প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ড. শামীম আহমেদ | ০৭ মার্চ, ২০২২
আজ মহান ৭ মার্চ। ১৯৭১ সালের এইদিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অনবদ্য ভাষণ দেন যার ভিত্তিতে রচিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ভাষণটি যতবার শুনি, শিহরিত হই। ইতিহাসের কী এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তিনি এই ভাষণটি দিয়েছিলেন! তার সামনে উপস্থিত ছিল লক্ষ লক্ষ নির্যাতিত শোষিত, আবেগে উদ্বেলিত বাঙালি যারা তখনই স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে চেয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমগ্র পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, পাকিস্তানের বৈধ প্রধানমন্ত্রী। তাঁর প্রতিটি শব্দচয়নের প্রতি মনোযোগ ছিল সমগ্র বিশ্বের, বিশেষত যেখানে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের শক্তিশালী সদস্যরা পর্যন্ত পাকিস্তানের অবৈধ সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, সেখানে বঙ্গবন্ধু যদি সুচিন্তিত এবং দৃঢ় আচরণ না করতেন, তবে আজকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নিতে পারত না।
বঙ্গবন্ধু যে ভাষণটি দেন, তার লিখিত অংশে তাজউদ্দীন আহমদের অনেক অবদান ছিল। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন একজন ঠান্ডা মাথার মানুষ। বঙ্গবন্ধু লিখিত বক্তব্যের সারমর্ম আত্মস্থ করলেও বক্তৃতা দেন তাৎক্ষণিক। তাঁর বক্তব্যে তিনি এত যৌক্তিকভাবে বাংলার ওপর পাকিস্তানের অত্যাচার-নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন যে তা সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু সুনির্দিষ্ট যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেন বাংলা কেন আন্দোলনের পথে, কেন তাদের লড়াই করার অবস্থানে চলে আসতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে সুনির্দিষ্ট শর্ত দিয়ে দেন যার ব্যতিক্রম হলে যেকোনো আলোচনার দরজা বন্ধ বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বঙ্গবন্ধু বলেন, "ভায়েরা আমার, ২৫ তারিখে অ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি, ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে। প্রথম, সামরিক আইন- মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না।"
ওই ক্রান্তিকালেও তিনি বাংলার গরীব শ্রমিক কৃষককে ভুলে যাননি। তিনি উদাত্তকণ্ঠে বলেন, "গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ারগাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে- শুধু... সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি-গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। ...আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করব। যারা পারেন আমাদের রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছে দেবেন। আর এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন।"
বঙ্গবন্ধু চাইলে সেদিন স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারতেন, সেটা হতো চরম হঠকারিতা। কারণ পাকিস্তান এবং তার দোসরেরা ঠিক ওই সময়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনছিল এবং তারা প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিল যে বঙ্গবন্ধু যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেন, তাহলে সাথে সাথে জাতিসংঘের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করা হবে এবং বঙ্গবন্ধুকে সেই নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতা হিসেবে গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে খুন করা হবে। সেই অতি আবেগী মুহূর্তে, যেখানে কোটি জনতা এবং নেতা-কর্মীর চাপে যে কেউই এই ভুলটি করে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিত, বঙ্গবন্ধু দেননি। তিনি মাথা ঠান্ডা করে, নির্বাচনে বিজয়ী সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতার মতোই কূটনৈতিক ভাষায় বাঙালিকে স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন, অন্যদিকে বিশ্ববাসীকে চিনিয়ে দেন পাকিস্তানের বৈধ নেতা কে, নির্বাচিত সরকার কে এবং তাঁর এবং তাঁর জনগণের অধিকার কী কী।
বঙ্গবন্ধুর সেই দুর্দান্ত নেতৃত্বের কারণেই পাকিস্তান, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা নিয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের কূটচাল চালতে পারেনি। ফললে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হাজার নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির উপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা চূড়ান্ত ঘোষণাটি দেন, যার ভিত্তি তিনি তৈরি করে রেখেছিলেন ৭ মার্চে- তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে। "...সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো- কেউ দেবে না। মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালি রেডিওস্টেশনে যাবে না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়না-পত্র নেবার পারে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেশুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, আরও রক্ত দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।"
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য