আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

মানুষের কষ্টে নির্বিকার ‘না-মানুষ’

কবির য়াহমদ  

ছয়দিনের বেশি সময় ধরে অনশনে অসুস্থ শিক্ষার্থীরা। কেউ উপাচার্যের বাসভবনের সামনে, কেউ হাসপাতালের বেডে শুয়ে; সবাই অভুক্ত। উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে অনড়। এক দফা এক দাবি তাদের—উপাচার্যের পদত্যাগ। কেউ ভাবেনি এত দীর্ঘ সময় ধরে তারা অনশন চালিয়ে যাবে। কঠিন, অমানবিক বাস্তবতা এটাই। যারা হাসপাতালে তাদের শরীরে সূচ, স্যালাইনের; যারা ক্যাম্পাসে তাদের অনেকেরও একই অবস্থা। তবু তারা খাবার গ্রহণ করছে না। তারুণ্যের ইস্পাত-দৃঢ় সংকল্প—হয় উপাচার্যের পদত্যাগ, নয়ত মৃত্যু। আকাঙ্ক্ষা ও পরিণতির বিপরীতধর্মী দুই ভবিতব্য! দূর থেকে আমরা অনিশ্চয়তায়; আমরা যেখানে দিন আর ঘণ্টার হিসাবে, তারা সেখানে অসহনীয় অবস্থায় তিলে তিলে এগিয়ে চলেছে মৃত্যুর মুখে। মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত যদিও, তবু উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ও সরকারের অবস্থান আমাদেরকে শঙ্কার মুখে ফেলে দিয়েছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনশনরত শিক্ষার্থীদের জীবনের চাইতে বেশি মূল্য উপাচার্যের; সভ্য সমাজে অপ্রত্যাশিত ঘটনা হলেও বাস্তবতা অদ্য এটাই।

ছোট্ট একটা দাবি থেকে এমন প্রাণসংহারী পরিস্থিতি তৈরি হবে কে জানত! দায় নিশ্চিতভাবেই উপাচার্যের। প্রশাসক হিসেবে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি নজিরবিহীন পুলিশি হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের জীবন-ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছেন। এ নিয়ে তার বিকার নেই। তার মত নির্বিকার শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। সরকারের দায়িত্বশীল অবস্থানে থেকেও তার যে ভূমিকা এটা প্রত্যাশিত নয়। তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার একটা অংশ মঞ্চস্থ করে চুপ হয়ে আছেন। শিক্ষার্থীরা তার কাছে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে। তিনি তাদের দাবির প্রতি সম্মান দেখাননি, মন্তব্য করেননি পদত্যাগ কিংবা অপসারণ বিষয়ে। তবে তিনি উপাচার্যের পক্ষ নিয়ে শিক্ষার্থীদের অনশন ভঙ্গের অনুরোধ করেছেন। অনশনে থাকা শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্য তাকে সামান্য স্পর্শ করতে পারেনি। মানুষ হিসেবে মানবিক আচরণ করেননি তাদের প্রতি। ‘ইগো’ কি বর্তমান এখানে—প্রশ্ন জাগছে? তিনি কি ভেবেছিলেন ঢাকার বাইরের প্রান্তিক এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীর আন্দোলনে কেন তিনি উতলা হবেন, কেন মানবেন তাদের দাবি? কেন দেখতে যাবেন তাদের, যদিও বলেছেন পারিবারিক সমস্যার কথা!

গত শনিবারের গভীর রাতের ভিডিয়ো কনফারেন্সের পর রোববার ফের আলোচনার কথা ছিল। হয়নি। সোমবার এবং মঙ্গলবারও শিক্ষার্থীরা অপেক্ষা করেছিল। মন্ত্রীর পক্ষ থেকে সাড়া আসেনি। কেন আসেনি? এই সময়ে বিভিন্ন টেলিভিশনে, সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এবং শিক্ষা উপমন্ত্রী আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেছেন। ‘তৃতীয়পক্ষের ইন্ধন’ দেখেছেন। এটা যেকোনো আন্দোলনের বিরুদ্ধে শাসকদের চিরায়ত মুখস্থ বুলি। অথচ টানা আন্দোলনের তেরোদিন এবং আমরণ অনশনের টানা ছয়দিনেও আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে সরকারবিরোধী কোন স্লোগান আসেনি। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সচেতনভাবে তাদের দাবির কথা জানিয়েছে। এই আন্দোলন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেজন্যে তারা প্রকাশ্যে সকল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফেসবুক লাইভেও সে সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়াকে প্রচার করেছে।

উপাচার্য আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের শত্রু ভাবছেন। দীর্ঘ অনশনের এই সময়ে উপাচার্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে চাননি। অথচ অনশন চলছে তার বাসভবনের ঠিক সামনেই। আন্দোলনরতরা অহিংস, তার ওপর শারীরিক আক্রমণের কোন শঙ্কা নেই জেনেও তিনি নির্বিকার। সরকারের ওপর ভরসা করে অনশনরত শিক্ষার্থীদের প্রাণ সংশয়ের শঙ্কা সত্ত্বেও তিনি কথা বলার ইচ্ছাপোষণ করেননি। এই বুঝি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ‘অভিভাবকত্ব’!

অথচ সময়ে-সময়ে আমরা বলতে শুনি শিক্ষার্থীরা ‘সন্তানসম’ আমাদের। এটা মুখস্থ বুলি। শিক্ষার্থী মানেই কি সন্তানতুল্য কেউ? বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের আপনি যখন সন্তান আওড়ে তাদের দাবিদাওয়াকে পাশ কাটিয়ে উপদেশ দিতে বসেন তখন নিশ্চিত আপনার-আপনাদের বদমতলব আছে।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যারা লেখাপড়া করে তাদের শারীরিক-মানসিক অবস্থা প্রাথমিক অথবা মাধ্যমিক পর্যায়ের নয়। তাদের প্রতি আপনাদের মনোভঙ্গিও ওই পর্যায়ে থাকা উচিত। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের যা যেভাবে বলা যায়, মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্যে ওটা আরেকটু আলাদা, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্যে তারচেয়েও আলাদা। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সম্বোধনে-পরামর্শে যদি উল্লিখিত স্তরের অনুশীলন হয় তবে নিশ্চিত আপনি-আপনারা সবকিছু গুলিয়ে ফেলছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক কিংবা মন্ত্রী অথবা অন্য কেউ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘সন্তানতুল্য’ দাবি করে নিজেদের ‘মাতৃত্ব’, ‘পিতৃত্ব’ ও ‘অভিভাবকত্বের’ পরিচয়কে সামনে আনে তখন অবাক হয়ে যাই। আরও বেশি অবাক হই যখন ‘মন্ত্রিত্বকে’ ছাপিয়ে কেউ যখন ‘মাতৃত্ব’ আর ‘পিতৃত্বের’ নাম জপ করে। যদিও জানি ওটা সম্পর্কের সংবেদনশীল রূপের প্রকাশের স্বার্থে, তবু শেষ পর্যন্ত এটা যে স্রেফ কৌশলী অবস্থান তা বুঝতে বাকি থাকে না।

বিশ্বাস করি ও বিশ্বাসে অটল থাকতে চাই যে, মন্ত্রিসভার দায়িত্বশীলেরা মন্ত্রিত্বের দায়িত্বে। শাবিপ্রবি পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে মন্ত্রিত্বের বাইরে তারা মাতৃত্ব, পিতৃত্ব ও অভিভাবকত্ব নিয়েও প্রচারে। আয়নার অস্তিত্বের কথা কি বেমালুম ভুলে যাওয়া হচ্ছে আমাদের?

সমস্যা সমাধানে মাতৃত্ব, পিতৃত্ব, অভিভাবকত্ব শীর্ষক সংবেদনশীলতা উল্লেখ জরুরি নয়। জরুরি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের জীবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ। এখানে ইগো সঙ্কটকে মুখ্য হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার দরকার নাই। যে উপাচার্য ছোট্ট একটা ছাত্রীহলের সামান্য দাবিকে ম্যানেজ করতে না পেরে জাতীয় ইস্যু বানিয়ে ফেলেন তার প্রতি সরকারের সমর্থন অব্যাহত রাখার যুক্তি দেখি না। এই সমর্থন অব্যাহত রাখা মানে সরকারকে বিতর্কিত করা।

যত সময় যাচ্ছে অনশনরত শিক্ষার্থীদের জীবন সংশয়ের মুখে ততবেশি পড়েছে। একই সঙ্গে সরকার ক্রমেই বিতর্কিত হচ্ছে। উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের ব্যর্থতা, অযোগ্যতার দায় এখন সরকারের ঘাড়েই চলে যাচ্ছে। সময় থাকতে সময়ের মূল্য দিন। শিক্ষার্থীদের বাঁচান; শাবিপ্রবিকে বাঁচান। মানুষের কষ্টে ‘না-মানুষ’ রূপ স্থানীয় দায়িত্বশীলরাও যেন নির্বিকার থাকতে না পারে তার ব্যবস্থা নিন।

কবির য়াহমদ, প্রধান সম্পাদক, সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর; ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ