আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

আমাদের বইমেলা এবং বন্ধ ঘরে তালা

রহিম আব্দুর রহিম  

পৃথিবীর স্বাদ পেতে হলে একটা জীবন্ত প্রাণ থাকতে হয়।

‘প্রাণ’ মানেই পৃথিবী নামক বিশাল রাজ্যের অবাধ বিচরণের আনন্দঘন পরিবেশ। যেখানে সভ্য জগতের মানুষরা খুঁজে ফিরবে রহস্যময় জগতের নানা ব্যঞ্জনা, রূপ-রস,আদি-অন্ত। পৃথিবীর সকল সৃষ্টিশীল মানুষের ইতিহাস তাই বলে। কেউ সৃষ্টির মাঝে, কেউ আবার স্রষ্টার মাঝে আনন্দ খুঁজে। এই খোঁজাখুঁজির নামই জীবন। এই জীবন কৌতূহলী হয়ে ওঠে একেবারেই শিশুর প্রারম্ভিক বয়সে। একটি শিশুপ্রাণ ছয় মাস বয়স থেকেই ধাপে ধাপে পরিবর্তন, পরিবর্ধন হয়ে এক সময় এই প্রাণটি ‘রাজা-রাণী’তে পরিণত হয়। যেখানে জাত-কূল, ধর্ম-বর্ণ, সাদা-কালোর কোন পার্থক্য থাকে না। সভ্যতায় মানুষকে 'মানবপ্রাণ' আর বন্য প্রাণিদের 'পশু' বলে। যা যৌক্তিক পৃথিবীতে অযৌক্তিক প্রলাপের নামান্তর। একপাল পশু এই পৃথিবীর কল্যাণ, মঙ্গল এবং ভারসাম্য রক্ষায় যা করেছে, তামাম দুনিয়ার গোটা মানুষরা তার সিকিভাগও করেনি। আমরা শিক্ষার নামে কুশিক্ষা এবং বেঁচে থাকার সংগ্রামকে সম্পদ গড়ার যুদ্ধে পরিণত করেছি।

মানুষ চলাফেরা, আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে যে শিক্ষা অর্জন করতে পারে, তা হাজার বছর পাঠ্যসূচির ভেতর থেকে অর্জন করা সম্ভব না। একটি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-কালচার, দুঃখ-বেদনা, হাসি-কান্না, মান-অভিমান খুঁজে পেতে হলে তাঁকে প্রথমেই খুঁজে নিতে হবে একটিমাত্র ভালো বই। যা চার দেয়ালে ঘেরা কোন খুপরিতে বসা জ্ঞানরাজ্যের শাসক-শোষক নামের কোন মাস্টার মহাশয়ের প্রাইভেট টেবিলে নয়। বিদ্রোহী কবি নজরুল, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, ক্ষ্যাপা কবি মুকুন্দ দাস, সক্রেটিস, এরিস্টটল, জাতির পিতা শেখ মুজিবসহ শত মনিষীর জীবন আলেখ্যে এমনটাই বলে।

ছাত্রজীবন থেকেই পাঠ্যসূচির বাইরের বই পড়তে ভাল লাগতো, সেই থেকে অভ্যাস। লেখার চেয়ে পড়তে ভালো লাগে। বইমেলা জ্ঞানপিপাসুদের আড্ডাস্থল। বই পড়তে না পারলেও নেড়েচেড়ে দেখতে ভালো লাগে। প্রতিবছর বইমেলায় যাই। দু'বছর ধরে বইমেলায় নিজের কিছু বই আসছে। বেচা-কেনা কেমন হচ্ছে তা প্রকাশক ভালো বলতে পারবেন। আমি প্রতিবছর কিছু বই কিনতে আসি, একই সাথে কোন শ্রেণির পাঠকরা বই কেনে, কারা নেড়েচেড়ে দেখে এইগুলো অবলোকন করি। এবারও ৮ মার্চ থেকে ১০ মার্চ নিয়মিত মেলায় গিয়েছি, বই কিনেছি, পাঠকদের ধরন নির্ণয় করেছি। নান্দনিক প্রচ্ছদ, চকচকে, ঝকঝকে কভারের অনেক বই খুলে দেখেছি। ভেতরে মাল-মসলা খুব একটা ভাল না। আবার হতদরিদ্র কভারের কিছু বইতে খুবই জ্ঞানগর্ভ, আনন্দ বিনোদনের পরিচ্ছন্ন উপাদেয় মনে হয়েছে। শিশুরাও এসেছে, সোনামণিদের ‘আদরী উপহার’ বই কেনে দিচ্ছেন মা-বাবারা। এরা পাঠক না, তবে তাদের পাঠক বানাতে নিরন্তর চেষ্টা করছেন তাদের বাবা মায়েরা। যা দেশ জাতির জন্য শুভ সংবাদ। টিনএজ বয়সের পাঠক খুব একটা চোখে পড়েনি। যা পড়েছে তা চায়ের স্টলে, লেকের পাড়ে। তা হলে কি বই কেনা-বেচা হচ্ছে না? অবশ্যই হচ্ছে। এরা কারা? পঞ্চাশ-ঊর্ধ্ব সেকালের পড়ুয়ারা। এ অবস্থা কেন? তবে কি আমরা লেখক এবং প্রকাশকরা পাঠক সৃষ্টি করতে ব্যর্থ?

লেখাটি শেষ করার আগে এবারের বইমেলার এক চরম বাস্তবতা পাঠকদের কাছে তুলে ধরছি। ৮ মার্চ মেলার উদ্যানের পশ্চিমের প্রবেশ গেটে পৌঁছলাম, বেলা তখন গড়িয়ে দুটো ছুঁই ছুঁই। প্রবেশ সময় হয়নি, প্রখর রোদ উদ্যানের বিশ্রাম চেয়ার খাঁ খাঁ জ্বলছে। সেখানে বসে আছে একই বয়সের চার কিশোর, মুখে মাস্ক, কপাল রোদে কালো হয়ে গেছে, আমিও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না, ওদের সাথে বসলাম। কথাবার্তা হলো, ওরা প্রাইভেট পড়ার কথা বলে বইমেলায় এসেছে। আমার ভালো লাগলো, ওদের ধন্যবাদ দিলাম। এভাবেই জ্ঞানের রাজ্যে আসতে হবে বলায় ওরা আমার সাথে মিশে গেলো, আমার সাথে মেলায় ঘুরে ঘুরে বই দেখলো, বই কিনতে সহযোগিতা করলো, ওদের চেহারা দেখা বুঝলাম, খাওয়া-দাওয়া করার মত টাকা হয়তো আছে বই কেনার মত টাকা নাও থাকতে পারে। ওদেরকে উপহার হিসেবে কিছু বই দিলাম। সে কি খুশি! মুহূর্তেই রাজ্যটা আনন্দে আত্মহারা। ৯ মার্চ রাতে ওদের একজনকে ফোন দিয়ে মেলায় আসতে বললাম তবে বাবা মাকে বলে। এই ফোনের জবাবে আমার ই-মেইলে ফাহিম নামে শিক্ষার্থীটি যা লেখেছে তা হুবহু পত্রস্থ করলাম।

‘‘Sir,
সালাম নিবেন। গত ৮ তারিখ বইমেলায় আমরা ৪ বন্ধুর (আমি, আল-আমিন, আয়ান, মাহিদুল) সাথে আপনার দেখা হয়েছিলো। আমরা আপনার সাথে সারাদিন ঘুরাঘুরি করি আর অনেক গল্পও করি। সবশেষে দিনটা ভালোই কেটেছিলো। গতকাল রাতে আল-আমিন আমাকে ফোন দিয়ে জানায় যে, আজই আপনার ঢাকায় শেষদিন এবং আপনি আমাদের সাথে দেখা করতে চেয়েছেন। সত্যি বলতে আমার এবং বাকি তিনজনেরও ইচ্ছে হয়েছিলো আপনার সাথে দেখা করার। কিন্তু স্যার দুঃখের ব্যাপার আমাদের ছিলো অনেকগুলো প্রাইভেট যেগুলো মিস দিয়ে ২ দিন আগে বইমেলা থেকে ঘুরে আসি। তাই আজ মিস দিলে হয়তবা ভয়ানক অবস্থা হয়ে যেতো।

এছাড়াও স্যার, বইমেলা থেকে আমাদের বাসা বেশ দূরে। তাই স্যার ইচ্ছা থাকার পরও আপনার সাথে দেখা হয়ে উঠলো না। আশা করি স্যার পরে যদি কোনোদিন ঢাকায় আসেন আমাদের ফোন দিয়ে জানাতে ভুলবেন না। এবং স্যার আপনার নাম দিয়ে ফেসবুকে অনেক খুঁজেছি কিন্তু পাইনি, তাই অনেক খারাপ লেগেছে। যদি পারেন একটু কষ্ট করে আপনার ফেসবুক আইডিটার লিংকটা দিয়েন।

ভালো থাকবেন স্যার। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।”

ফাহিমরা সবাই দশম শ্রেণির ঢাকার একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। ওদের এই চিঠির ভাষা উদ্ধার করা আমার পক্ষে অসম্ভব। অর্ধদিবস ওদের সাথে চলাফেরায় যা জেনেছি তা হচ্ছে সরকার বিনামূল্যে বই দিচ্ছে এতে সরকারের লোকসান হচ্ছে, কারণ স্কুলে বই পড়ায় না শুধুমাত্র কোচিং, প্রাইভেট। খেলাধুলা বিনোদন মোটেই নেই। সবকিছু মিলিয়ে বুঝতে বাকি থাকে না শিক্ষায় যে আনন্দ নেই, জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণের পথ উন্মুক্ত নয় তা স্পষ্ট। এই অস্বাভাবিক বন্ধ ঘরের তালা খুলবে কে?

রহিম আব্দুর রহিম, শিক্ষক, কলামিস্ট, নাট্যকার ও শিশু সাহিত্যিক। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ