আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

সত্যেন সেন তার কাজ করে গেছেন, আমরা পারছি না

ইমতিয়াজ মাহমুদ  

সত্যেন সেনের সাথে আমার প্রথম পরিচয়ের গল্পটা বলি। আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, কেন্দ্রীয় জুনিয়ার হাই স্কুলে। কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলায় স্কুলটা তখন মাত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সিক্স-সেভেন-এইট তিনটা ক্লাসে পড়ানো শুরু হয়েছে, চিরিঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের যে বিল্ডিঙটা, সেই বিল্ডিঙের পেছনে ছনের চাল দেওয়া পাঁচ রুমের একটা মাটির ঘর। তিনটা ক্লাস রুম, একটা মেয়েদের কমন রুম আরেকটা অফিস ঘর আর সামনে ছোট একটা মাঠের মতো, ব্যাস। আমি যেবছর ক্লাস সিক্সে ভর্তি হই তার আগের বছর বা তার আগের বছর মাত্র স্কুলটা শুরু হয়েছে। সেসময় চকরিয়ায় সেরা স্কুল ছিল চকরিয়া হাই স্কুল, আমাদের স্কুলটা নতুন। আরেকটা স্কুলের নাম শুনতাম, ইলিশিয়া হাই স্কুল, ওটাও ভাল ছিল।

নতুন স্কুল, শিক্ষকরাও সব নতুন। শঙ্কর স্যার ছিলেন হেড মাস্টার, মুখ ভর্তি দাঁড়ি আর খুব কড়া। বেত দিয়ে আমাকে একবার কী পেটানোটাই না পিটিয়েছিলেন! উফ মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। শঙ্কর স্যার এখন কোথায় আছেন কেমন আছেন জানি না। স্যার আপনি যদি এই পোস্টটা দেখেন কোন না কোনোভাবে, তাইলে বলে রাখি, পিটিয়েছিলেন বলে আপনার প্রতি আমার মোটেই কোন রাগ নেই। এখন আমরা জানি যে বাচ্চাদেরকে পেটানো কোন ভাল শিক্ষাদান বা শৃঙ্খলা রক্ষার পদ্ধতি না। কিন্তু তখন সেই পদ্ধতিই চালু ছিল। শঙ্কর স্যারকে এখনো আমি স্মরণ করি পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। তিনি আমাদের ভূগোল পড়াতেন, আর সম্ভবত ইংরেজি পড়াতেন। ইংরেজির কথা মনে নেই, ভূগোলের কথা মনে আছে। বেত দিয়ে পেটানোর ঘটনাটা ভূগোল ক্লাসেই ঘটেছিল।

সেই স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা এসব হয়েছে। আমি তো খেলাধুলায় খুবই দক্ষ, তবে অংশ নিতাম না। আমার বন্ধুরা ছিল সব ভীষণ দুষ্ট, আমি দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিলে ওরা ছোটলোকের মতো দৌড়ে আমাকে পেছনে ফেলে চলে যেত। গান আবৃত্তি এইসবও করতাম না। যদিও আমার ধারনা আমার সংগীত প্রতিভা খুবই উঁচু মানের। তারপরও সেবার কিসে যেন দুইটা পুরস্কার পেয়েছি। নির্ঘাত যেমন খুশি সাজো সেইটা অথবা চোখে বেঁধে একটা লাঠি হাতে নিয়ে যে হাঁড়ি ভাঙতে হয় সেটা হবে। কেননা এই দুইটাতে আমি অংশ নিতাম, পুরস্কারও পেয়েছি বেশ কয়েকবার। পুরস্কার হিসাবে পেয়েছিলাম দুইটা বই, এই দুইটা বইয়ের একটা ছিল সত্যেন সেনের লেখা।


পুরস্কার বিতরণী যখন হয় তখন সন্ধ্যা। গিয়াস স্যার নাকি হুমায়ুন স্যারকে যেন একজন মাইকে নাম ডাকছিলেন, নাম ডাকলে সামনে গিয়ে পুরস্কার গ্রহণ করতে হবে। স্কুলের সামনে ছোট মাঠে পুরস্কার বিতরণ হচ্ছিল, স্কুলের সব ছেলেমেয়েরা আছে, বাইরের কিছু বড় বড় ছেলে ছিল। আমি গেছি, পুরস্কার নিয়ে ফিরেছি ভিড়ের মধ্যে কে যেন আমাকে বললে, দেখি দেখি তোকে কী দিয়েছে? বলে আমার হাত থেকে বইটা নিয়ে সেই যে ভিড়ে হারিয়ে গেছে অদ্যাবধি আমি মনে করতে পারি না

আমার বইটা কে নিয়েছে। কেননা আমি তখন বইটার মলাট উল্টে পুস্তানির পৃষ্ঠাটাতে লেখা আমার নাম, কেন পুরস্কার দেওয়া হয়েছে সেসব দেখছি। আমার হাত থেকে বইটা কে নিয়েছে তার চেহারা আর আমার দেখা হয়নি।

আমার কেবল মনে আছে বইটার নাম ছিল নগরীর ইতিকথা আর লেখকের নাম সত্যেন সেন। জিনিসপত্র হারালে আমার এমনিতে মনে দুঃখ লাগে না, কিন্তু সেই বইটি হারানোতে সেদিন শিশুমনে যে দুঃখ পেয়েছিলাম সেকথা আমি জীবনেও ভুলিনি। আর লেখক সত্যেন সেনের সাথে আমার সেইটাই প্রথম পরিচয়- অসম্পূর্ণ ভিড়ের মধ্যে কেবল হাই-হ্যালো বলার মতো পরিচয় জনবহুল কোন কর্মসূচিতে কেমন আছেন ভালো আছি বলে হাত ঝেঁকে দেওয়ার মতো অস্পষ্ট পরিচয়। কেবল জানা যে সত্যেন সেন নামে একজন লেখক আছেন।

সে বছরই আরেকটা বই পেয়েছিলাম সেটাও সত্যেন সেনেরই লেখা, পাপের সন্তান। বইটা কি আমিই পেয়েছিলাম নাকি ভাইয়া পেয়েছিল পুরস্কার হিসাবে, নাকি আমি আজিজিয়া বুক ডিপো থেকে কিনেছিলাম নাকি মুক্তধারা থেকে ভিপি ডাকযোগে আনিয়েছিলাম সেটা মনে নাই। এই পাপের সন্তানই আমার পড়া সত্যেন সেনের প্রথম বই। দ্বিতীয় বই মশলার যুদ্ধ। নগরীর ইতিকথা আমি পরে পড়েছি, পাপের সন্তান আর সেই বইটা ছিল সিক্যুয়াল। ইসরাইল, ইহুদি আর জেরুজালেম নিয়ে ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস। সত্যেন সেন রচনাবলী কিনেছি আমি এই কদিন আগে, বাতিঘরে গিয়ে সস্তায় পেয়ে কিনে ফেলেছি। এখন রচনাবলীও আছে, আর আলাদা করে বেশ কয়েকটা বইও আছে।


সত্যেন সেনের অন্য একটা পরিচয় তো আছেই। তিনি কম্যুনিস্ট ছিলেন, কৃষক নেতা ছিলেন- উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেন। উদীচীর প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তাঁর সাথে রণেশ দাশগুপ্ত আর শহিদুল্লাহ কায়সার এরাও ছিলেন। সত্যেন সেন গান লিখেছেন। গানে গানে জাগরণ তৈরির সংগ্রাম করেছেন। আজীবন নিষ্ঠাবান মার্ক্সবাদী বিপ্লবী সত্যেন সেনকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পর অনেকদিন জেল খেটেছেন। শারীরিকভাবে খুব শক্ত মানুষ ছিলেন না তিনি, কিন্তু কী অফুরন্ত প্রাণশক্তিই না ছিল সত্যেন সেনের! আর দেশের প্রতি মানুষের প্রতি অবিচল ভালোবাসা। তাঁর জীবনের প্রতিটা অধ্যায়ই একেকটা যেন নাটকীয় ও রোমাঞ্চকর গাথা। আমি বলব যে সত্যেন সেনের এই রাজনৈতিক পরিচয়কে যেন ছাপিয়ে গেছে তাঁর লেখক পরিচয়।

মুশকিল হচ্ছে যে সত্যেন সেনের লেখা আমরা ঠিকমত নিয়ে যেতে পারিনি তরুণদের কাছে। সত্যেন সেনের লেখা একজন তরুণকে জীবনের শুরুতেই দিতে পারে জীবন সম্পর্কে, পৃথিবী সম্পর্কে একটি সঠিক দৃষ্টি। ইতিহাস দেখার, ইতিহাস পাঠ করার এবং ফলত ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারণের যথার্থ সঠিক পথের দিশা। এই কাজটা করা জরুরি ছিল। আমাদের জন্যে তো জরুরি বটেই, রাষ্ট্রের জন্যেও জরুরি ছিল আমাদের শিশু কিশোরদের সাথে সত্যেন সেনের পরিচয় করিয়ে দেওয়া, ওঁর লেখা যেন ছেলেমেয়েরা পড়তে পায় সেই ব্যবস্থা করা। না, ছেলেমেয়েদেরকে কম্যুনিস্ট বানানোর জন্যে নয়- শুদ্ধ একটা অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধ ও মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা শ্রদ্ধা এই বিষয়গুলো তো শিশু কিশোরদেরকে শেখানো জরুরি।

সত্যেন সেন আমার নিতান্ত আপনজন- সত্যেন সেনের সাথে আমার কখনো সাক্ষাৎ হয়নি, কিন্তু সত্যেন সেনের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয় প্রতিদিন প্রতিনিয়ত। তিনি তো তাঁর কাজটি করে গেছেন, আমরা তো করতে পারছি না আমাদের কাজটি।

ইমতিয়াজ মাহমুদ, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ