আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বিচার বহির্ভূত হত্যা: যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অবস্থান

আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল  

২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৯৯৬টি (মতান্তরে ১১২৬টি)। ৯৬% হত্যাকাণ্ড ঘটেছে পুলিশের গুলিতে। নিহতদের ২৭% আফ্রিকান আমেরিকান, যদিও তারা মোট জনসংখ্যার ১৩%।

মানবাধিকার প্রতিবেদন অনুসারে, ৯৮.৮% ঘটনায় সংশ্লিষ্ট পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। কিন্তু গণতন্ত্রের ঠিকাদার যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে- ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৬০০টি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য! প্রতিবেদনে র‍্যাব ও যে ছয়জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে তাদের দায়িত্ব পালনের মেয়াদ উল্লেখ রয়েছে ২০১৫ সাল থেকে। যেকোনো বিবেকসম্পন্ন মানুষের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এ সিদ্ধান্ত অন্যায্য, একতরফা এবং পক্ষপাতদুষ্ট।

২৫ মার্চ, ১৯৭১-এর কালরাতে এদেশে বর্বরোচিতভাবে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। নয় মাসে ত্রিশ লক্ষ শহীদ প্রাণ দিয়েছিলেন; কিন্তু বিশ্বের মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র তখন কোনো অধিকারের ব্যত্যয় দেখতে পায়নি। বরং স্বাধীনতার সংগ্রামকে নস্যাৎ করতে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার চক্রান্ত করা হয়েছিল। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট যখন নৃশংসতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সপরিবারে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হলো, কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হলো; তখন কেউ মানবাধিকারের প্রশ্ন তোলেনি।

২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সহস্রাধিক। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা এবং শাহ এএমএস কিবরিয়া ও আহসানউল্লাহ মাস্টারসহ অগণিত রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল; কিন্তু তখনও গণতন্ত্রের কোনো সঙ্কট খুঁজে পায়নি যুক্তরাষ্ট্র। এখন পাচ্ছে? কিন্তু কেন?

বাংলাদেশে ২০০৯ পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের শিকাররা কেউ ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিলেন না। হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিরা প্রায় সকলেই মাদক ব্যবসা বা সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল। নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডারের মতো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেনি তা নয়, কিন্তু এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। শহীদুল আলম বা ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরুদের মতো রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িতরা যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলি থেকে রেহাই পায় না। কিন্তু বাংলাদেশে উস্কানি দিয়ে ও গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা বা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত অনেককে আইনের আওতায়ও আনা হয়নি। অভিযোগ ওঠার পর দলের সর্বোচ্চ স্তরের নেতাদেরও ছাড় দেয়া হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশ যে আক্রমণাত্মক আচরণ করে সেই তুলনায় বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেক বেশি সহনশীল। অর্থাৎ এমন কোনো ক্ষেত্র বা পরিস্থিতি বিরাজ করছে না যে কারণে মিয়ানমারের মতো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের নাম আসতে পারে! এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতরা নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে দেখতে পারেন, যদি তা থাকে!

আমরা যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাই- যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র দেশ যারা ১৮ শতাব্দী থেকে আর্থিকভাবে ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়েছে। অন্যান্য পরাশক্তি দেশগুলো নিজেদের ভূখণ্ডে এবং/অথবা পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। আমরা পৃথিবীবাসী কোনো শক্তি বা পরাশক্তির দালালি করেছি। "দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়"- এই নীতিতে ব্যক্তি/দলীয় স্বার্থে পুতুল হয়ে বৃহত্তর স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছি। পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় সহযোগী হয়েছে, কিন্তু নিজ ভূখণ্ডকে যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করেনি অথবা ব্যবহার করতে দেয়নি। তৃতীয় পক্ষের প্রভাবে নিজেদের ভূখণ্ডে কোনো ধরনের অস্থিরতা বা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির সুযোগ দেয়নি। তাই তাদের অগ্রগতি ছিল নিশ্চিত একটি যাত্রা। যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় অস্ত্র বিক্রি করে তাদের অর্থনীতি ফুলে ফেঁপে উঠেছে। আর আমরা ক্ষমতা দখলের জন্য আত্মসমর্পণ করেছি, নিজেদের মাতৃভূমি ও ক্ষমতার বলয় তুলে দিয়েছি সাম্রাজ্যবাদের হাতে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের কথিত গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে হাস্যকর অভিযোগ তুলেছে, তা নিজেদের বিকিয়ে দেয়া দালালগোষ্ঠীর চক্রান্তের ফলাফল। বিশ্বের কাছে নিজের জন্মভূমিকে হেয়-প্রতিপন্ন করার ষড়যন্ত্রই দালালদের কাছে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা।

প্রতিযোগীবিহীন যে যুক্তরাষ্ট্র আমাদেরকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দীক্ষা দিতে চায়, সেই স্বপ্নের দেশে যে গণতন্ত্রের সঙ্কট রয়েছে তা তাদের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এ সম্মেলনে অস্বীকার করতে পারেননি। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যান উল্লেখ করেছি। আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, ৩০০ বছরের গণতন্ত্র, মুক্তবুদ্ধি চর্চা ও অবাধ স্বাধীনতার দেশে এখনো রয়েছে রেসিজম। এখনও বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে তারা সফল হতে পারেনি। ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিন লক্ষাধিক বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে। ১০ বছরের শিশুর সঙ্গে প্রাপ্ত বয়স্কের বিবাহের অসংখ্য নজির রয়েছে। ৫০টি রাজ্যের ৪৫টিতে বাল্যবিবাহ হয় এবং অনেক রাজ্যে বিবাহের সর্বনিম্ন কোনো বয়সও নির্ধারণ করা হয়নি। যৌন হয়রানি ও নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান উল্লেখ করা বোধকরি নিষ্প্রয়োজন।

নিষেধাজ্ঞার ফলাফল কী
গত বছর ভারতকে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে তুলনা করে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তাই এসবের কোনো ফলাফল নেই। যে দলের আন্দোলন করার সাহস ও ক্ষমতা নেই, তাদের পুঁজি শুধুই ষড়যন্ত্র। মুশফিক, কনক বা খলিলরা তাদের পূর্বসূরিদের মতো শুধু ষড়যন্ত্রই করতে পারবে, ফলাফল হবে ৭১-এর মতোই। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান দূত আর. মিলার একজন দক্ষ কূটনীতিক। তিনি যেখানেই কর্মরত ছিলেন সেখানেই ক্ষমতার পটপরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছেন, পারেননি শুধু বাংলাদেশে। ইতোমধ্যে তার দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাই বিদায়কালে মীরজাফরদের সান্ত্বনা দিয়ে গেলেন হয়তো!

স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "আমি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে ধন্যবাদ দিতে চাই, কিন্তু সরকারকে ধন্যবাদ দিতে পারবো না।" যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিহিংসামূলক সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে জাতির পিতার সে কথাই প্রযোজ্য। এর মাধ্যমে মূলত বাইডেন প্রশাসনের অদক্ষতা ও অদূরদর্শিতার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। এ সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এনে মিয়ানমারে সংঘটিত রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞকে অর্থহীন করে ফেলা হয়েছে।

পক্ষ ও প্রতিপক্ষ থাকলে কেউ নায়ক হয়, কেউ খলনায়ক। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি দেশের প্রতি প্রভুসুলভ আচরণের কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে খলনায়কও বলা যায় না, এটি তাদের কাপুরুষতা। যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত একটি বিষয় প্রমাণ করেছে যে, বাংলাদেশ এখন বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না- এটি ১৯৭৫ নয় এবং বাংলাদেশ এখন তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, বাংলাদেশের বাজেটও দান-খয়রাত-ঋণ নির্ভর নয়। আমরা এখন অনেক খাতেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে যদি পারস্পরিক স্বার্থ মুখ্য হয়, তাহলে মেরুদণ্ডহীন দলের ভাঁড়দের কথায় কান দিয়ে হাস্যকর ও ছেলেমানুষি সিদ্ধান্ত থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরত থাকা উচিত।

আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল, সাবেক ছাত্রনেতা ও তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ