আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

দেশের বিরুদ্ধে বিদেশি লবিস্ট নিয়োগ কতটা যৌক্তিক?

ড. শামীম আহমেদ  

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী র‍্যাবকে ‘নিয়মবহির্ভূত’ কর্মকাণ্ডের জন্য নিষিদ্ধ করেছে। সাথে সাথে র‍্যাবে কর্মরত সেনাবাহিনীর ৭ জন কর্মকর্তাকেও তারা তাদের দেশে নিষিদ্ধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কোন দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া বেশ একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। তাদের এই অবস্থান কোন রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির গ্রহণযোগ্যতার চাইতে তাদের নিজেদের স্বার্থের সাথে উক্ত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অবস্থানের সাংঘর্ষিক অবস্থানের ভিত্তিতেই বেশি নির্ধারিত হয়। এছাড়াও বিভিন্ন দেশে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী অনেক সময় লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতাদের প্রভাবিত করে নিজের দেশের সরকারকে চাপে ফেলার চেষ্টা করে।

যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বিধায়, তাদের যেকোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা পৃথিবীর বেশিরভাগ রাষ্ট্রকে চাপে ফেলতে বাধ্য। যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত যৌক্তিক কিনা সেই বিবেচনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধোপে টেকে না। অর্থ ও অস্ত্রের শক্তিতে তারা অনেক কিছুই করতে পারে যা আমরা বিগত অনেক দশক ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্তে দেখে আসছি। এটি সত্য যে লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে আইনপ্রণেতাদের প্রভাবিত করা যুক্তরাষ্ট্রে বৈধ। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫০০টির মতো নিবন্ধনকৃত লবিস্ট ফার্ম আছে বলে জানা যায়। এরা অর্থের বিনিময়ে নানা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এমনকি বিদেশি রাষ্ট্রের পক্ষে বা বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতাদের তথ্য-উপাত্ত দিয়ে নানা সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করে। অনেকক্ষেত্রে জনমত গঠনের জন্যেও লবিস্ট ফার্ম কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্রের লবিস্ট ফার্মগুলোকে সে দেশের ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিসের কাছে নিবন্ধন করে ব্যবসা পরিচালনা করতে হয়। এদের কাজকর্ম যে জবাবদিহিতার বাইরে তা নয়। ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিসের ন্যাশনাল সিকিউরিটি ডিভিশান এসব ফার্মের কাজ তদারকি করে।

যুক্তরাষ্ট্রে লবিং বৈধ হলেও বাংলাদেশে তা বৈধ নয়। সুতরাং বাংলাদেশি কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক দল যদি দেশের অর্থ বিনিয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করে, তবে তাদের কাজের স্বচ্ছতা, সে কাজ রাষ্ট্রবিরোধী কিনা সেটা যাচাই করা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সরকার বা সংসদের আছে বলে মনে করি। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি বিরোধী দল বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে তারা গত ৩ বছরে ৩ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ডলার বা ৩২ কোটি টাকা খরচ করে যুক্তরাষ্ট্রে তিনটি লবিস্ট প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করেছে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য। আপাত দৃষ্টিতে সরকারের বিরুদ্ধে মনে হলেও রাষ্ট্র ও সরকার অনেক সময় কাছাকাছি অবস্থান করে। র‍্যাবকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নিষিদ্ধ করা সরকারবিরোধী উদ্যোগ মনে হলেও বিদেশে এটি বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করছে। আমেরিকা, ক্যানাডা বা যুক্তরাজ্য কিংবা ফ্রান্স অথবা জার্মানিতে এ বিষয়ে যখন আলোচনা হচ্ছে, তখন কেউ আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করছে না, সবাই বলছে বাংলাদেশের একটি সন্ত্রাসী সংগঠন র‍্যাব নিষিদ্ধ হয়েছে। এতে করে বিএনপির সরকার পতনের ষড়যন্ত্র কতটা বাস্তবায়িত হবে বলা কঠিন, কিন্তু বাংলাদেশের ভূমিকা যে কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

রপ্তানির জন্য বাংলাদেশ মূলত নর্থ আমেরিকা ও ইউরোপের যেসব দেশের উপর নির্ভরশীল, তারা ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো প্রায় সবসময় আওয়ামী লীগ সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের লবিস্টরা শুধুমাত্র নিজের দেশকেই না বরঞ্চ পৃথিবীর নানা ক্ষমতাধর দেশকে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম। যদিও বাংলাদেশ দীর্ঘদিনের বন্ধু ভারত আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত, কংগ্রেসের সাথে তাদের যে সখ্যতা, বিজেপির সাথে ততটা নয়। এছাড়াও ভারত সবসময় একটি নতজানু আওয়ামী নেতৃত্বের পক্ষে, নতজানু বাংলাদেশের পক্ষে। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অনেকটাই উদ্ধত, ফলশ্রুতিতে বিজেপি সরকারের ভারতও যে এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষাবলম্বন করছে না, তা বলা যাবে না। দেশের অভ্যন্তরে কিছু মেগা প্রজেক্টে সংশ্লিষ্টতার কারণে রাশিয়া বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক পর্যায়ে বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু ইউক্রেনে বিরাজমান অস্থিরতা নিয়ে রাশিয়া নিজেই এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের নানা দেশের সাথে প্রায় যুদ্ধাবস্থায় রয়েছে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের সাথে বন্ধুভাবাপন্ন হলেও তাদের পক্ষে এই মুহূর্তে তাদের সমর্থন উন্মুক্তভাবে প্রকাশ করা সম্ভব না বলেই ধারণা করি। তবে চীন খুব শক্তভাবেই বাংলাদেশের পাশে আছে বলে মনে হয়। জাপানও শান্তিপূর্ণ বন্ধুত্ব বজায় রেখেছে। কিন্তু শুধু চীন ও জাপানের সাথে বন্ধুত্বের উপর ভরসা রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক অবস্থানে যাওয়া দেশের জন্য সমীচীন হবে না।

বাংলাদেশের প্রভাবশালী মন্ত্রীরা যুক্তরাষ্ট্রের এই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক নিষেধাজ্ঞাকে জনতার সামনে তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছেন। অনেক সময় অশোভনভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে আক্রমণও করছেন। অনেকেই এতে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন। আমি অবশ্য এতে অত চিন্তিত নই। একটি নব্য মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কিছুটা ঔদ্ধত্য দেখানো সঠিক বলেই মনে করি। যুক্তরাষ্ট্রও এইসব পলিটিকাল ‘স্টান্টবাজি’ দেখে অভ্যস্ত। একটি দেশের এমপি মন্ত্রীরা যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি ধমকিতে মিইয়ে গেলে তা কোন কাজের কথা নয়। মনে রাখতে হবে এটি বাংলাদেশ, পাকিস্তান নয়। এখন বাংলাদেশ সারাবিশ্বে উন্নয়ন-বিস্ময় হিসেবে পরিচিত, এতটুকু ঔদ্ধত্য আমাদের মানায়। অন্যদিকে পর্দার আড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আপোষ-রফার উদ্যোগ আছে বলে মনে করি। এই কর্মতৎপরতা জারি রাখতে হবে। যেহেতু বিদেশি রাষ্ট্র থেকে লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে হাজার হাজার কোটি টাকা প্রবেশ করে, তাই নিজেদের লবিস্টদের প্রভাবকে বিবেচনায় এনে এই ‘কাঁচা টাকা আমদানি’ বাণিজ্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ – এটি বুঝতে হবে। আবার লবিস্টদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র কোন দেশের সরকার পতন করে দিবে – এটা ভাবা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সরাসরি স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ে বিরোধিতায় জড়াচ্ছে একটি দেশ, ততক্ষণ পর্যন্ত শুধু তাদের বিরোধী দলের টাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্র কোন বড় ভূমিকা নেবে বলে মনে করি না। এতটুকু বোঝার ক্ষমতা বর্তমান সরকারের আছে, এবং তারা সে অনুযায়ী এগুচ্ছে বলেও প্রত্যাশা করি।

কিন্তু দিনের শেষে বাংলাদেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির অন্তঃসারশূন্যতা আমাদের হতাশ করে। দেশের ৩২ কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রে পাচার না করে যদি তারা এই টাকা দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে ব্যয় করত, তা বরঞ্চ দেশের অভ্যন্তরে তাদের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সাহায্য করত। বিএনপির রাষ্ট্র বিরোধিতার এই দলিল দস্তাবেজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এসে পৌঁছেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও একটি দেশের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল যখন শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থে, ক্ষমতায় যাবার জন্য সরকার পতনের আকাঙ্ক্ষায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে, তখন তাতে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। আমি মনে করি দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে লবিস্ট নিয়োগ করা থামানোর জন্য সংসদে আইন প্রণয়ন করা দরকার। ভবিষ্যতে যেকোনো রাজনৈতিক দল যদি শুধুমাত্র ক্ষমতায় যাবার লোভে দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাহলে যাতে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া যায়, তাই এই আইন প্রণয়ন করা এখন অত্যন্ত জরুরি।

ড. শামীম আহমেদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সামাজিক-বিজ্ঞান গবেষক।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ