আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার শক্তিকে টিকিয়ে রাখতে হবে

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ  

রুশ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক লিও টলস্টয় বলেছেন, "একটি দেশকে ধ্বংস করতে হলে সে দেশের মানুষের মধ্যে ধর্মের নামে লড়াই লাগিয়ে দিলেই চলবে।" কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বহুবার এবং বহুভাবে ধর্মের বাড়াবাড়ি নিয়ে বাঙালিকে সতর্ক করেছেন। একবার বলেছেন- 'ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে/অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।' সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মকে কেন্দ্র করে কিছু পরিকল্পিত উন্মাদনা এমনকি সহিংসতার ঘটনায় টলস্টয় ও রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দুটি মনে পড়ে।

বাংলাদেশে সব ধর্মের, সব বর্ণ ও গোত্রের মানুষ একসঙ্গে বসবাস করেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। সম্প্রীতির এই ঐতিহ্য প্রকৃতিগতভাবে লালিত। বাঙালির ইতিহাসে যা কিছু মহৎ যা কিছু বৃহৎ, তার সবটাই সম্প্রীতির অর্জন এবং এই শক্তি বাঙালির সভ্যতা নির্মাণ করেছে। বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে। একে যখনই দুর্বল করা হয়েছে তখনই অকল্যাণ এসেছে। অকল্যাণের এই অমানিশা যারা এনেছেন তারা বিভেদের ও বিজাতীয় মানুষ, অকল্যাণের মানুষ। সাধারণ মানুষ কখনোই ধর্ম-সংঘাত তৈরি করে না, কোনো দেশেই করেনি। এটি করে স্বার্থান্বেষীরা। তারা কখনও রাজনীতি করে, কখনও ব্যবসা করে, কখনও অন্যের হয়ে ভাড়া খাটে কিংবা অন্ধতায় ভোগে। এই মাটিতে একবার নয়, আগেও বহুবার স্বার্থান্বেষী কিছু মহল সম্প্রীতির সহজাত বাঁধনে ফাটল ধরাতে চেয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে সফলও হয়েছে।

সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপারটা ঘটেছে রাষ্ট্রশক্তির হাতে, পরিকল্পিতভাবে। কিন্তু যে সম্প্রীতি বাংলার মাটিতে সহজাত, সে কি হার মেনেছে? মানেনি। বাঙালি নতুন করে সংঘবদ্ধ হয়েছে, প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে বিভাজনের শক্তির বিরুদ্ধে। একটি কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিনির্মাণ হয়েছে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার শক্তিতে; যা আমাদের জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি। কিন্তু সেই ভিত্তিতে ফাটল ধরানোর চেষ্টা চলেছে বারংবার। যারা এ কাজটি করার চেষ্টা করেছে তারা সন্দেহাতীত চরম সাম্প্রদায়িক, কিংবা ধর্মের পরিচয়ে বকধার্মিকও। অতএব তাদের মোকাবিলা করা সভ্যতার দাবি।

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ শেষে ভারতের শরণার্থী শিবির থেকে প্রায় এক কোটি দেশত্যাগী মানুষ, মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান নির্বিশেষে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসে। ধ্বংস ও রক্তপাতের মধ্য থেকে অসাম্প্রদায়িক নতুন বাংলাদেশ জেগে ওঠে। সে জেগে ওঠা স্থায়ী হয় না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি। দুটি সামরিক শাসন, সংবিধানে পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনী ইত্যাদি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নতুন করে আতঙ্কে নিপতিত করে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা অতিক্ষুদ্র আদিবাসীসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিপন্ন করতে শুরু করে। একাত্তর পাল্টে দিয়ে সাতচল্লিশের সাম্প্রদায়িক চেতনা নতুন করে গ্রাস করতে থাকে। যে সাম্প্রদায়িকতাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে কবর দিয়েছিলাম বলে আত্মতুষ্টি লাভ করেছি, সেই সাম্প্রদায়িকতা নতুন করে পাখা বিস্তার করে।

স্বাধীনতার পর সকলেরই আশা ছিল বাংলাদেশ হবে আধুনিক, গণতান্ত্রিক। কিন্তু ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অনেকটাই 'পাকিস্তানি লিগেসির' কাছে ফিরে যায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে সমাজ প্রগতি ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে হত্যা করা হয়। জাতির পিতা চেয়েছিলেন বাংলাদেশ হবে গণতান্ত্রিক, সমাজতন্ত্রী, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতা কাটেনি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক শক্তির টানা ১৩ বছর রাষ্ট্রশাসনের পরও সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়েছে বলা যাবে না। বাংলাদেশকে আজও ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। কারণ স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ সম্মিলিত উদ্যোগে আগ্রাসন চালাচ্ছে। এ আগ্রাসন রুখতে প্রয়োজন সকল মানুষের সম্মিলিত প্রয়াস। প্রয়োজন সম্প্রীতির, মনুষ্যত্বের পুনরাভিযান। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা শুভ প্রবণতা নয়। এতে সামাজিক সহনশীলতা বিনষ্ট হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় পবিত্রতা। অতএব দুষ্ট প্রবণতা থেকে সমাজকে মুক্তি দিতে হবে। এই মুক্তি সরকার একা দিতে পারে না। এটি দিতে হবে সকল সচেতন মানুষকে। দলমত, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে।

যে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় অহংকার, সেই মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে সবল করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। লুটেরা, লুম্পেন সত্য ও সুন্দরকে গ্রাস করবে। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে। বাংলাদেশ এমন এক রাষ্ট্র যার ভিত্তি সব ধর্ম, সব বর্ণ, সব গোত্রের সম্প্রীতি। মনে রাখতে হবে, এই ভিত্তিকে যারা দুর্বল করতে চায় তারা কেবল এই রাষ্ট্রেরই প্রতিপক্ষ নয়, তারা সভ্যতা ও মনুষ্যত্বের প্রতিপক্ষ। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন- "আমরা হিন্দু ও মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।"

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ