আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না কেন?

রেজা ঘটক  

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা সারাদেশে একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবরের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করতে পারিনি। এমনকি আমরা একাত্তরের গণশহীদদের নামের তালিকা পর্যন্ত তৈরি করতে পারিনি। অথচ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আস্ত একটি মন্ত্রণালয় রয়েছে! ২০০৯ সালে সারাদেশে একাত্তরের বধ্যভূমি, গণকবর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো চিহ্নিত ও সংরক্ষণ করার জন্য উচ্চ আদালত রায় দিয়েছিলেন। তারপরও চলে গেছে এক যুগ কিন্তু এই কাজের সত্যিকারের অগ্রসর কতদূর?

সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত সারাদেশে মোট ২০৯টি বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধান পাওয়ার কথা জানা যায়। এর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ শনাক্ত করেছে ১৯৩টি বধ্যভূমি। বেসরকারি সংস্থা ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং-এর মতে সারাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার বধ্যভূমি রয়েছে। এর মধ্যে শনাক্ত করা গেছে মাত্র ৯৪২টি। অথচ সংরক্ষণ করা হয়েছে মাত্র ৩৫টি।

এছাড়া দেশের অন্তত ৮৮টি নদী ও ৬৫টি ব্রিজ-কালভার্ট শনাক্ত করা হয়েছে যেখানে শত শত বাঙালিকে একাত্তরে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। খোদ রাজধানী ঢাকার ৭০টি বধ্যভূমির মধ্যে শুধু মিরপুরেই রয়েছে ২৩টি। অথচ এই ২৩টি বধ্যভূমির মধ্যে সংরক্ষণ করা হয়েছে মাত্র ৩টি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বধ্যভূমির তালিকায় ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় অন্তত ৩৯টি বধ্যভূমির নাম থাকলেও এই বধ্যভূমিগুলোও অরক্ষিত রয়েছে।

সরকারি হিসেবে চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৬১টি বধ্যভূমির নাম থাকলেও স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে মাত্র দু'টিতে। বাকি ৫৯টি বধ্যভূমিতে স্মৃতিফলক পর্যন্ত নেই। একমাত্র পূর্ব পাহাড়তলী ও হালিশহরের মধ্যম নাথপাড়ায় দুটি বধ্যভূমিতে স্মৃতিফলক রয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর ৬১টি বধ্যভূমির মধ্যে পাহাড়তলীতেই সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমি। এখানেই রয়েছে ১৫টি বধ্যভূমি। এছাড়া লালখান বাজারে ৬টি, হালিশহরে ৫টি, গোসাইলডাঙ্গায় ৫টি, আন্দরকিল্লায় ৪টি, বাকলিয়ায় ৩টি, রহমতগঞ্জ, কাট্টলী, পতেঙ্গা, বন্দর এলাকা, কাটগড়, মুরাদপুর, নাসিরাবাদ, পূর্ব মাদারবাড়ী ও পাঁচলাইশে দুটি করে এবং চন্দনপুরা, জয়পাহাড়, চান্দগাঁও, ষোলশহর ও রামপুরায় একটি করে বধ্যভূমি রয়েছে।

একই চিত্র দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অন্যান্য বধ্যভূমি, গণকবর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোর। অযত্ন, অবহেলা ও অবৈধ দখলের কারণে বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমি, গণকবরগুলো নিশ্চিহ্ন হতে চলছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে দেশের ২৮১টি বধ্যভূমি সংরক্ষণে ৪৪২ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করেছিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি বা একনেক। যার মেয়াদ ২০২১ সালের জুন মাসে শেষ হয়েছে।

এই সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় মাত্র একটি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ শেষ করেছে। বাকি ২৮০টির মধ্যে ৩টি বধ্যভূমির নির্মাণ কাজ শেষের পথে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের যে কোনো ধরনের ঐতিহাসিক স্মৃতি সংরক্ষণ করা এবং নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানো প্রত্যেক বাংলাদেশি নাগরিকের একটি পবিত্র কর্তব্য।

অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছরেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, একাত্তরের বধ্যভূমি, গণকবর, গণশহীদদের নামের তালিকা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো শনাক্ত, রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণে আমরা উদাসীন। আর এই কাজগুলো সবসময় নানান কিসিমের অজুহাত দিয়ে উপেক্ষা করা হয়েছে। আমরা মুখে মুখে বক্তৃতা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বড়াই করি। অথচ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান ও মুক্তিযুদ্ধে গণশহীদদের নামের তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমরা চরমভাবে উদাসীন, যা সত্যিই দুঃখজনক।

শুরু থেকেই এবিষয়ে নানান কিসিমের অভিযোগ, ব্যাপক দুর্নীতি, কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে চরম অবহেলা এবং ঠিকাদারদের অসংখ্য অনিয়মসহ নানা ধরনের ফিরিস্তির খবর পাওয়া যায়। অথচ অবহেলিত এসব একাত্তরের বধ্যভূমি, গণকবর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো যদি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা যায়, কেবলমাত্র তখনই আমরা নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস চর্চায় সচেতন করতে পারব।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্মৃতিকে যদি আমরা বাঁচিয়ে রাখতে চাই, তাহলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোকেও শনাক্ত, সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের এসব ঐতিহাসিক স্মৃতিকে নতুন প্রজন্মের কাছে জীবন্ত রাখতে হলে সারাদেশের বধ্যভূমি, গণকবর, গণশহীদদের নামের তালিকা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সকল স্থানকে সংরক্ষণ করতে হবে।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের এসব ঐতিহাসিক স্মৃতি শনাক্ত ও সংরক্ষণের দায়িত্ব সরকারের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে নিহত ব্যক্তির পরিবার ও সকল স্তরের নাগরিকদের মাধ্যমে উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য গবেষণা করা এবং তা যথাযথভাবে খুঁজে বের করার জন্য সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও দরকার। আর রাষ্ট্রীয়ভাবে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন না হলে কোনোদিন তা আর সম্ভব হবে না।

প্রতি বছর কেবল ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করার সময় সংবাদমাধ্যমে লোকদেখানো আহাজারি করে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ঐতিহাসিক স্মৃতিগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য দেশের সকল বধ্যভূমি, গণকবর, গণশহীদদের নামের তালিকা ও স্থানকে শনাক্ত, সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নাই।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে একাত্তরে নিহত সকল বাঙালির স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে এই বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের বাস্তবায়ন দেখতে চাই। শুধুমাত্র কথায় নয় কাজের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সকল ঐতিহাসিক ঘটনার আর্কাইভ দেখতে চাই।

রেজা ঘটক, সাহিত্যিক, নির্মাতা

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ