আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন ও বিলেত প্রবাসীদের দায়

জুয়েল রাজ  

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর বা সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাংলাদেশী বাঙালিদের বসবাস আছে, সবাই মহাসমারোহে উদযাপন করছেন দিনটি। সেই সাথে যোগ হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর মাহেন্দ্রক্ষণ।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে বাংলাদেশের পরে সবচেয়ে এগিয়ে আছে যুক্তরাজ্য বা আমাদের বিলেত। আর এর কারণও নিশ্চয় আছে। বাংলাদেশের পরে সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশির বসবাস যুক্তরাজ্যে, যাকে বলা হয় তৃতীয় বাংলা। যুক্তরাজ্য জুড়েই স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে নানা কর্মসূচি উদযাপিত হচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় আয়োজনটি লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসকে উপলক্ষ করে ৯ মাস ব্যাপী নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীকে উদযাপন করছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। বিষয়টির সাথে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের যে সমস্ত কাউন্সিলর কর্মকর্তা কর্মচারীবৃন্দ জড়িত আছেন তারাও ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। এবং মেয়র জন বিগস বিষয়গুলো অনুমোদন দিয়েছেন, নিশ্চয় তারও সমর্থন ছিল বলেই সম্ভব হয়েছে কাউন্সিলে পাস করে নিয়ে আসা।

এর বাইরে অনেকে ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে ও নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন। বিদেশে বিভূঁইয়ে এই ধরনের উদ্যোগ নেয়া যথেষ্ট কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়সাপেক্ষ। কাউন্সিল যেমন তাদের নিজেদের অর্থায়নে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করছে, তেমনি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজেরাই তাদের অর্থের সংস্থান করছে। বাংলাদেশে হয়তো সরকারি নানা অনুদানের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু প্রবাসে সেটি সম্ভব নয়।

দেশকে ভালবাসেন বলেই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেন বলেই, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের এতো আয়োজন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের ভূমিকা ও গৌরব উজ্জ্বল। বাংলাদেশের সকল প্রয়োজনে প্রবাসী মানুষজন দেশের পাশে দাঁড়িয়েছেন৷ কিন্তু, বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক পরিবর্তনের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের প্রবাসীদের মাঝেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। ১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছেন তাদের উত্তরপ্রজন্ম ঠিক তার উল্টো পথে হেঁটেছে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার বিপক্ষ শক্তি বা যারা প্রকাশ্যে ধর্মের নামে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আর সেই ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যে পালিয়ে আসা, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী, রাজাকার আলবদর আল শামসের পালের গোদাসহ অনেকেই বিরাট ভূমিকা রেখেছে। আনুষ্ঠানিক এই উদযাপনের কার্যকারিতা নিয়ে তাই আমি সন্দিহান। আনুষ্ঠানিক উদযাপনের পাশাপাশি যদি ১৯৭১ সালের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী যুদ্ধাপরাধীদের বাংলাদেশে ফিরয়ে নেয়ার দাবিটুকু বাস্তবায়নে কাজ করতেন, তাহলে অর্জনের পাল্লাটা ভারি হতো। কিন্তু সেই দায়টা আমরা খুব সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছি।

একমাত্র ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও তাদের সমমনা কিছু ছোট ছোট সংগঠন ছাড়া এই বিষয়ে কেউ কথা বলতে দেখা যায় না। এমনকি যে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারতো, দল হিসাবে আওয়ামী লীগও নীরব। যুক্তরাজ্যে পলাতক যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মঈন উদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানকে দণ্ডভোগের জন্য বাংলাদেশে পাঠাতেও কেউই ব্রিটিশ সরকারের সাথে বা জনমত গঠনে ভূমিকা রাখছেন বলে জানা নেই। ব্রিটিশ সরকার যদি মৃত্যুদণ্ডের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের হাতে হস্তান্তর নাও করে ব্রিটেনের প্রচলিত আইনেই সুযোগ আছে এদের বিচার করার।

যুদ্ধাপরাধীদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেয়ার আলোচনায় আমার এক সাংবাদিক বন্ধু, বিলেতের এক সহকর্মী সাংবাদিকের বিয়ের ছবি পাঠালেন। যেখানে যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মঈনুদ্দিন বরের সাথে হাসিমুখে হ্যান্ডসেক করছেন। বাঙালি কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও অনেক সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন সেই বিয়েতে। হয়তো লোকলজ্জার ভয়ে ছবি তুলেননি, কিংবা তুললেও তা প্রকাশ করেননি। কিন্তু তাদের মধ্যে যে সুসম্পর্ক আছে সেটি অবিশ্বাস করার সুযোগ নেই।

আবার এরাই বিভিন্ন আয়োজন করে, বঙ্গবন্ধু নিয়ে আলোচনা করেন, ৭ই মার্চ নিয়ে আলোচনা করবেন, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করবেন, নানা দিবস উদযাপন করেন, আবার বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নায়ক চৌধুরী মঈনুদ্দীনের সাথে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক সম্পর্কও বজায় রাখেন।

বাংলাদেশের সমকাল পত্রিকা গত ৭ অক্টোবর ২০২১ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, যার শিরোনাম ছিল, জামায়াতের কমান্ড সেন্টার লন্ডনে। সেখানে তারা উল্লেখ করে, জামায়াতে ইসলামের অনেক গোপন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসে লন্ডন থেকে। পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন সময় ৯০০-র বেশি সদস্যকে সংগঠনটির ফান্ডের অর্থ ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে সেখানে পাঠানো হয়েছে। সেখানে বসেই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সারাদেশের নেতাকর্মী ও গুরুত্বপূর্ণ শুভানুধ্যায়ীদের তালিকা করে তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা হয়। একই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় "লন্ডনে সংগঠনটির অনেক নেতাকর্মী ও শুভানুধ্যায়ী রয়েছে। সেখানে বসে তারা সংগঠনটির অ্যাসাইনমেন্ট পালন করছে। দেশে কোণঠাসা জামায়াতের প্রভাববলয় এখন লন্ডনকেন্দ্রিক। এবং সেটি কোনভাবেই মিথ্যা নয়। বর্ণচোরা সেইসব সদস্যরা নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শকে লুকিয়ে রেখে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে যেমন জড়িয়ে গেছে। তার চেয়েও বেশি জায়গা করে নিয়েছে বিভিন্ন সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠনের ব্যানারে। যাদের মূল কাজ হচ্ছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির পক্ষে জনমত তৈরি করা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বরং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন কোণঠাসা হয়ে, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে, বিভিন্ন সংগঠন তাদের হাতে ছেড়ে দিতে হচ্ছে। এমন ঘটনাও আছে। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন বা পালন তখন লোকদেখানো আয়োজন বলেই মনে হয়। যতক্ষণ না বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল নায়ক চৌধুরী মঈনুদ্দিনসহ অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যায়।

বিলেতের বাংলা গণমাধ্যমে এবং সাংবাদিকরাও যে ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল, তার কোন প্রয়োগ করেননি। সবাই বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চায়। ১৪ ডিসেম্বরেও ব্রিটেনে বসবাসকারী যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে কোন সংবাদ বা প্রতিবেদন করেন বলেও আমার জানা নেই। অবাক করার বিষয় বছর কয়েক আগেও যে লোকটি শেখ মুজিব কিংবা শুধু মুজিব বলত সেই লোকটি এখন বঙ্গবন্ধুর আগে জাতির জনক যোগ করে। কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বই পর্যন্ত প্রকাশ করছে। দেশে বিদেশ সব জায়গায় এই ধারা চলমান। সামনে কী অপেক্ষা করছে কে জানে!

জুয়েল রাজ, সম্পাদক, ব্রিকলেন; যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি, দৈনিক কালেরকন্ঠ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ