আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

অমিক্রন ভাইরাস বিষয়ে যা জানা খুবই জরুরি

ড. শামীম আহমেদ  

অমিক্রন দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী। ডেল্টার চাইতে মৃত্যুর হার কম হলেও এটি সংক্রমণের দিক দিয়ে করোনাভাইরাসের আগের যে কোন ভ্যারিয়েন্ট বা ধরণকে ছাড়িয়ে গেছে। ইউরোপ এবং আমেরিকায় সংক্রমণের আগের সব রেকর্ড ইতিমধ্যে ভেঙে গেছে। রোগীর অত্যধিক চাপে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা পড়েছে ঝুঁকির মধ্যে। অমিক্রন নিয়ে বেশ কিছু ভুল ধারণা আছে আমাদের, তাই খুব সাদাসিধে ভাষায় অত্যন্ত জটিল কিছু বিষয় সবার জন্য তুলে ধরছি। বিষয়গুলো জানা জরুরি। জনস্বাস্থ্য ও গবেষণা লব্ধ এই তথ্যগুলো সবার উপযোগী করে উত্থাপন করলাম। তবে করোনা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল, নতুন তথ্য জানলে আপনাদের জানিয়ে দেবার চেষ্টা করব।

১. কততম ভ্যাকসিন নিচ্ছেন তার চাইতে শেষ ভ্যাকসিন কবে নিয়েছেন সেটি বেশি জরুরি
অমিক্রনের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সারা বিশ্বেই তৃতীয় ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এখানে মনে রাখা দরকার ভ্যাকসিনের তৃতীয় ডোজের মধ্যে জাদুকরী কোন উপাদান নেই, এবং তা আগের ভ্যাকসিনের চাইতে রাসায়নিকভাবেও ভিন্ন বা শক্তিশালী নয়। ডেল্টা বা অমিক্রনের জন্য আলাদা কোন ভ্যাকসিন বানানো হয়নি। যেটি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হচ্ছে আপনি শেষ ভ্যাকসিন কবে নিয়েছেন? আপনার শেষ ভ্যাকসিন যদি ছয় মাসের পূর্বে নেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে আপনার জন্য আরেকটি ভ্যাকসিন নেওয়া খুবই জরুরি, কেননা এটি এখন নিশ্চিত যে করোনার যে কোন ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ছয় মাস পর কমতে থাকে। তাই ছয় মাস পূর্বে যদি আপনি শেষ ভ্যাকসিন নিয়ে থাকেন, তবে যত দ্রুত সম্ভব আরেকটি ডোজ নেওয়া আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যদি সুযোগ থাকে, তাহলে শেষ ডোজের তিনমাস পার হলেই আরেকটি ডোজ নেয়া ভালো। এই নতুন ডোজটি আপনার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ যাই হোক না কেন।

২. তৃতীয় ডোজই একমাত্র বুস্টার ডোজ নয়
করোনার তৃতীয় ডোজকে অনেকেই বুস্টার ডোজ বলছেন। বুস্টার ডোজ আসলে কী সেটি সম্পর্কেও আমাদের মধ্যে ভুল ধারণা আছে। ‘Boost’ শব্দের অর্থ বৃদ্ধি করা বা বিকাশ করা। ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে বুস্টার বলতে বোঝায় প্রাথমিক ভ্যাকসিন দেয়ার পর যেই মাত্রার প্রতিরক্ষা গড়ে ওঠে সেটি একই মাত্রা বজায় রাখতে বা যদি তার প্রতিরক্ষা ব্যূহ কমে যায়, তাকে বাড়িয়ে তুলতে আবার ভ্যাকসিন দেওয়া। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ‘টিটেনাস’ ভ্যাকসিনের কথা। টিটেনাসের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা সমুন্নত রাখতে প্রতি ১০ বছর অন্তর বুস্টার ডোজ নেওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়, কারণ দেখা গেছে ১০ বছর অন্তর ভ্যাকসিন না দিলে টিটেনাসের প্রতিরক্ষা ব্যূহ নষ্ট হতে শুরু করে। করোনার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এমনই। যেহেতু প্রতি ছয় মাস পর ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমছে, তাই নতুন ধরনের করোনার উৎপত্তি হলেই আবার বুস্টার ডোজ নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে নতুন ধরণটির বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে।

এই ক্ষেত্রে আরেকটি বাস্তবিক উদাহরণ দেওয়া যায়। ক্যানাডার বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে করোনার চতুর্থ ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে। যেহেতু প্রথমে ৮০ বছরের ঊর্ধ্বের মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছিল ক্যানাডায়, তাদের অধিকাংশের তৃতীয় ডোজ নেওয়া ৬ মাস আগে শেষ হয়েছে। তাই অমিক্রনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে তাদের জন্য চতুর্থ ডোজ ভ্যাকসিন বুস্টার হিসেবে কাজ করবে।

৩. করোনার ভ্যাকসিন কি প্রতি ৬ মাস পর পর সারাজীবন দিতে হবে?
যদিও এই বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এখনও নিশ্চিতভাবে কিছু বলছেন না, কিন্তু জনস্বাস্থ্যের শিক্ষা ব্যবহার করে বলা যায় সম্ভবত সামনের দিনগুলিতে এত ঘন ঘন ভ্যাকসিন নিতে হবে না। কেন নয়, আসুক আলোচনা করা যাক।

ক. অধিক কার্যকর ভ্যাকসিনের সহজলভ্যতা: আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে বুঝব ভ্যাকসিন বা এন্টিবায়োটিকস তৈরি করা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। স্মলপক্স, ইয়েলো ফিভারের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে লেগেছে শত বছর, পোলিও এবং টাইফয়েডের ভ্যাকসিন তৈরিতে লেগেছে প্রায় ৩০ বছর। ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন ২৫ বছরের মাথায় তৈরি করার ২ বছর পরই তা অকার্যকর ঘোষণা করা হয়। এখন ইনফ্লুয়েঞ্জার নতুন ভ্যারিয়েন্ট প্রায় প্রতিবছরই বের হয়, তাই প্রতিবছরই এর ভ্যাকসিন নিতে হয়। পশ্চিমা বিশ্বে এটি সিজনাল ফ্লু ভ্যাকসিন হিসেবে পরিচিত। সুতরাং করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে যে ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে একবছরেরও কম সময়ে, তার প্রাথমিক কার্যকারিতা কিছুটা কম হতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এর গতিপ্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করছেন এবং সামনের দিনগুলিতে করোনার নতুন যে ভ্যাকসিন আসবে তা অধিক কার্যকর হবে বলে প্রতীয়মান হয়।

খ. ন্যাচারাল ইমিউনিটি (প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা): ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা হয় মূলত ন্যাচারাল ইমিউনিটিকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ মানুষ কোন ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শরীর সেটিকে মোকাবেলা করতে গিয়ে সেটার গঠন-প্রকৃতি সম্পর্কে অবগত হয় এবং সেই অভিজ্ঞতা নিজের ‘মেমোরি সেল’ বা স্মৃতিকক্ষে সংরক্ষণ করে রাখে। ফলে পরবর্তীতে ওই ভ্যাকসিন আবার আক্রমণ করলে শরীর নিজেই সেটিকে রুখে দিতে পারে। ভাইরাস যদি খুব শক্তিশালী হয় তাহলে শরীর তার স্মৃতি বেশিদিন সংরক্ষণ করতে পারে না, তখন তাকে বাইরে থেকে শক্তি জোগাতে হয়। কোভিড-১৯, তেমনই শক্তিশালী ভাইরাস, যা প্রতিরোধে শরীরকে বাইরে থেকে ভ্যাকসিনের সাহায্য নিতে হচ্ছে। তবে শরীর যখন করোনাকে নিজে প্রাথমিকভাবে মোকাবেলা করছে, তখন তার ভেতর কিছু রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। এর সাথে একাধিক ডোজ ভ্যাকসিন যুক্ত হলে সেটি আরও অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠে। যেহেতু বিশ্বের অনেক মানুষই ধারণা করা যায় ইতিমধ্যে করোনায় একবার হলেও আক্রান্ত হয়েছেন, এবং সামনের কিছুদিনের মধ্যে অনেকেই দুই থেকে তিন ডোজ ভ্যাকসিন নিয়ে নেবেন, তাদের প্রতিরক্ষা অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠবে।

গ. মিউটেসন শ্লথ হবে: করোনাভাইরাস ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। এটি দিনে দিনে পরিবর্তিত হচ্ছে যার কারণে প্রাথমিক সাফল্যের পরেও এটি নতুন করে আক্রান্ত করছে মানুষকে। একাধিকবার পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান অমিক্রন তারই নিদর্শন। মিউটেসন (অর্থাৎ ভাইরাস প্রথমে যেমন থাকে, রাসায়নিক ক্রিয়ার মাধ্যমে সেটি নিজের ধরণ পাল্টে ফেলে) চলতে থাকলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমতির দিকে থাকবে এটাই স্বাভাবিক, কেননা নতুন ভ্যারিয়েন্ট পূর্বের ভ্যাকসিনের মাধ্যমে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করা নাও সম্ভব হতে পারে। তবে আশার কথা হচ্ছে এই মিউটেসন অধিকাংশ ভাইরাসের ক্ষেত্রেই অনন্তকাল ধরে ক্ষতিকর মাত্রায় চলে না। কিছু মিউটেসন চলতে থাকে, কিন্তু তা ক্ষতিকর হয় না। বেশিরভাগ ভাইরাসের ক্ষেত্রেই তাই হয়। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন করোনাভাইরাস ফ্লু ভাইরাসের চাইতে অর্ধেক মাত্রায় পরিবর্তিত হচ্ছে (করোনাভাইরাস বছরে ২৫ বার পর্যন্ত পরিবর্তিত হতে পারে, ফ্লু হচ্ছে ৫০ বারের মতো!)। এইচআইভি এইডস বা ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাস কোভিড-১৯ ভাইরাসের চাইতে অনেক দ্রুত পরিবর্তিত হয়। মিউটেসনের মাত্রা কমার সাথে সাথে সংক্রমণও কমবে। তাই মিউটেসন থামাতে ভ্যাকসিনেসন বাড়াতে হবে, এবং ভাইরাস যাতে একজন থেকে আরেকজনের কাছে না ছড়াতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। ভাইরাস ছড়াতে না পারলে মিউটেট করতে পারবে না (যদি না কেউ পরিকল্পিতভাবে ল্যাবটরিতে তা করে!), আদতে আস্তে আস্তে নিষ্ক্রিয় হয়ে আসবে।

৪. মৃত্যুর হার কম হলেও অধিক বিপজ্জনক: অমিক্রনে প্রাথমিকভাবে মৃত্যুর হার অনেক কম হলেও এটি খুবই বিপজ্জনক একটি ভাইরাস।

প্রথমত, এটি করোনাভাইরাসের অন্য ধরণগুলো থেকে দ্রুত ছড়ায়। আর দ্রুত ছড়াতে থাকলে সেটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরির দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। নতুন ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা বা অমিক্রন থেকেও ভয়াবহ হতে পারে, কোন ভ্যাকসিন তখন কাজ নাও করতে পারে। তাই অমিক্রনের সংক্রমণ প্রতিহত করা জরুরি।

দ্বিতীয়ত, যেহেতু লক্ষ লক্ষ মানুষ এতে আক্রান্ত হচ্ছেন; তাই যাদের শরীরে নানা রোগ-ব্যাধি আছে, বা যারা বয়স্ক তারা ভ্যাকসিন নিলেও এই সংক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকার্যকর হয়ে এখন বা পরবর্তীতে মৃত্যুঝুঁকিতে পড়তে পারেন।

তৃতীয়ত, অমিক্রনের রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসা দিলে অন্য গুরুতর রোগীরা চিকিৎসাসেবা না পাওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারেন, যা বৈশ্বিক মৃত্যুর হার বাড়িয়ে দিতে পারে।

চতুর্থত, দীর্ঘ দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করা চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্যকর্মী, ও জনস্বাস্থ্য গবেষকরা শারীরিক ও মানসিক অবসাদের শীর্ষে অবস্থান করছেন, যা ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক অবসাদের সৃষ্টি করতে পারে।

যদিও এখন পর্যন্ত অমিক্রনে মৃত্যু এবং হাসপাতালে ভর্তির হার ডেল্টার অর্ধেক, কিন্তু যেহেতু সংক্রমণের হার ডেল্টার চাইতে বেশি সুতরাং আদতে মৃত্যুর হার ও হাসপাতালে ভর্তির হার ডেল্টাকেও অতিদ্রুত ছাড়িয়ে যেতে পারে যা সারাবিশ্বকে দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়ের দিকে ঢেলে দিতে পারে।

সুতরাং, যদি আপনার ভ্যাকসিনের শেষ ডোজ ৬ মাসের পুরনো হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে সুযোগ থাকলে নতুন ডোজ ভ্যাকসিন নিয়ে নিন। পরিবারের সদস্য ব্যতিরেকে অন্যদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন, সুযোগ থাকলে অফিস আদালত অনলাইনে চালু রাখুন, কারও ছয় ফুটের কাছাকাছি আসার সম্ভাবনা থাকলে মাস্ক পরুন।

অমিক্রন দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী। ডেল্টার চাইতে মৃত্যুর হার কম হলেও এটি সংক্রমণের দিক দিয়ে করোনাভাইরাসের আগের যে কোন ভ্যারিয়েন্ট বা ধরণকে ছাড়িয়ে গেছে। ইউরোপ এবং আমেরিকায় সংক্রমণের আগের সব রেকর্ড ইতিমধ্যে ভেঙে গেছে। রোগীর অত্যধিক চাপে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা পড়েছে ঝুঁকির মধ্যে। অমিক্রন নিয়ে বেশ কিছু ভুল ধারণা আছে আমাদের, তাই খুব সাদাসিধে ভাষায় অত্যন্ত জটিল কিছু বিষয় সবার জন্য তুলে ধরছি। বিষয়গুলো জানা জরুরি। জনস্বাস্থ্য ও গবেষণা লব্ধ এই তথ্যগুলো সবার উপযোগী করে উত্থাপন করলাম। তবে করোনা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল, নতুন তথ্য জানলে আপনাদের জানিয়ে দেবার চেষ্টা করব। 
১. কততম ভ্যাকসিন নিচ্ছেন তার চাইতে শেষ ভ্যাকসিন কবে নিয়েছেন সেটি বেশি জরুরিঅমিক্রনের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সারা বিশ্বেই তৃতীয় ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এখানে মনে রাখা দরকার ভ্যাকসিনের তৃতীয় ডোজের মধ্যে জাদুকরী কোন উপাদান নেই, এবং তা আগের ভ্যাকসিনের চাইতে রাসায়নিকভাবেও ভিন্ন বা শক্তিশালী নয়। ডেল্টা বা অমিক্রনের জন্য আলাদা কোন ভ্যাকসিন বানানো হয়নি। যেটি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হচ্ছে আপনি শেষ ভ্যাকসিন কবে নিয়েছেন? আপনার শেষ ভ্যাকসিন যদি ছয় মাসের পূর্বে নেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে আপনার জন্য আরেকটি ভ্যাকসিন নেওয়া খুবই জরুরি, কেননা এটি এখন নিশ্চিত যে করোনার যে কোন ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ছয় মাস পর কমতে থাকে। তাই ছয় মাস পূর্বে যদি আপনি শেষ ভ্যাকসিন নিয়ে থাকেন, তবে যত দ্রুত সম্ভব আরেকটি ডোজ নেওয়া আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যদি সুযোগ থাকে, তাহলে শেষ ডোজের তিনমাস পার হলেই আরেকটি ডোজ নেয়া ভালো। এই নতুন ডোজটি আপনার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ যাই হোক না কেন। 
২. তৃতীয় ডোজই একমাত্র বুস্টার ডোজ নয়করোনার তৃতীয় ডোজকে অনেকেই বুস্টার ডোজ বলছেন। বুস্টার ডোজ আসলে কী সেটি সম্পর্কেও আমাদের মধ্যে ভুল ধারণা আছে। ‘Boost’ শব্দের অর্থ বৃদ্ধি করা বা বিকাশ করা। ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে বুস্টার বলতে বোঝায় প্রাথমিক ভ্যাকসিন দেয়ার পর যেই মাত্রার প্রতিরক্ষা গড়ে ওঠে সেটি একই মাত্রা বজায় রাখতে বা যদি তার প্রতিরক্ষা ব্যূহ কমে যায়, তাকে বাড়িয়ে তুলতে আবার ভ্যাকসিন দেওয়া। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ‘টিটেনাস’ ভ্যাকসিনের কথা। টিটেনাসের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা সমুন্নত রাখতে প্রতি ১০ বছর অন্তর বুস্টার ডোজ নেওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়, কারণ দেখা গেছে ১০ বছর অন্তর ভ্যাকসিন না দিলে টিটেনাসের প্রতিরক্ষা ব্যূহ নষ্ট হতে শুরু করে। করোনার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এমনই। যেহেতু প্রতি ছয় মাস পর ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমছে, তাই নতুন ধরনের করোনার উৎপত্তি হলেই আবার বুস্টার ডোজ নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে নতুন ধরণটির বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে। 
এই ক্ষেত্রে আরেকটি বাস্তবিক উদাহরণ দেওয়া যায়। ক্যানাডার বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে করোনার চতুর্থ ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে। যেহেতু প্রথমে ৮০ বছরের ঊর্ধ্বের মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছিল ক্যানাডায়, তাদের অধিকাংশের তৃতীয় ডোজ নেওয়া ৬ মাস আগে শেষ হয়েছে। তাই অমিক্রনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে তাদের জন্য চতুর্থ ডোজ ভ্যাকসিন বুস্টার হিসেবে কাজ করবে। 
৩. করোনার ভ্যাকসিন কি প্রতি ৬ মাস পর পর সারাজীবন দিতে হবে?যদিও এই বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এখনও নিশ্চিতভাবে কিছু বলছেন না, কিন্তু জনস্বাস্থ্যের শিক্ষা ব্যবহার করে বলা যায় সম্ভবত সামনের দিনগুলিতে এত ঘন ঘন ভ্যাকসিন নিতে হবে না। কেন নয়, আসুক আলোচনা করা যাক।  
ক. অধিক কার্যকর ভ্যাকসিনের সহজলভ্যতা: আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে বুঝব ভ্যাকসিন বা এন্টিবায়োটিকস তৈরি করা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। স্মলপক্স, ইয়েলো ফিভারের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে লেগেছে শত বছর, পোলিও এবং টাইফয়েডের ভ্যাকসিন তৈরিতে লেগেছে প্রায় ৩০ বছর। ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন ২৫ বছরের মাথায় তৈরি করার ২ বছর পরই তা অকার্যকর ঘোষণা করা হয়। এখন ইনফ্লুয়েঞ্জার নতুন ভ্যারিয়েন্ট প্রায় প্রতিবছরই বের হয়, তাই প্রতিবছরই এর ভ্যাকসিন নিতে হয়। পশ্চিমা বিশ্বে এটি সিজনাল ফ্লু ভ্যাকসিন হিসেবে পরিচিত। সুতরাং করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে যে ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে একবছরেরও কম সময়ে, তার প্রাথমিক কার্যকারিতা কিছুটা কম হতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এর গতিপ্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করছেন এবং সামনের দিনগুলিতে করোনার নতুন যে ভ্যাকসিন আসবে তা অধিক কার্যকর হবে বলে প্রতীয়মান হয়। খ. ন্যাচারাল ইমিউনিটি (প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা): ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা হয় মূলত ন্যাচারাল ইমিউনিটিকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ মানুষ কোন ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শরীর সেটিকে মোকাবেলা করতে গিয়ে সেটার গঠন-প্রকৃতি সম্পর্কে অবগত হয় এবং সেই অভিজ্ঞতা নিজের ‘মেমোরি সেল’ বা স্মৃতিকক্ষে সংরক্ষণ করে রাখে। ফলে পরবর্তীতে ওই ভ্যাকসিন আবার আক্রমণ করলে শরীর নিজেই সেটিকে রুখে দিতে পারে। ভাইরাস যদি খুব শক্তিশালী হয় তাহলে শরীর তার স্মৃতি বেশিদিন সংরক্ষণ করতে পারে না, তখন তাকে বাইরে থেকে শক্তি জোগাতে হয়। কোভিড-১৯, তেমনই শক্তিশালী ভাইরাস, যা প্রতিরোধে শরীরকে বাইরে থেকে ভ্যাকসিনের সাহায্য নিতে হচ্ছে। তবে শরীর যখন করোনাকে নিজে প্রাথমিকভাবে মোকাবেলা করছে, তখন তার ভেতর কিছু রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। এর সাথে একাধিক ডোজ ভ্যাকসিন যুক্ত হলে সেটি আরও অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠে। যেহেতু বিশ্বের অনেক মানুষই ধারণা করা যায় ইতিমধ্যে করোনায় একবার হলেও আক্রান্ত হয়েছেন, এবং সামনের কিছুদিনের মধ্যে অনেকেই দুই থেকে তিন ডোজ ভ্যাকসিন নিয়ে নেবেন, তাদের প্রতিরক্ষা অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠবে। 
গ. মিউটেসন শ্লথ হবে: করোনাভাইরাস ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। এটি দিনে দিনে পরিবর্তিত হচ্ছে যার কারণে প্রাথমিক সাফল্যের পরেও এটি নতুন করে আক্রান্ত করছে মানুষকে। একাধিকবার পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান অমিক্রন তারই নিদর্শন। মিউটেশন (অর্থাৎ ভাইরাস প্রথমে যেমন থাকে, রাসায়নিক ক্রিয়ার মাধ্যমে সেটি নিজের ধরণ পাল্টে ফেলে) চলতে থাকলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমতির দিকে থাকবে এটাই স্বাভাবিক, কেননা নতুন ভ্যারিয়েন্ট পূর্বের ভ্যাকসিনের মাধ্যমে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করা নাও সম্ভব হতে পারে। তবে আশার কথা হচ্ছে এই মিউটেসন অধিকাংশ ভাইরাসের ক্ষেত্রেই অনন্তকাল ধরে ক্ষতিকর মাত্রায় চলে না। কিছু মিউটেসন চলতে থাকে, কিন্তু তা ক্ষতিকর হয় না। বেশিরভাগ ভাইরাসের ক্ষেত্রেই তাই হয়। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন করোনাভাইরাস ফ্লু ভাইরাসের চাইতে অর্ধেক মাত্রায় পরিবর্তিত হচ্ছে (করোনাভাইরাস বছরে ২৫ বার পর্যন্ত পরিবর্তিত হতে পারে, ফ্লু হচ্ছে ৫০ বারের মতো!)। এইচআইভি এইডস বা ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাস কোভিড-১৯ ভাইরাসের চাইতে অনেক দ্রুত পরিবর্তিত হয়। মিউটেসনের মাত্রা কমার সাথে সাথে সংক্রমণও কমবে। তাই মিউটেসন থামাতে ভ্যাকসিনেসন বাড়াতে হবে, এবং ভাইরাস যাতে একজন থেকে আরেকজনের কাছে না ছড়াতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। ভাইরাস ছড়াতে না পারলে মিউটেট করতে পারবে না (যদি না কেউ পরিকল্পিতভাবে ল্যাবটরিতে তা করে!), আদতে আস্তে আস্তে নিষ্ক্রিয় হয়ে আসবে।  ৪. মৃত্যুর হার কম হলেও অধিক বিপজ্জনক: অমিক্রনে প্রাথমিকভাবে মৃত্যুর হার অনেক কম হলেও এটি খুবই বিপজ্জনক একটি ভাইরাস। 
প্রথমত, এটি করোনাভাইরাসের অন্য ধরণগুলো থেকে দ্রুত ছড়ায়। আর দ্রুত ছড়াতে থাকলে সেটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরির দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। নতুন ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা বা অমিক্রন থেকেও ভয়াবহ হতে পারে, কোন ভ্যাকসিন তখন কাজ নাও করতে পারে। তাই অমিক্রনের সংক্রমণ প্রতিহত করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, যেহেতু লক্ষ লক্ষ মানুষ এতে আক্রান্ত হচ্ছেন; তাই যাদের শরীরে নানা রোগ-ব্যাধি আছে, বা যারা বয়স্ক তারা ভ্যাকসিন নিলেও এই সংক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকার্যকর হয়ে এখন বা পরবর্তীতে মৃত্যুঝুঁকিতে পড়তে পারেন। 
তৃতীয়ত, অমিক্রনের রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসা দিলে অন্য গুরুতর রোগীরা চিকিৎসাসেবা না পাওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারেন, যা বৈশ্বিক মৃত্যুর হার বাড়িয়ে দিতে পারে। 
চতুর্থত, দীর্ঘ দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করা চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্যকর্মী, ও জনস্বাস্থ্য গবেষকরা শারীরিক ও মানসিক অবসাদের শীর্ষে অবস্থান করছেন, যা ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক অবসাদের সৃষ্টি করতে পারে। 
যদিও এখন পর্যন্ত অমিক্রনে মৃত্যু এবং হাসপাতালে ভর্তির হার ডেল্টার অর্ধেক, কিন্তু যেহেতু সংক্রমণের হার ডেল্টার চাইতে বেশি সুতরাং আদতে মৃত্যুর হার ও হাসপাতালে ভর্তির হার ডেল্টাকেও অতিদ্রুত ছাড়িয়ে যেতে পারে যা সারাবিশ্বকে দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়ের দিকে ঢেলে দিতে পারে। 
সুতরাং, যদি আপনার ভ্যাকসিনের শেষ ডোজ ৬ মাসের পুরনো হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে সুযোগ থাকলে নতুন ডোজ ভ্যাকসিন নিয়ে নিন। পরিবারের সদস্য ব্যতিরেকে অন্যদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন, সুযোগ থাকলে অফিস আদালত অনলাইনে চালু রাখুন, কারও ছয় ফুটের কাছাকাছি আসার সম্ভাবনা থাকলে মাস্ক পরুন।

ড. শামীম আহমেদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সামাজিক-বিজ্ঞান গবেষক।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ