৎকারে কথাগুলো বলেছেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ‘দুয়ারে ভ্যাক্সিন’ নামক প্রকল্প চালু করে বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। দেবাশীস সেনের ভাষায়, ‘একজন গাড়ির ড্রাইভার কিংবা একজন সবজি বিক্রেতা তার কর্ম ফেলে আমাদের কাছে আসলে তার ক্ষতি হবে, আমরা তা করতে চাই না। যে কারণেই আমরা তার কাছে চলে যাচ্ছি।’ তার এই বক্তব্য প্রমাণ করে, কোনভাবেই কর্ম, চলাচল প্রতিরোধ নয়, বরং বিকল্প পন্থায় করোনা ঠেকানোর যৌক্তিক পথ অবলম্বন।
একইভাবে আমাদের দেশের পরিকল্পনাবিদ ও পরামর্শকদের উচিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থের উপলব্ধি গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে আত্মনিয়োগ করা। ওই গ্রন্থের ৮৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, ‘গ্রামে গ্রামে দল বেঁধে ডাকাত ধরা শুরু হয়েছে। আর সরকার খুব তৎপর হয়ে গ্রামের লোকদের সাহায্য করছে। আস্তে আস্তে ডাকাতি অনেক কমে গেছে। এখনও মাঝে মাঝে ডাকাতি হয়, তবে খুব কম। এক কথায় জনগণকে সাহায্য করলেই সবকিছুই করা সম্ভব। শুধু জুলুম করে ও আইন করে এই সমস্ত অন্যায় কাজ বন্ধ করা যায় না। এর সাথে সুষ্ঠু কর্মপন্থার প্রয়োজন। চীন সরকার সেই দিকে নজর দিয়েছে বলে মনে হলো।’ বঙ্গবন্ধুর এই উপলব্ধিকে আমরা কাজে লাগাতে পেরেছি কি না?
আমাদের দুঃসময়ে লকডাউন কার্যকর করতে যে শ্রম, অর্থ, মেধা, সময় সরকার ব্যয় করছে, তা কতটুকু কাজে আসছে? এই অর্থ গণজাগরণ সৃষ্টিতে পরিকল্পিতভাবে ব্যয় করা হলে, একদিকে উন্নয়ন গতি সচল থাকতো, অন্যদিকে করোনা প্রতিরোধে জনমানুষ স্ব স্ব অবস্থান থেকে সচেষ্ট হতো। বঙ্গবন্ধুর এই গ্রন্থের ৯০ পৃষ্ঠায় বর্ণিত, ‘গরিবদের ৫ টাকায় ১ মণ পাট বিক্রি করে ৪ টাকায় ১ সের ডাল-তেল কিনতে হয় না তাদের দেশে। প্রত্যেক এলাকাতে সরকারি দোকান আছে, সে দোকানে সস্তায় সমস্ত জিনিস পাওয়া যায়। কোন দোকানদার ইচ্ছা করলেই বেশি দাম নিতে পারে না। কারণ, যদি লোকে জানতে পারে যে কোন দোকানদার বেশি দাম নিচ্ছে, তখন তারা সরকারি কর্মচারীদের খবর দিয়ে নিজেরাই ধরাইয়া দেয় এবং মিটিং করে ঠিক করে ঐ দোকানদারের দোকানে কেউ জিনিসপত্র কিনতে পারবে না। এতে চাষিদের যথেষ্ট উপকার হয়েছে। দেশের ভিতর গণজাগরণ এসেছে বলে এটা সম্ভবপর হয়েছে।’ প্রশ্ন, করোনাকালে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার উপর দীর্ঘ দেড় বছরেও কেনো গণজাগরণ সৃষ্টি করা গেল না। উত্তর সোজা-সাপটা, বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধি বা গবেষণা কেউ গ্রহণ করেনি বলেই নিজস্ব পরিকল্পনা নেই। ধার করা প্রেসক্রাইব গ্রহণ করতে হয়েছে। যা কিনা আওয়ামী লীগের মত প্রাচীন একটি সংগঠনের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের জন্য দুঃখজনক; গোটা জাতির জন্য যা হতাশাজনক; সরকারের জন্য বিব্রতকর অবস্থা।
করোনাকালেই আমরা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এর মত প্রবীণ নেতার মুখে শুনেছি, ‘আমরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী।’ ওই সময় তার বক্তব্য শুনে মনে হয়েছিল, এই অদৃশ্য করোনা অতিমারি প্রতিরোধে আওয়ামী লীগ প্রান্ত থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত গণজাগরণের একটি বৃহৎ কার্যক্রম শুরু করবে। দীর্ঘ সময়ে কিছুই হয়নি। বরং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের গুরুত্বহীন বক্তব্য শুনেছি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, ‘করোনা মোকাবেলা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ না, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ চিকিৎসা প্রদান।’ কি হাস্যকর বয়ান! তবে এ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ২৪ জুলাই কোভিড-১৯ সংক্রমণ সম্পর্কিত এক ভার্চুয়াল মিটিংয়ে বলেছেন, ‘২১ কোটি ভ্যাক্সিনের ব্যবস্থা হয়েছে। আগামী বছর পর্যন্ত সেগুলো পর্যায়ক্রমে দেশে আসবে।’ তার এই তথ্যে অন্ধকারে আলোর বিচ্ছুরণের আভাস। খালেদা জিয়া ভ্যাক্সিন গ্রহণ করার সংবাদটি প্রচার হবার পর প্রায় মানুষই খুশি হয়েছেন। তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ খালেদা জিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এই ধন্যবাদ ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ধরনের ইতিবাচক সংস্কৃতির প্রভাব উঁকি-ঝুঁকি দেওয়ার ধারনা মানুষের মাঝে সৃষ্টি হচ্ছিল। তবে তা টিকেনি। কারণ, সরকার দলীয় এক দায়িত্বশীল নেতা খালেদা জিয়ার ভ্যাক্সিন গ্রহণকে রাজনীতির বাঁকা চোখে দেখেছেন। ওই নেতা তিরস্কার করে বলেছেন, ‘খালেদা জিয়ার ভ্যাক্সিন গ্রহণ ‘নাকেখত’ দেওয়ার মত ঘটনা।’ জাতি এগুলো শুনতে চায় না, শুনতে চায়, ভারত থেকে ২০০ মেট্রিক টন তরল অক্সিজেন বাংলাদেশে পৌঁছেছে, লকডাউন ওঠে গেছে, স্বাস্থ্যবিধি সবাই মানছে, স্কুল-কলেজ চালু হয়েছে, পরীক্ষা হচ্ছে, অটো-পাস বিলুপ্ত হয়েছে, লকডাউনের নামে জরিমানা-গ্রেপ্তার বন্ধ ইত্যাদি।
জাতির ক্রান্তিলগ্নে পৃথিবীর সকল রাজনৈতিক ব্যক্তিদের যে অবদান তা অনস্বীকার্য। ‘অতিকথন’ সবসময় গ্রহণযোগ্য নয়। ২৩ জুলাই একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের এক সংবাদকর্মী খেঁটে খাওয়া, পায়ে হেঁটে পথচলা এক মহিলাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনি লকডাউনে ঢাকায় ফিরছেন কেনো?’ মহিলা উত্তর দিয়েছেন, ‘আজ লকডাউন তা তো জানি না।’ এমনটি কেন হবে? হিসেব অনুযায়ী সারা দেশে মোট গ্রাম ৮৭ হাজার ৩১৯টি। প্রত্যেক গ্রামের মসজিদে রয়েছেন একজন ইমাম, একজন খেদমতকারী। তারা কেন রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধান স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য নামাজিদের বলেনি। ধরে নিলাম তারা এটা বলতে রাজি নন, কারণ তাদের অনেকেই মনে করেন করোনা ‘আল্লাহর গজব’। সারাদেশের মোট ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়নের ওয়ার্ড সংখ্যা ৪১ হাজার ১৩৯টি। প্রত্যেক ওয়ার্ডে রয়েছেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, কৃষকলীগ, ছাত্রলীগের মত শক্তিশালী সংগঠনের একজন সভাপতি, একজন সাধারণ সম্পাদক। এতে করে প্রত্যেক ওয়ার্ডে ৮ জন করে রাজনৈতিক কর্মী থাকার পরও দেশে করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ক পরার মত গণজাগরণ সৃষ্টি করা কেন সম্ভব হচ্ছে না? প্রতিটি ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের সারা দেশে মোট ৩ লাখ ৭০ হাজার ২৫১ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি গণসচেতনতার কাজে না লাগিয়ে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলরা কেনো ঘন ঘন মিডিয়ায় বাণী ছাড়ছেন?
দেশের ক্রান্তিকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবসম্পদ ছাত্রসমাজ। অথচ এই ছাত্রসমাজ করোনা ইস্যুতে ঘরবন্দি থাকবে কেন? তাদেরকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণজাগরণে এবং দেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষায় সরকারি, বেসরকারি, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান ১ লাখ ৫১ হাজার ৬০৮টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাসেবীদের কেন গণজাগরণ সৃষ্টিতে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না?
‘লকডাউন’, ‘সাটডাউন’ বা ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ নয়, গণজাগরণ সৃষ্টি করতে ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনৈতিক প্লাটফর্ম পরিকল্পিতভাবে মাঠে নামতে পারলে বিশ্বে বাংলাদেশ, ‘মহামারি’, ‘অতিমারি’ প্রতিরোধে রোলমডেল হিসেবে স্থান পাবে। এতে কোন সন্দেহ নেই।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য