আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

অনলাইনের সুখ-দুঃখ অথবা সংস্কৃতি

মাসকাওয়াথ আহসান  

মানুষের কতরকম দুঃখ থাকে! প্রথমে লিটলম্যাগ এরপর জাতীয় দৈনিক হয়ে ব্লগ; লেখালেখির প্রতিটি ধাপই পরখ করে ব্লগে গিয়ে প্রথম ধাক্কা খাই। একই লেখা যার জন্য ভোরের কাগজে অসংখ্য চিঠি আসতো পাঠক বন্ধুদের; ফেসবুকে লিখলে অসংখ্য বন্ধু প্রতিক্রিয়া দেয় ইতিবাচকভাবে; সেই একই লেখা ব্লগে দিলে সকালে 'প্রশংসা', সন্ধ্যায় 'নিন্দা-র ঝড়'; এর কারণ কী! সেটা খুঁজেছি গত কয়েকবছর ধরে। যুক্তিহীন ভিন্নমতের গালাগালি তো কোন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা হতে পারে না।

আমার অরিয়েন্টেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির। সেখানে কেউ কোনদিন গরম চোখ করে তাকায়নি। প্রশ্নই ওঠেনি। পেশাজীবনে স্বোপার্জিত স্বাধীনতার সামনে দ্য-এডিটর বিতর্ক কনসার্ট সাতদিন ধরে করে আবার ও এলাকায় কাটিয়ে দেখলাম; একই উষ্ণতা। যেটা ফেসবুকে হুবহু একই। কারণ অধিকাংশ মানুষই জানে বিতর্ক-লেখালেখি; এগুলোর চর্চা মানুষ করে আনন্দ খুঁজতে। লেবুটাকে চিপে তেতো করতে নয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেলিম আল দীন স্যারের কাছে পড়তে গিয়ে সেখানকার এম্ফিথিয়েটারের সিঁড়িতে বসলাম কিংবা ডেইরি মোড়ের আড্ডায় দেখলাম, ঠিক ঢাকা ইউনিভার্সিটির মৌতাত। বন্ধুত্বের আয়োজন সর্বত্র। ফেসবুকে এই দুই ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা জুটে যাওয়ায় বয়স আমার কিছুতেই বাড়ে না। রাঙ দে বাসন্তী স্টাইলে মাস্তি কী পাঠশালা এক। শুধু ইউনিভার্সিটি নয়, বিতর্কের জগতের বন্ধু, সিভিল সার্ভিসের আড্ডার বন্ধু, বাংলাদেশ বেতারের আড্ডা, ভোরের কাগজের আড্ডা, আজিজ সুপার মার্কেটের বন্ধু, ঈশ্বরদী-রাজশাহীর বন্ধু, এমনকি অন্যদেশের অ-বাংলাভাষী বন্ধুরা সব সবুজ বাতি জ্বেলে বলে, ম্যায় হুঁ না।

এ কারণে বিতর্ক বলতে যারা কচলা-কচলি বোঝেন, তাদের সঙ্গে ব্লগের লেবু চিপাচিপি আমার পোষায়নি। ব্লগের সমস্যা হচ্ছে, একটা সাহিত্য-ঘন ছেলেকে বাপ-মা জোর করে মাদ্রাসা, ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা কৃষিতে পড়িয়েছে; সেই ঝাল তারা ঝাড়ে পোস্টদাতার ওপর। ভারতে এসব ছেলে স্ট্যান্ড আপ কমেডি করে। আর আমাদের দেশে এই নিজের পছন্দের বিষয়ে পড়তে না পারা ছেলেমেয়েগুলো ব্লগে এসে ঝগড়া করে জীবন তেতো করে দেয়। আমাদের যুগে যারা মুখে বিসিএস গাইড মুখে হলে বসে থাকতো, আমরা র‍্যালা করতে করতে বারান্দা দিয়ে হেঁটে গেলে; যেভাগে ইভিল আইজ প্রসারিত করে তাকাতো; ব্লগের সিরিয়াস রাইটারদের চোখগুলো তেমনই। এই চোখগুলো দেখতে পাই না; কিন্তু কল্পনা করতে পারি।

আমার আব্বা বলতেন, পৃথিবীতে দুধরনের অভিভাবক থাকে। ফ্রেন্ডলি অভিভাবক আর সিরিয়াস গার্ডিয়ান। একদল জীবন উদযাপন করে; আরেকদল টেনশন করে। এই যে যারা মোটিভেশনাল স্পিকার হয়ে এসে বলে, চ্যালেঞ্জ নিতে শেখো; তোমাকে সফল হতে হবে! এরা সিরিয়াস গার্জেনের ছেলে-মেয়ে। ওই যে কিছু বাবা আছেন, যারা বলেন তোমাকে ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তার হতে হবে, সর্বোপরি শ্রেষ্ঠ হবে; এদের ছেলেমেয়েগুলো ফেসবুক ও ব্লগে এসে রাগারাগি করে। এই প্রজন্মের শিশুরা যেহেতু থোড়াই কেয়ার করে, বাপ-মার সিরিয়াসনেসকে পাত্তা দেয় না; সেই সব পাত্তা না পাওয়া পিতা-মাতা ফেসবুকে ব্লগে আমাদের সিরিয়াস বাবা-মা হয়ে আসেন যেন!

ফেসবুকে ব্লগে দেখবেন, কিছু লোক আপনাকে এসে ধর্মপ্রেম, দেশপ্রেম শেখাবে, কোনটা করা উচিত কোনটা করা উচিত না শেখাবে। আমার অসহ্য লাগে এ কারণে যে, আমার আব্বা-আম্মা কোনদিন এতো উচিত-অনুচিতের শিক্ষা দেয়নি। বলেছেন, নিজের বিবেচনা দিয়ে বুঝে দেখবে কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক। আমরা ঠিক করে দেবো কেন! আব্বা বলতেন, জীবন হচ্ছে শিল্পের মতো; একে প্রতিদিন উদযাপন করতে হয়।

আম্মা দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফলে কনজারভেটিভ, তাই নারী বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশায় নানা লক্ষণরেখা টেনে দিতেন। অথচ আব্বা জিজ্ঞেস করতেন, লেটেস্ট গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে কেমন যাচ্ছে বন্ধুত্ব। আব্বা তো ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে আমার কাছের ফিমেল ফ্রেন্ডদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন। পরে তাদেরকে ফোন করে আমার গতিবিধির দিকে খেয়াল রাখতেন। ফলে আমার পক্ষে সিরিয়াসনেস টলারেট করা অসম্ভব। ব্লগে-ফেসবুকে যে সব সিরিয়াস বন্ধুর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছে; তাদেরকে আমি এখনো ভালোবাসি। কিন্তু তিক্ততা এড়িয়ে চলতে তাদের সঙ্গে মিউচুয়াল সেপারেশন নিয়েছি। তিক্ত সম্পর্কে জীবন কাটানোর চেয়ে দূরে থেকে সারাজীবন মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হয়ে থাকাই শ্রেয়।

সম্প্রতি কবির সুমন রিপাবলিক জেনোসাইডাল টিভির সাংবাদিককে 'মা' তুলে গালি দেয়ায়; ফেসবুকে সুমনকে বাতিল বা খারিজ করে দিলো যারা, তাদের পাঁচজনের সঙ্গে কথা হলো। চারজন ছেলে, একজন মেয়ে। এরা আরেকজনের পোস্টে আমার করা মন্তব্যের প্রত্যুত্তরে অযাচিতভাবে এসে সুমনকে গালাগাল ও বাতিল করে দিলো। পাঁচজনই শিক্ষিত কিন্তু এটা জানে না, ফেসবুকে রিপ্লাইয়ের ঘরে কেবল পোস্টদাতার লেখার কথা। এটাই গ্লোবাল এটিকেট। ফেসবুক তো কলতলা না যে অপরিচিত লোকের ওপর উদুম-পুদুম করে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।

এই এটিকেট না জানা মানেই রাজনৈতিক দলের কর্মী; এতো সবার জানা। আর কবির সুমনের ওপর রাগ শিবসেনার হবার কথা; যেহেতু রিপাবলিক তাদের টিভি। যেমন একাত্তর টিভির সমালোচনা করলে আওয়ামী লীগ কর্মী আপনাকে ছেড়ে দেবে না; নয়াদিগন্তের সমালোচনা করলে, শিবির আপনার দফার-রফা ফিশরোল করে দেবে। এদের সবার মাঝে কমন ফ্যাক্টর হচ্ছে, যেকোন কৃতি ব্যক্তির চরিত্রের দোষ দেখিয়ে খারিজ করে দেয়া। নিজেরা এক একজন পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতার পরাকাষ্ঠা যেন।

শিবসেনার যে ছেলেটি জাফর ইকবাল স্যার নয়াদিগন্ত টিভির রিপোর্টারকে বকা দেয়ায় খুশি, সেই সুমনের রিপাবলিক টিভি রিপোর্টারকে গালি দেয়ায় অখুশি। আবার শিবিরের যে ছেলে জাফর ইকবালকে সেবার ধুয়ে দিয়েছিলো; সেই এখন কবির সুমনের ভক্ত হয়ে উঠলো। এ কারণেই আমার কাছে শিবির ও শিবসেনাকে ছোটবেলায় মেলায় হারিয়ে যাওয়া যমজ ভাই বলে মনে হয়। কিন্তু একটি মেয়ে সুমনের চরিত্র তুলে গালি দিচ্ছিলো। আমি তার টাইমলাইনে গিয়ে দেখলাম, সে শিবির কিংবা শিবসেনা নয়; সে পুরুষতান্ত্রিক গালিতে অখুশি। আমার নিজেরও নারীর অপমানসূচক গালি অপছন্দ। মেয়েটা সবধর্মের মানুষের একসঙ্গে সুখে থাকার বারতা পোস্ট করেছে। আর একটা পোস্টে, তার এক্স-বয়ফ্রেন্ডকে গালি দিয়েছে; ঠিক যে ভাষায় সুমনকে গালি দিয়েছে সে। বুঝলাম, মানুষের কতরকম দুঃখ থাকে। তাই সাদা-কালোয় জাজ করা যায়না সবকিছু।

শিবিরেরও ব্যক্তিগত অপ্রাপ্তির বেদনার অভিজ্ঞতা আছে, বেদনা আছে শিবসেনারও, যেমন বেদনা আছে বিরহিণী মেয়েটির। জগতের সকল প্রাণি সুখি হোক।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ