প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ড. শামীম আহমেদ | ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
মহান ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর হয়ে গেল। আমার কেন জানি মনে হয় সময়ের ফেরে মহান ভাষা আন্দোলনের মূল বিষয়গুলো চাপা পড়ে গেছে। এখন ফেব্রুয়ারি মানেই বইমেলা, আড্ডা, প্রেম, মাসুদ রানা, ভালবাসা, রিকশায় ঘোরা, চটপটি আর চিংড়ির মাথা ভাজা খাওয়া। আরিফ আজাদের প্যারাডক্সিকাল সাজিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরের পর বছর শহিদ-সন্তানদের ট্যাক্সের টাকায় অর্থহীন উর্দু ভাষার অনার্স মাস্টার্স চালানো। গায়ে হলুদে হিন্দি গান, সামাজিক আড্ডায় ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করা শিক্ষার্থীদের সামনে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের মাথা নিচু করে থাকা।
সত্তর বছর পর একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করার অবকাশ আছে কি? আদিবাসী শিশুরা এবার বছরের শুরুতেই তাদের মাতৃভাষায় স্কুলের বই পেয়েছে। আমার বুকটা ভরে গেছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ধরণ নিয়ে প্রশ্ন আছে, ভালো কথা– কিন্তু নিজের দেশে দীর্ঘদিন অত্যাচারিত, নিপীড়িত আদিবাসী শিশুদের যে জোর করে বাংলা পড়ানো হতো, সেই পরিস্থিতি তো ওই শেখের বেটিই পাল্টালেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীনে গিয়েছি, নিজের কানে শুনেছি যে তারা নিজের ভাষায় পড়ালেখা করতে পারে না, জোর করে বাংলা পড়তে হয়। জোর করে বাংলা পড়ানো তো মহান ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল না! আজ দশ বছর পরে কিন্তু এখন চাকমা, মারমাসহ অনেক আদিবাসী ভাষায় বই ছাপিয়েছে আমাদের হাসিনার সরকার।
সত্তর বছর পর এই পরিবর্তনগুলো জরুরি। ২০১৩-তে পাকিস্তানে গিয়েছিলাম। একজন বাংলাদেশি হিসেবে করাচিতে ওই দেশের ২০টার বেশি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তাদের ন্যায্যতা, বৈষম্য, প্রতিবন্ধিতা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। বার বার তুলে ধরেছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর উন্নয়নের কথা, নারী শিক্ষার অগ্রগতির কথা। লাঞ্চে, ডিনারে, ব্রেকফাস্টে পাকিস্তানি নারীরা এসে আমাকে বলেছেন বাংলাদেশের উন্নয়ন তাদের ভাল লাগে। বলেছেন তাদের সেনাবাহিনী আর সরকারের ১৯৭১-এর অত্যাচার নিপীড়ন তারা সমর্থন করেন না। করাচির অলিতে গলিতে লাখ লাখ বাংলাদেশিকে দেখেছি, কথা বলেছি, যাদের অনেকে স্বেচ্ছায় থেকে গেছেন, অনেকে বাধ্য হয়ে থেকেছেন, ফিরতে পারেননি বাংলাদেশে। ঠিক যেমন মিরপুরে, গাইবান্ধায়, মোহাম্মদপুরে লাখ লাখ পাকিস্তানি রয়ে গেছে। এদের অনেককে শেখ হাসিনা পাসপোর্ট দিয়ে বাংলাদেশি হবার সুযোগ করে দিয়েছেন। এখন তাদের বাংলা সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিক্ষার আওতায় আনতে হবে। আপনি কি পারবেন ১০ লক্ষ উর্দুভাষীকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠাতে? পারবেন করাচির ১০ লাখ বাংলাভাষীকে ফেরত আনতে? পারবেন না। ৫০ বছর পর, এখন সবাইকে কীভাবে বাংলা শিখিয়ে, জানিয়ে, আত্তীকরণ করা যায়, তার একটা প্রয়াস নিতে হবে।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলন ছিল না। স্বাধিকারের আন্দোলন ছিল, স্বাধীনতার আন্দোলন ছিল। বাংলা ভাষার সাথে আদিবাসীদের ভাষার কোন শত্রুতা নেই। উর্দু ভাষার শত্রুতা নেই। ইংরেজি ভাষার শত্রুতা নেই। বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে আত্মায় ধারণ করে অন্য ভাষার চর্চায় দোষের কিছু নাই। হিন্দি বা উর্দুতে কাওয়ালি শুনলে সমস্যা নাই, কিন্তু সেটি যদি হয় মুক্তিযুদ্ধকে আঘাত করার অপচেষ্টা, তাতে সমস্যা। পাকিস্তান ভারতের খেলায় পাকিস্তানকে সমর্থন করলে সমস্যা নেই, কিন্তু বাংলাদেশের সাথে খেলায় পাকিস্তানের পতাকা উড়ালে অবশ্যই সমস্যা আছে। বাংলা ভাষাকে, বাংলা সংস্কৃতিকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছুতে হলে তা করতে হবে কূটনৈতিক মাধ্যমে। বিসিএসে সবচেয়ে ঝকঝকে মানুষগুলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান, তারপর তারা যা করেন তা আমরা পত্রিকায় দেখতে পাই। এতদিন ক্যানাডায় আছি, এত বড় একটা প্রভাবশালী দেশ, দেখলাম না বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে অর্থবহ কিছু করতে। এখানকার প্রতিনিধিত্বশীল মানুষদের উপস্থিতিতে দেশকে এগিয়ে নেয়ার কোন চেষ্টা নেই। শুধু নানা দিবসে ঢাকার মন্ত্রীদের নিয়ে গৎবাঁধা আলোচনা অনুষ্ঠান। জাতির জনকের স্মরণে কার্যক্রম থাকতে পারে, কিন্তু তার পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্মদিনে কেন একটি দেশের দূতাবাস অনুষ্ঠান করবে, বোঝা দুষ্কর। টরোন্টোতে একটা শহিদ মিনার হয়েছে। সেখানে সবাই জুতা পরে উঠে সেলফি দেন। এর বাইরে বুদ্ধিবৃত্তিক কোন আয়োজন দেখি না।
২০২২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভিন্ন। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন দেশ। মধ্যম আয়ের দেশ। ধাই ধাই করে উপরে উঠছে। শুধু বছর বছর দায়সারা অনুষ্ঠান, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সেই তিনটি প্রবন্ধ, পাঁচটি কবিতা আর টিভিতে গোটা ছয়েক দায়সারা নাটক দিয়ে দিবস উদযাপনের সময় ফুরিয়েছে। নতুন বাংলাদেশে নতুন একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘষে মেজে জাগিয়ে তুলুন। বিশ্ব দরবারে নিয়ে যান, বিজ্ঞাপন আর পত্রিকার ক্রোড়পত্র দিয়ে নয়, দলীয় লেজুড়বৃত্তির সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে নয়, বরং আদিবাসী শিশুদের হাতে তাদের ভাষায় বই তুলে দেবার মতো অর্থপূর্ণ কাজের মাধ্যমে।
ভাষা শহিদ ও তাদের পরিবারের সকল সদস্যদের শ্রদ্ধা জানাই। ভালবাসা।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য