আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

সাম্প্রদায়িক হামলার ‘আদুরে নাম’ দাঙ্গা

ফরিদ আহমেদ  

বাংলাদেশ অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক হামলা নতুন কিছু নয়। আমরা এগুলোকে আদর করে দাঙ্গা বলি। আসলে এগুলো দাঙ্গা-টাঙ্গা কিছু নয়। দাঙ্গা হবার জন্য দু'টো পক্ষকে সশস্ত্র হতে হয়, মারামারি, কাটাকাটি করা লাগে একে অপরের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে, সেগুলোতে মূলত এক পক্ষের লোকেরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অন্যপক্ষকে মার দিয়ে গিয়েছে এক তরফাভাবে। কারণ, এখানে একটা পক্ষ অতি শক্তিশালী, আর অন্য পক্ষটা বড়ই দুর্বল। কাজেই, এগুলোকে দাঙ্গা বললে দাঙ্গা শব্দটাকে অপমান করা হয়। ন্যক্কারজনক সাম্প্রদায়িক হামলা হিসাবে চিহ্নিত করা উচিত এগুলোকে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে দুর্বলের উপর আস্ফালনকে এর চেয়ে ভালো কোনো নামে ডাকা উচিত না।

এ রকমই এক সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটেছিলো ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে। হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়, হত্যা করা হয় তাদেরকে। ভয়ে আতঙ্কে পালাতে থাকা হিন্দুদের বাস-ট্রেন থেকে নামিয়ে আক্রমণ চালানো হয় তাদের উপর। ধর্ষণ করা হয় হিন্দু মেয়েদের। ভয়াবহ এই আক্রমণের সামনে দাঁড়াতে না পেরে দলে দলে হিন্দু পালাতে থাকে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে। পিছনে ফেলে রেখে যায় তাদের সমস্ত সহায় সম্পত্তি। জান নিয়ে পালানোটাই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। সম্পদের হিসাব কে রাখতে যাবে। সেই সময়ে বাংলাদেশ অঞ্চল বা পূর্ব পাকিস্তানে একমাত্র খুলনা জেলাতে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। সাম্প্রদায়িক  এই এক আক্রমণের ধাক্কাতে সেটাতেও সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে পড়ে তারা। শুধু হিন্দুরা না, ভয়ের চোটে অন্য ধর্মের লোকেরাও পালিয়ে যায় এই অঞ্চল থেকে। আসামে পঁয়ত্রিশ হাজার খ্রিষ্টান আশ্রয় নিয়েছিলো জান বাঁচানোর তাগিদে।

এরকম একটা ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হবার জন্য নিশ্চিতভাবেই অনেক বড় অপরাধ করা লাগে। বড় ধরনের অপরাধ ছাড়া শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারী নিশ্চয়ই কাউকে আক্রমণ করার কথা না। বাংলাদেশের হিন্দুদের অপরাধ কি ছিল জানেন? কাশ্মীরে একটা মসজিদ আছে। সেটার নাম হচ্ছে হজরতবাল মসজিদ। এই মসজিদে হজরতের চুল রাখা আছে বলে দাবি করা হয়। যে কারণে এর নাম হজরতবাল মসজিদ। তো, সেই মসজিদ থেকে কে বা কারা যেনো সেই চুল চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলো। পূর্ব বাংলার হিন্দুদের পক্ষে ভারতবর্ষে ঢুকে তার অন্য প্রান্তে গিয়ে হজরতবাল মসজিদ থেকে চুল চুরি করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাতে কী? হজরতের চুল চুরি গেছে, কাজেই কাউকে না কাউকে তার দায় চুকাতেই হবে। শান্তির ধর্ম কাউকে শায়েস্তা করার ক্ষেত্রে কোনো কার্পণ্য  করে না। ভারতের মসজিদের এই ঘটনা নিয়ে ওখানে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে প্রথমে দাঙ্গা শুরু হয়। সেটার জের এসে পড়ে আমাদের অঞ্চলেও। নিজের দেশের হিন্দুর চেয়েও ভিন দেশের মুসলমান অনেক আপন। কাজেই ভারতের মুসলিমদের উপর হিন্দুদের আক্রমণের পালটা হিসাবে এখানে হিন্দুদের উপরে সহিংস আক্রমণ শুরু হয়।  

এই আক্রমণে মূল ভূমিকা রেখেছিলো বিহারিরা। তবে, বাঙালি মুসলমানরাও যে জড়িত ছিল না, তা কিন্তু নয়।

এই সময়কার একটা ঘটনা 'Mujib - The Architect of Bangla Desh' বইতে লেখা আছে। বইটা লিখেছেন যতীন্দ্র ভাটনগর। প্রকাশ হয়েছে ১৯৭১ সালে।

কাশ্মিরের হজরতবাল মসজিদে রাখা হজরত মুহাম্মদের চুল হারানোর জের ধরে ভয়াবহ জাতিগত দাঙ্গা শুরু হয়ে গিয়েছে। ঢাকার জয়কালী মন্দির রোডের এক বাড়িতে একদল হিন্দু আটকা পড়ে গিয়েছিলো। প্রায় দেড়শজন নারী-পুরুষ এবং শিশু ছিল সেখানে। এদের ঘিরে ফেলেছিলো বিহারি এবং মুসলমান বাঙালিরা।  সিরাজ নামের বিশ-একুশ বছর বয়সের এক দুঃসাহসী বাঙালি তরুণ একাই এই বিপুল সংখ্যক লোককে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলো। একটামাত্র আগ্নেয়াস্ত্র সম্বল ছিল তার। এই দিয়েই সারাদিন সে ঠেকিয়ে রেখেছিলো রক্ত-পিপাসু  গুণ্ডাদের।

গুলি চালাতে চালাতে সন্ধ্যার দিকে গুলি শেষ হয়ে যায় সিরাজের। তারপরেও খালি পিস্তল দেখিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছিলো সে উন্মত্ত গোষ্ঠীকে।

তার এই নিরলস প্রচেষ্টায় উগ্র সাম্প্রদায়িক লোকগুলো পিছিয়ে যায় সাময়িকভাবে। কিন্তু পরিকল্পনা করে  রাতে ফিরে এসে হামলা চালানোর। রাতের অন্ধকারে সিরাজ দেখতে পাবে না তাদের ভালো করে, এটাই ভাবনা ছিল তাদের।

তারা ফিরে আসার আগেই দীর্ঘদেহী সুদর্শন এক নেতা এসে হাজির হন সিরাজের কাছে। পঞ্চাশ রাউন্ড গুলি নিয়ে এসেছেন তিনি সাথে করে। সিরাজের হাতে সেগুলো দিয়ে বজ্রকন্ঠে তিনি বললেন, "নিজের  জান দিয়ে হলেও আমার এই হিন্দু ভাই-বোনদের বাঁচাও তুমি বাবা। বাঙালির সম্মান আর মর্যাদা আজ হুমকির মুখে। যেভাবেই হোক সেটাকে রক্ষা করতে হবে তোমার।"

এই নেতা, যিনি যে কোনো মূল্যে হিন্দুদের বাঁচানোর জন্য গুলি নিয়ে সিরাজের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন, তাঁর নাম হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমান।

আজকেও বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছেে। শান্তির ধর্মের লোকদের অন্য ধর্মের উপর প্রায়শই হামলা না করলে শান্তিত্ব ঠিকমতো প্রকাশ পায় না। তাই প্রতি বছর নিয়ম করে দুর্গাপূজার সময়ে হামলা চালানো হয়। এর বাইরেও যে হামলা হয় না, তা নয়। হামলা করার মেজাজে থাকলে যে কোনো একটা অজুহাত বের করে নিয়ে হামলা চালায় তারা।

সমস্যা হচ্ছে একটাই। আমাদের আরেকজন শেখ মুজিবুর রহমান নেই। তাঁর এক কন্যা আছে অবশ্য। তবে কোনো 'সিরাজ গুণ্ডার' কাছে গুলি সাপ্লাই দিতে যাবার সময় তাঁর হয়ে ওঠে না!

ফরিদ আহমেদ, কানাডা প্রবাসী লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ