প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
এখলাসুর রহমান | ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১
সাম্প্রতিক আমলাদের বক্তব্য শুনলে মনে হয় না তারা প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক্ত কোন কর্মচারী। মনে হয় যেন তারা রাজা আর রাজনৈতিক দল ও জনগণ সবাই তাদের প্রজা। বরিশালের ইউএনও ইস্যুর পর জেলা প্রশাসকের ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দেশ জুড়ে আলোচিত হচ্ছে। তিনি ইউএনওর পক্ষ নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন রাজনীতিকদের। আমলাতন্ত্র নিয়ে ক্ষুরধার সমালোচনা করে কলাম লিখেছেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী। আমলাতন্ত্রের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা নিয়ে জাতীয় সংসদেও উত্তপ্ত আলোচনা হয়েছে।
ক্ষুব্ধ বক্তব্য দিয়েছেন বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাবেক রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ। তিনি একটি পত্রিকার সাক্ষাৎকারে বলেন, রাজনীতি এখন রাজনীতিবিদদের হাতে নেই৷ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেন, বঙ্গবন্ধু প্রকৃত রাজনীতিবিদদের বেছে বেছে মনোনয়ন দিয়েছেন৷ এক্ষেত্রে নিজের অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, যদি সত্তরের নির্বাচনের কথা চিন্তা করি, টাকা নেই, পয়সা নেই৷ বঙ্গবন্ধু ঘুরছেন গ্রামে গ্রামে৷ আমি ভোলার অতি সাধারণ একজন মানুষ-রাজনৈতিক কর্মী, তাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন৷ বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করে, মানুষের ভালোবাসা আদায় করে নির্বাচনে জিতিয়ে এনেছেন।
রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতে না থাকা নিঃসন্দেহে ভয়ের। টাকাওয়ালা অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও পুঁজিপতিরাই এখন বনে যাচ্ছে রাজনৈতিক। তাদের বেছে বেছেই মন্ত্রিত্ব ও মনোনয়ন দেয়া হচ্ছে। রাজনীতিকদের চেয়ে ক্ষমতার দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমলারা। বরিশালের জেলা প্রশাসক বলেন, তিনি ও ইউএনওরা প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধিত্ব করেন। আরও বলেন, আমরা ভেসে আসিনি। আমিও একসময় ছাত্রলীগ করতাম। সংগত কারণেই প্রশ্ন জাগে একজন আমলার কেন এই রাজনৈতিক পরিচয় দেয়া? এতে কি মানুষের মনে এমন ধারনা সৃষ্টি করতে চাওয়া নয় যে সরকার বেছে বেছে প্রশাসনের দপ্তরে দলীয় লোকদেরকেই বসিয়েছে? দলীয়করণ করেছে প্রশাসনকে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী কিভাবে হলেন। নিশ্চয়ই একটি দলের প্রধান ও জাতীয় সংসদের সাংসদ হিসাবে। দল ও জাতীয় সংসদ না থাকলে কি তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন? পারবেন এদেশের সকল আমলা তার পক্ষে থাকলেও? সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে এসব আমলারা ঘাপটি মেরে আছে। এদের কেউ বিএনপির রিক্রুট, কেউ জামায়াতের।
১৯৯১ সাল হতে ১৯৯৬ সাল ও ২০০১ হতে ২০০৬ সাল তারা স্তুতি করতো জিয়া ও বিএনপির এবং রাজাকার নিজামী ও জামায়াতের। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে এসব আমলারাই স্তুতি করতো ফখরুদ্দীন ও মঈন উ আহমেদের। আর এখন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। তবে এবারকার ক্ষমতার স্তুতির ধরন বদলেছে। এখন দলের নয় তারা স্তুতি করে দলের প্রধানের। দলীয় অন্যান্য নেতাদের তারা তেমন একটা পাত্তা দেন না। এমন নজির আমরা বরিশালে দেখেছি। ইউএনওর সাথে আওয়ামী লীগ নেতা ও মেয়রের দ্বন্দ্বে কোন সরকারি কর্মচারী পালায়নি আটকও হয়নি। কিন্তু সরকার দলের শতশত নেতাকর্মী পালিয়েছে। অনেকেই আটকও হয়েছে। আতঙ্ক ছিলো না আমলাদের মাঝে আতঙ্ক ছিলো কেবল সরকার দলের নেতাদের মাঝেই।
প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ ইস্যুতে জেলা প্রশাসকের সাথে ভিডিও কনফারেন্স করেন। কেন জেলাগুলোতে সরকার দলীয় নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা কি ছিলো না? নাকি তিনিও দল ও জনপ্রতিনিধিদের ভরসা না করে আমলাদেরই ভরসা করছেন? কারা বালিশ কাণ্ড, পর্দা কাণ্ড, বিদেশ ট্যুর কাণ্ডসহ নানা দুর্নীতিতে জড়িত। যারা একসময় বিএনপি ও জিয়া, ফখরুদ্দীন মঈন উদ্দিনের স্তুতিতে মুখে ফেনা উঠতও তারাই আজ বঙ্গবন্ধুর স্তুতিতে মুখে ফেনা তুলছে। আমলারা যেন বিটিভির মতো। যে দল ক্ষমতায় যায় তার নামেই জয়ধ্বনি দেয় তারা। বরিশালের যে ডিসি বললেন, তিনি ছাত্রলীগ করতেন। ক্ষমতার পালাবদল হলে কি তিনি তা বলবেন? কী বলতেন তিনি বিএনপি জামায়াত ও কথিত মাইনাস টু ফর্মুলার ওয়ান ইলেভেন সরকারের আমলে? একজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী কি এমন বক্তব্য দিতে পারেন? কী বলে সরকারি কর্মকর্তার আচরণবিধি?
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী জনপ্রতিনিধিদের পদমর্যাদা আমলাদের চেয়ে বেশি। প্রধানমন্ত্রী কেন প্রতি জেলার সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে ত্রাণ ইস্যুতে ভিডিও কনফারেন্স করতে ভরসা পেলেন না? খোদ প্রধানমন্ত্রীর এমন আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতা কি রাজনীতির জন্য অশনি সংকেত নয়? তোফায়েল আহমেদের মতো বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ যখন বলেন, রাজনীতি এখন রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য নিঃসন্দেহে তা ভয়ের। পাকিস্তানে ক্ষমতায় চলে গেল তেহরিক ইনসাফ নামের একটি সদ্য গজানো সংগঠন। যার নেতা ক্রিকেটার ইমরান খান। কিন্তু মূল ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিল ড. নজীবুল্লাহ আর মূল ক্ষমতা ছিল কমিউনিস্ট রাশিয়ার হাতে, দৃশ্যমান ক্ষমতায় ছিল হামিদ কারজাই ও আশরাফ ঘানি কিন্তু মূলে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পরনির্ভর ক্ষমতার পরিণতি যে ভাল হয় না। এর এমন বহু নজির রয়েছে। বাংলাদেশ পাকিস্তান আফগানিস্তানের মত দেশ নয়। এর রয়েছে সংগ্রামের ইতিহাস। দেশটির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ইতিহাস কী বলে? যারা একসময় বঙ্গবন্ধুর স্তুতি করতো তারাই আবার বঙ্গবন্ধুর খুনির শপথবাক্য পাঠ করালো? জনপ্রশাসন, পুলিশ সেনাবাহিনী চাকরি বাঁচাতে চলে গেল খুনি মোশতাকের পক্ষে। তখন কেউ কি বঙ্গবন্ধুর খুনের প্রতিবাদে চাকরি থেকে পদত্যাগ করেছিল। কেউ কি বলেছিল খুনি মোশতাকের অধীনে আমরা চাকরি করতে পারবো না। অর্ধেক আমলাও যদি পদত্যাগ করতো মুশতাক কি পারতো সরকার চালাতে?
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদ সংসদীয় দলের নেতা হিসাবে আজ প্রধানমন্ত্রী। আর দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের রয়েছে বিশাল কর্মী-বাহিনী। রয়েছে ১৪ দলীয় জোট। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের তেহরিক ইনসাফের মত দল নয়। এর নেতারা ইউনিয়ন পর্যায়েও দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে। এমন একটি দল থাকা সত্ত্বেও দলটির প্রধানকে কেন আমলানির্ভর হতে হলো? ১৯৮১ সালে যখন শেখ হাসিনা দেশে আসলেন তখন কি তাকে আমলারা বরণ করেছিল, নাকি দলীয় নেতাকর্মীরা? এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে কারা তার সঙ্গে ছিল? বিএনপি জামায়াতের শাসনামলে কারা তার সঙ্গে রাজপথে ছিল? ক্ষমতায় এলো বিএনপি। ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলা হলো শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে। তখন কোথায় ছিলও আমলারা? তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল নেতাকর্মীদের নিয়ে এক থানা হতে আরেক থানায় ঘুরেও একটি মামলা পর্যন্ত করতে পারলেন না। এই হামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সেদিন আমলারাই সৃষ্টি করেছিল জজ মিয়া নাটক। আর সেই আমলাদেরকেই আজ কেন নির্ভর করতে হচ্ছে আওয়ামী লীগ প্রধানকে?
কোথাও কোথাও আমলা ও সাবেক আমলাকে ঘিরে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে দল। যিনি আওয়ামী লীগেরই সদস্য নন। তার ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে হচ্ছে পোস্টিং। আমলা ও আমলাপত্নীর ব্যাগ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে দলীয় নেতারা। ডিসি, ইউএনও, পুলিশ সুপার বদলি হলে তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে দলীয় নেতারা। প্রেসক্লাবের সভাপতি হচ্ছেন ডিসি, ইউএনও। এগুলোও নিশ্চয়ই উপর মহলের আমলা তোষণ হতেই সংক্রমিত। তাদের স্যার না ডাকলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। দেশের মন্ত্রী ও সাংসদদের ভাই আপা ডাকা যায় কিন্তু ডিসি ইউএনওদের ডাকা যায় না। তাদের স্যার ডাকতে হয়। না ডাকলে ক্ষেপে ওঠে। সম্প্রতি ঘটে গেল আরও একটি জঘন্য ঘটনা।
এক যুবলীগ নেতা বঙ্গবন্ধুর স্মরণে কবি নির্মলেন্দু গুণের একটি কবিতা পোস্ট করেছিল। এতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা হয়ে গেল তার নামে। আটকও হয়ে গেল যুবক। এদিকে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দিয়ে ৫ মাস ধরে জেল খাটছে ঝুমন দাশ। বিনা দোষে ভুল আসামির জেল খাটার ঘটনাও ঘটছে। কেন এসব মামলা সত্যতা যাচাই না করেই তারা গ্রহণ করলো? তারা যাকে তাকে অপরাধী বানাতে পারে যাকে তাকে নির্দোষ। মুনিয়া আত্মহত্যা করল। অভিযুক্ত হল একজন শিল্পপতি। তাকে বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। কিন্তু আটক হল না। উল্টো ডিএনএ টেস্ট ছাড়াই শিল্পপতিকে দায়মুক্ত করা হল। তারা ইচ্ছে হলে কারও মামলা নেয় কারও মামলা নেয় না। যেমন নূসরাতের মামলা নিতে চায়নি। উল্টো নূসরাতকেই ফাঁসাতে চেয়েছে। টেকনাফের এক নিরপরাধ কমিশনার ও আরেক নিরপরাধ মেজর সিনহাকে ক্রসফায়ার দিয়ে মেরে ফেলেছে তারা। এখন পুলিশের বিরুদ্ধে মাফিয়া হয়ে ওঠার অভিযোগও উঠছে। ভারতে পুলিশের একজন এসআইয়ের আটক হওয়ার খবর বেরিয়েছে পত্রিকায়।
সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে, গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান ই–অরেঞ্জের সঙ্গে সম্পৃক্ত পুলিশ সদস্য (পরিদর্শক, তদন্ত, বনানী থানা) সোহেল রানাকে ভারত-নেপাল সীমান্ত এলাকা থেকে আটক করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার চ্যাংড়াবান্দা সীমান্ত থেকে অনুপ্রবেশের অভিযোগে আটক হন তিনি। এতে কি দেশ ও দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হবে না? প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হয়ে তিনি কিভাবে ব্যবসায় সম্পৃক্ত হতে পারলেন? এ বিষয়টা কি তার ডিপার্টমেন্টের অজানা ছিল? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠির নির্দেশনাও মানছেন না পুলিশ প্রশাসন। চিঠিতে বলা হয় পুলিশ সুপারেরা সকল মামলার বিবরণ জেলা প্রশাসককে অবহিত করবে। পুলিশ সুপাররা এটা করবে না বলে মত প্রকাশ করেছে। এখন কী করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই চিঠির নির্দেশনা বাতিল করতে কি পাল্টা আরেকটি চিঠি দেবে। দেখা যাক কি হয়। সময়ের অপেক্ষা।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য