আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

‘সীমা লঙ্ঘন’ ও কতিপয় চিন্তাপ্রতিবন্ধি

কবির য়াহমদ  

অপরাধীদের এবং তাদের তাদের পরিবারের প্রতি মানুষের কেমন জানি অস্বাভাবিক এক ধরণের আকর্ষণ থাকে। একজন অপরাধীর মিথ্যাচারে মানুষ খুব সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে যায়, যার সাম্প্রতিক প্রমাণ অভিজিৎ রায় ও অনন্ত বিজয় দাশ হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিন জঙ্গির পরিবার ও তাদের আইনজীবিদের বক্তব্য পরবর্তী কিছু প্রতিক্রিয়া।

জঙ্গি তৌহিদ মে মাস ধরে নিখোঁজ রয়েছে এটা তার আইনজীবি ও পরিবারের দাবি। এ দাবিকে জোরালো করতে আরও কিছু আলামত আছে, থানায় জিডি আছে এবং তৌহিদ নাকি মানসিক ভারসাম্যহীন। মানসিক ভারসাম্যহীনতার জবাব আদালত রিমাণ্ডে নেওয়ার দিনের শুনানিতেই দিয়েছিলেন। আদালত বলেছিলেন- তৌহিদ মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন এটার জন্যে আপনি মামলা করতে পারেন এবং সেখানে আপনি নিজেও সাক্ষী হিসেবে থাকবেন, আমি বিষয়টি দেখব। এরপর আদালতেই সে আইনজীবি তার সে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এক্ষেত্রে এটা প্রমাণ হয় এসব স্রেফ অজুহাত- অপরাধীদের অপরাধকে আড়াল করতে।

উল্লেখ্য, মো. তৌহিদুর রহমান, সাদেক আলী মিঠু ও আমিনুল মল্লিক। এদের মধ্যে তৌহিদুর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক, যাদেরকে ব্লগার অভিজিৎ রায় ও অনন্ত বিজয় দাশ হত্যাকাণ্ডের অন্যতম পরিকল্পনাকারী বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

১৮ আগস্ট তাদেরকে গ্রেফতারের পর র‍্যাব বলেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় একুশে বই মেলায় ব্লগার অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডে মোট পাঁচ জনের একটি দল অংশ নিয়েছিল এবং আড়াই মাস পর তারাই সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাসকে হত্যা করে। এবং সিলেট থেকে মান্নান রাহী এবং রাহীর ভাইকে গ্রেফতারের পর ঢাকায় আটক এদেরকেও শ্যোন এরেস্ট দেখানো হয়। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত অনুযায়ি এরা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

জঙ্গি তৌহিদুর রহমানের নিখোঁজ সংক্রান্ত জিডিকে সামনে নিয়ে এসে অনলাইনবাসী অনেকেই বলতে চায় এটা সরকারের একটা নাটক। যারা এমন ভাবছে তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে- অভিযুক্তরা ধরা পড়লে ত অনলাইনের প্রতিবাদ শেষ। আমি নিশ্চিত না এরা আদৌ জঙ্গি-খুনী নির্মূল হোক তা চাইছে কী-না? সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বিচার চাইলে কেউ এভাবে তুচ্ছ বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে- এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। অতিবিপ্লবি মানসিকতাকে এক্ষেত্রে দায়ি করব কিছুটা, তবে আমার ধারণা মানসিকভাবে ম্যাচিউর হলে এ প্রবণতা কমে আসবে!

একটা পরিবার তাদের সদস্যের ‘নিখোঁজের’ পর থানায় জিডি করতেই পারে। আর যারা জঙ্গিবাদে দীক্ষা নিয়েছে তাদের কাছে নাস্তিক খুনই যেখানে এবাদতের পর্যায়ে সেখানে তাদের পক্ষে পরিবারের বাঁধন ছিন্ন করাটাই স্বাভাবিক। নষ্ট হয়ে যাওয়া এ মানুষগুলো নিজেরা পরিবারের প্রতি আকর্ষণ বোধ না করলেও তাদের পরিবার ঠিকই করে- সে হিসেবে তারা থানা-পুলিশের কাছে যেতে পারে, লিখিতভাবে তাদের কথাগুলো জানাতে পারে- আইনী প্রক্রিয়ায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হিসেবে সেটা লিপিবদ্ধ হতেই পারে। এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, খুনীদের পরিবার হয়ত এটা করতে পারে। কিন্তু আমরা যখন খুনের বিচার চাইছি তখন খুব ছোট্ট এসব বিষয়টিকে কেন বড় করে দেখছি- সেটা ভেবে কুল পাইনা! এটা কি তবে কেবল প্রশাসন আর সরকার বিরোধিতা- তুমি যা-ই করো সেটা শুদ্ধ নয়, সেটা সিদ্ধ নয়!

আদালতে জঙ্গি তৌহিদের আইনজীবি বলেছিল- তার মক্কেল রাস্তাঘাটে বিভিন্ন জায়গায় দ্বীন  আর নামাজের দাওয়াত দিতো। ধর্মকে সামনে নিয়ে এসে অতিরিক্ত ফায়দা হাসিলের এটা পুরনো কৌশল, আদালত এ ফাঁদে পা দেননি কিন্তু আমাদের কতিপয় লোক দিচ্ছে। আশঙ্কার কথা যারা এটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে তাদের অনেকেই আবার নিজেদেরকে ধর্মরীতির বিরোধী বলে দাবি করেন।

ধরে নিলাম জঙ্গি তৌহিদ গত মে মাস থেকে বাসায় অনুপস্থিত, তিনি রাস্তায় রাস্তায় মানুষজনদের দ্বীনের, নামাজের দাওয়াত দিচ্ছেন। হতে পারে তিনি তাবলীগের সাথী, কারণ এখন একমাত্র স্বীকৃত দল হিসেবে তাবলীগকারীরাই রাস্তাঘাটে, বাড়িতে-বাড়িতে গিয়ে এরকম দাওয়াত দিয়ে থাকে। তাবলীগের একজন সাথী হিসেবে হতে পারে তিনি ‘তিন চিল্লা’র জন্যে বাড়ি ছেড়েছিলেন। তিন চিল্লা মানে ১২০দিন, প্রতি ৪০দিনে এক চিল্লা হিসাব করে থাকেন তাবলীগের মুরুব্বীরা। এর বেশিও অনেকে যায়। সে হিসেবে তৌহিদ বাড়ি ছাড়ার পর আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তাবলীগ এবাদত আর তাদের মানসিকতার নাস্তিক খুনের এবাদতের এ দুইয়ের মধ্যে তৌহিদ দ্বিতীয়টিকেই বেছে নিতে পারেন, যেহেতু তার টাকা আছে সেহেতু তিনি সেখানে ‘দান’ করে নেক্বী হাসিল করেছেন, নিজে সময় দিয়ে তাবলীগি ভাষায় শারিরীক এবাদতও সম্পন্ন করেছেন।

তাবলীগ এবং বাড়ি বাইরে থাকার এ ঘটনা স্রেফ অনুমাননির্ভর কারণ এখানে ‘নিখোঁজ’ হিসেবে থানায় জিডি’র কথা এসেছে মানসিক ভারসাম্যহীন কিংবা পাগলের বিষয়টি আদালত সেদিনই নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন বলে এটা আর গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়!

তৌহিদসহ অপর দুই জঙ্গি আটক, রিমাণ্ড এবং তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। গুরুত্বপূর্ণ মনে করি আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমি প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুর ভাতিজা সাদমান ও মাসুদ রানার গ্রেফতার। এখন বাকি খুনীদের ধরে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা জরুরি। একই সঙ্গে জরুরি পুলিশের মহাপরিদর্শক, আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি-মন্ত্রী, আওয়ামীপন্থী সাংস্কৃতিক নেতাদের মেঠো বক্তৃতা না দিয়ে বাস্তবতাকে অনুধাবণ করে বক্তব্য প্রদান। কারণ তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে যে ভুল বার্তা যাচ্ছে এর মাধ্যমে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে যে উঠবে না সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, যখন মুক্তচিন্তার মানুষ তথা মুক্তচিন্তার ব্লগারেরা ধর্মীয় মৌলবাদী কর্তৃক জীবননাশের হুমকির মুখে এবং একের পর এক ব্লগার হত্যা হচ্ছে তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী, সরকারের মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে আশ্বস্ত হওয়ার মতো বক্তব্য শুনতে আগ্রহী তখন উলটো পথে হাঁটলেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি)।

৯ আগস্ট রোববার বিকেলে পুলিশ সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মুক্তমনা ব্লগারদের 'সীমা লঙ্ঘন' না করার পরামর্শ দেন আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক। তিনি বলেন, এমন কিছু লিখবেন না, যাতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। আমাদের দেশে প্রচলিত আইনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার সাজা ১৪ বছর জেল। তবে কেউ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করলে তাকে মেরে ফেলা হবে, তা-ও মানা যায় না। [সমকাল ১০ আগস্ট, ২০১৫]।

আইজিপি যখন এ নসিহত প্রদান করছিলেন তখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে এক কথায় ভয়াবহ হিসেবেই বর্ণনা করা যায়। কারণ এ সময়ে ছয় মাসের ব্যবধানে চার ব্লগার হত্যাকাণ্ডের কোনোটারই কার্যকর সুরাহা করতে ব্যর্থ পুলিশ প্রশাসন। ব্লগারদের হত্যাকাণ্ডে পুলিশের ব্যর্থতার প্রমাণ রয়েছে, একই সঙ্গে আশঙ্কার কথা হচ্ছে ব্লগারেরা নিরাপত্তার জন্যে থানার দ্বারস্থ হলেও থানা পুলিশের কর্মকর্তারা সে বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেওয়া ত দূরের কথা সে ব্লগারকে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এমন ঘটেছে খুন হয়ে যাওয়া ব্লগার নিলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় ওরফে নিলয় নীলের ক্ষেত্রে। রাজধানীর খিলগাঁও থানায় নিলয় নীল সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গেলে পুলিশ সে জিডি গ্রহণ করা হয়নি এবং অপেশাদার আচরণের মাধ্যমে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল একজন পুলিশ কর্মকর্তা।

আহমেদ রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ এবং নিলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় নীল- এ পাঁচ হত্যাকাণ্ডের সবগুলোই ইসলামিস্ট মৌলবাদীদের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়েছে। খুনীরা হত্যা পরবর্তী সময়ে এসব খুনের দায় স্বীকার করলেও পুলিশী ব্যর্থতায় জঙ্গিদের মূলোৎপাটন করা সম্ভব হয়নি। তবু পুলিশ প্রশাসন এবং সরকারী দলের লোকেরা সব সময়েই দেশে জঙ্গি নেই এমন দাবি করে থাকে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখের দাবি রাখে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর জোট সরকারের আমলে বাংলা ভাই, জেএমবি নামে কিছু নাই, এগুলো মিডিয়ার সৃষ্টি বলে দাবি করা হয়েছিল। যাদের অস্তিত্ব নাই বলে দাবি করা হয়েছিল তারা সারাদেশে ৬৩ জেলায় একযোগে ৫০০ বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। প্রথমে জঙ্গিদের অস্তিত্ব নাই বলে দাবি করে এবং বিভিন্ন প্রকার সুযোগ-সুবিধা দিলেও সে সরকারের সময়েই বাংলাভাইকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। একই অবস্থা হয়েছে আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে তারাও জঙ্গি নাই, জঙ্গি নাই, জঙ্গিদের নির্মূল করা হয়েছে এমন দাবি করলেও ভেতরে ভেতরে ঠিকই এর অস্তিত্ব অনুভব করছে এবং মাঝেমধ্যে এর বিরুদ্ধে অভিযানে যাচ্ছে।

মুক্তচিন্তার ব্লগারেরা যখন নিজেদের নিরাপত্তায় উদ্বিগ্ন তখন আইজিপি শহীদুল হকের লেখালেখির ক্ষেত্রে বিশেষত ধর্মীয় বিষয়ক লেখালেখির ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘন না করার পরামর্শ দিলেও তার বক্তব্যে প্রধানত ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে লেখালেখি না করার কথাই বলেছেন। একটা সুস্থ রাষ্ট্রের, প্রজাতন্ত্রের সুস্থ কোন কর্মচারী যখন একটা ধর্মকেই নির্দিষ্ট করে বক্তব্য দেন তখন আদতে তাদের চিন্তার দীনতা প্রকাশ হয়ে যায়। কারণ বাংলাদেশ কোন ধর্মরাষ্ট্র নয় যে একটা ধর্মই সেখানে সর্বেসর্বা। ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার- এ বক্তব্য দিয়ে থাকেন সরকারের মন্ত্রী, এমপিরা কিন্তু যখন কোন ধর্মের স্বার্থ রক্ষার প্রসঙ্গ আসে তখন সেটা একটা ধর্ম তথা ইসলাম ধর্মেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।

বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী দেশ, জনগণই এখানে মূখ্য। এ কারণে সব মানুষের সমান অধিকার এখানে সংরক্ষিত। যদি ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রসঙ্গ আসে তাহলে সব ধর্মের মানুষের অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে হবে। যারা একটা ধর্মে বিশ্বাস করে তাদের বিশ্বাসে তাদের নিজস্ব ধর্মই সেরা। ধর্ম হিসেবে তারা সেরা ধর্মকেই বেছে নিয়েছে বলে জ্ঞান করে। ইসলাম ধর্মের মানুষেরা মনে করে পৃথিবীর সব ধর্মের মধ্যে তাদের ধর্মই সেরা ধর্ম। একইভাবে হিন্দুরা তাদের ধর্মকে, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানেরাও তাদের ধর্মকে পৃথিবীর শ্রেষ্ট ধর্ম মনে করে। ফলে মানুষের এ বিশ্বাসের প্রতি সম্মান রেখে সব ধর্মের মানুষদের প্রতি সমান চোখে দেখা উচিত।

সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যখন ধর্মের প্রতি কটূক্তি না করার, ধর্মকে কটূক্তি করে লেখালেখি না করার পরামর্শ দেন তখন তা আদতে মুসলমানদের ইসলাম ধর্মকেই নির্দেশ করেন। কারণ সারাদেশে সারা বছর চলমান ওয়াজ-মাহফিলে মোল্লা-মুন্সী-মাওলানারা অন্য ধর্ম বিশেষ করে হিন্দু ধর্মকে উদ্দেশ করে যেভাবে বক্তব্য প্রদান করেন সেটা তারাও জানেন কিন্তু সেটাকে ধর্মের প্রতি কটূক্তি হিসেবে দেখতে রাজি নন। অন্য অনেক মানুষের মতো  তাদের কাছেও ধর্ম মানে ইসলাম ধর্ম আর অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা পরিচিত হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্ট্রান কিংবা অন্যান্য নামে।

গত কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা বার্তা খুব প্রচার হচ্ছে, যেখানে বলা হয়েছে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৭৩০ কোটি। এর মধ্যে খ্রিষ্টান ২২০ কোটি, মুসলিম ১৬০ কোটি, হিন্দু ১০০ কোটি, বৌদ্ধ ৪০ কোটি এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মিলিয়ে ২১০ কোটি। অর্থাৎ ৫১০ কোটি মানুষদের মাঝে খ্রিষ্ট ধর্ম, ৫৭০ কোটি মানুষদের মাঝে মুসলিমদের ইসলাম ধর্ম, ৬৩০ কোটি মানুষদের মাঝে হিন্দু ধর্ম, ৬৯০ কোটি মানুষদের মাঝে বৌদ্ধ ধর্মের গ্রহণযোগ্যতা নাই। ফলে বলা যায় একক কোন ধর্মই সংখ্যাগরিষ্ট নয়। পৃথিবীর যত ধর্ম আছে এবং তাদের ধর্মের বিশ্বাসীদের চাইতে সে ধর্মের প্রতি অবিশ্বাসীরাই বেশি। ফলে ধর্মকে সার্বজনীন কোন সত্ত্বা হিসেবে কেউ প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। হ্যাঁ, এখানে উল্লেখিত পরিসংখ্যান হয়ত শতভাগ সত্য নয় কিন্তু দৃশ্যমান যুক্তিকে অস্বীকার করার উপায় নাই।

এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, এ পৃথিবীতে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষই নেই যে প্রকৃত অর্থে ধর্মে বিশ্বাস করে। পৃথিবীতে যে ক’টি ধর্ম আছে সে ধর্মের মানুষগুলো নিজেদের ধর্মকেই শ্রেষ্ট ধর্ম হিসেবে মনে করে। এটাকে আমি দোষের কিছু দেখছি না। কোন নির্দিষ্ট ধর্মে কেউ বিশ্বাস করতেই পারে আবার ধর্মে অবিশ্বাসও করতে পারে।  ধর্মে বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের জন্যে কেউ বাধ্য না, এটা একান্ত ব্যক্তিগত। এক ধর্মে বিশ্বাস মানে অপর অনেক ধর্মে অবিশ্বাস- এক্ষেত্রে বলা যায় স্বঘোষিত ধার্মিক কিংবা বিশ্বাসীরাই প্রকৃত অর্থে সামগ্রিকভাবে বড় ধরণের অবিশ্বাসী বিশেষত অন্য ধর্মকে অবিশ্বাস করার কারণে।

একজন মানুষ যখন এক ধর্মে বিশ্বাস করল তখন অন্য অনেক ধর্মে সে অবিশ্বাস করল। ফলে প্রকৃতপক্ষে সে ধর্মবিশ্বাসি কেউ নয়; হতে পারে আংশিক বিশ্বাসি। এই আংশিক বিশ্বাস সার্বজনীন কিছু ন!  

এক্ষেত্রে স্বঘোষিত নাস্তিকগণ ব্যতিক্রম। তারা পৃথিবীর সব ধর্মের প্রতি সমানভাবে অবিশ্বাসী। একজন লোক অন্য লোককে নাস্তিক বলে ঘোষণা কিংবা অভিহিত করলে নাস্তিক হয় না। যিনি নাস্তিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন তাঁকে নিজ থেকে নিজেকে নাস্তিক ঘোষণা করতে হবে এবং একই সঙ্গে পৃথিবীর সব ধর্মের প্রতি অবিশ্বাসকে অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। এক ধর্মের প্রতি অবিশ্বাস থেকে সৃষ্ট বিদ্বেষ প্রকাশ আর ভেতরে ভেতরে অন্য ধর্মের প্রতি প্রেম কোনভাবেই নাস্তিকতা হতে পারে না।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মীয় স্বাধীনতা বলতে ইসলাম ধর্মের স্বাধীনতা হিসেবে মনে করে। প্রজাতন্ত্রের উচ্চশিক্ষিত কর্মচারি হয়েও আইজিপি এই চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি। তিনি লেখালেখির ক্ষেত্রে সীমারেখা স্থাপন করে দিয়েছেন কিন্তু সীমার পরিধি কতখানি সেটা বলে দেননি। তাই ধরেই নেওয়া যায় এটা প্রধানত নির্ভর করবে যিনি যখন আইন প্রয়োগ করবেন এবং আইন প্রয়োগের পর যিনি শাস্তি নির্ধারণ করে দেবেন তার ওপর।

বাক স্বাধীনতা, লেখালেখির স্বাধীনতা বিষয়ে বিখ্যাত লেখক, মনীষিদের উদ্ধৃত করতে চাইনা। একজন সাধারণ মানুষের সাধারণ চিন্তাকে উল্লেখ করলে বলা যায়- স্বাধীনতা তাদের দরকার যারা স্বাধীনতা চায়। বোবার জন্যে কথা বলার স্বাধীনতা থাকা মূল্যহীন। মুক্তভাবে যারা চিন্তা করতে জানে তাদের দরকার সে পরিবেশ, প্রকাশ উপযোগী।

নিয়মবদ্ধ জীবন কিংবা ব্যাকরণগত চিন্তা যাদের সহজাত তাদের কাছে বাক স্বাধীনতা, চিন্তা আর প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা আর না থাকা দুটোই সমান। চিন্তার দীনতার কারণে "থিংক আউট অব বক্স" বাক্যটা স্রেফ একটা বাক্যই। এর বাইরে কেন আর কী এ দুই শব্দ যারা উচ্চারণ করতে জানে তাদের জন্যে দরকার স্বাধীনতা; বাক আর প্রকাশের স্বাধীনতা!

বাংলাদেশে বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম ও ব্লগে লেখালেখি যারা করেন তারা আউট অব বক্স চিন্তা করার সামর্থ রাখেন বলেই প্রমাণিত। কিন্তু এটা প্রকাশ করতে গিয়ে যখন রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ ও মন-মর্জিগত সীমারেখা স্থাপন করে দেওয়া হয় তখন সেটাকে অনাকাঙ্ক্ষিত বলতেই হয়।

পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) যখন ব্লগারদের লেখালেখির ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘন না করার পরামর্শ দেন এবং এরপর পরই যখন সরকারের মন্ত্রীরা আইজিপির সুরে সুর মিলিয়ে একই বক্তব্য প্রদান করেন তখন তা  আদতে এ সমাজে জঙ্গিদের উৎসাহ দেবে। কারণ একটা শ্রেণির মানুষ বেড়ে ওঠছে ভিন্নমতকে জবাই করে দিয়ে স্তব্ধ করে দিতে। এরা জঙ্গি, মৌলবাদী; সন্দেহ নেই।

জঙ্গিরা এমনিতেই চিন্তাপ্রতিবন্ধি। এই চিন্তাপ্রতিবন্ধিরা যখন দেখবে প্রশাসন, সরকার এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তি আর তাদের মধ্যে চিন্তার ক্ষেত্রে খুব বেশি ব্যবধান নেই তখন তারা ফি-বার ঝাঁপিয়ে পড়বে। এমন হতে থাকলে তাদের কাছে মনে হবে মুক্তচিন্তার মানুষ কোপালেও সমস্যা নাই কারণ এক্ষেত্রে উপরে আছেন আল্লাহ আর নীচে আছেন সরকার! এই বার্তাকে প্রতিষ্ঠিত করা হবে ভয়াবহ এক ব্যাপার।

আশঙ্কার কথা, আমরা এই ভয়াবহতাকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে লালন করতে বসেছি!

কবির য়াহমদ, প্রধান সম্পাদক, সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর; ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ