আজ মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

কারাগারের রোজনামচা

ফরিদ আহমেদ  

অখণ্ড পাকিস্তানের অংশ হিসাবে আমরা তেইশ বছর কাটিয়েছি। এই তেইশ বছর সময়কালের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চৌদ্দ বছরই জেলে ছিলেন। ২০১৯ সালে জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপরে আনা ধন্যবাদ প্রস্তাব সম্পর্কিত আলোচনায় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জানান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। এর মধ্যে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাত দিন কারাভোগ করেন। বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে।

বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বেশি সময় কারাগারে থাকা রাজনীতিবিদ খুব সম্ভবত একজনই ছিলেন। তিনি হচ্ছেন ব্রিটিশ আমলের বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদার। পাকিস্তানের সময়কালে তিনি ষোল বছর জেলে ছিলেন। এর বাইরে অন্য কেউও থাকতে পারেন। আমার অবশ্য জানা নেই সেটা।

পাকিস্তান গঠনে তরুণ ছাত্রনেতা হিসাবে শেখ মুজিব সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। সিলেটে যখন গণভোট হয়, সেখানে কাজ করার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর সবচেয়ে দক্ষ কর্মীদের পাঠিয়েছিলেন জনমত গঠনের জন্য। সেই কর্মীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

যে পাকিস্তান গঠনে তিনি এক সময় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন, সেই পাকিস্তানেই তিনি রাষ্ট্রীয় শত্রু হিসাবে পরিগণিত হন। পাকিস্তান গঠনের পরপরই অন্য অনেকের মতোই তিনি অনুভব করেন যে পাকিস্তানে বাঙালিরা মূলত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়েছে। ফলে, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধিকারের আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন তিনি। আর এটাই তাঁকে একের পর এক কারাগারের অভিজ্ঞতা দিয়েছে। শুরু হয়েছে ১৯৪৯ সালে ভাষার আন্দোলন দিয়ে, শেষ হয়েছে স্বাধীনতার যুদ্ধের মাধ্যমে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরো নয় মাসই তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। আন্তর্জাতিক জনমতের চাপে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে পাকিস্তান সরকার তাঁকে মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয়।

১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের সম্মেলনে তিনি ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলোর কাছে এটা সেভাবে কোনো গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু, বাঙালিদের জন্য এটা ছিলো মুক্তি সনদ। ছয় দফার আড়ালে আসলে লুকিয়ে ছিলো এক দফার আন্দোলন, স্বাধীনতার আন্দোলন। ওয়াজেদ মিয়া তাঁর বই 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ'-এ ছয়দফা যে আসলে এক দফা ছিলো, তাঁর একটা চমৎকার বর্ণনা দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, খাবার টেবিলে বঙ্গবন্ধু প্রথমে দুই হাত তুলতেন। এক হাতের পাঁচটা আঙুল উঁচু করতেন আর অন্য হাতের একটা আঙুল। উত্তোলিত ছয় আঙুল ছয় দফার প্রতীক। এরপর তিনি যে হাতে পাঁচ আঙুল তোলা থাকতো সেটাকে নামিয়ে নিতেন। অন্য হাতের একটা আঙুল উঁচু হয়ে থাকতো। অর্থাৎ, এক দফা—স্বাধীনতা।

মার্চ মাসের এক তারিখে আওয়ামী লীগের সভাপতি হন তিনি। এর পরই ছয় দফা নিয়ে ঝড়ের গতিতে সারাদেশে জনসভা করতে থাকেন তিনি। ছয় দফার আড়ালে যে আসলে এক দফা আছে, সেটা বাঙালিরা যেমন বুঝেছিলো, একইভাবে বুঝেছিলো আইয়ুব খানের সামরিক সরকারও। তিনি যেখানে গিয়েছেন বক্তৃতা করতে, সেখানেই তাঁকে আটক করা হয়েছে। তিনি জামিন নিয়ে পরের জনসভায় গিয়েছেন। আবার আটক হয়েছেন, আবার জামিন নিয়েছেন। সামরিক সরকার এই টম এন্ড জেরির খেলা বন্ধ করতে 'দেশ রক্ষা আইনে' চূড়ান্তভাবে তাঁকে আটক করে মে মাসের আট তারিখে। পুরে দেয় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে।

প্রায় দুই বছর পর ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসের ১৮ তারিখে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু, সেটা আসলে এক প্রহসন ছিলো। কারাগারের ফটক থেকেই আবার তাঁকে বন্দি করা হয়। এবার অবশ্য দেশরক্ষা আইনে নয়, ‘আর্মি, নেভি ও এয়ারফোর্স' আইনে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। এবার আর কেন্দ্রীয় কারাগারে নয়, তাঁকে আটকে রাখা হয় কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে।

ক্যান্টনমেন্টে বন্দি থাকার প্রথম পাঁচ মাসে তাঁর সাথে আত্মীয়স্বজন কেউ দেখা করতে পারেনি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হবার পরে তাঁর পরিবার সুযোগ পায় তাঁর সাথে দেখা করার। সেই সময় বেগম মুজিব তাঁকে ৩২০ পৃষ্ঠার একটা রুলটানা খাতা দিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি তাঁর কারাগার জীবনের কথা লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

শুধু তাঁর কারাগার জীবন না, নিজের আত্মজীবনী ও নয়াচীন ভ্রমণ নিয়েও তিনি কারাগারে বসে বিভিন্ন সময়ে লিখেছেন। এই লেখাগুলো যে প্রকাশ করতে হবে, বই আকারে বের করতে হবে, সেই ভাবনা তাঁর কখনোই ছিলো না। বন্দি জীবনের সময় কাটানোর জন্যই তিনি এগুলো লিখতেন মূলত। যে কারণে খাতাগুলো তাঁর বাড়ির আলমারি উপরে পড়ে থেকেছে দীর্ঘকাল। ১৯৭১ সালে শেখ হাসিনা এগুলো উদ্ধার করেন তাঁদের বাড়ি থেকে। পাকিস্তান আর্মি তাঁদেরকে ধানমন্ডিরই একটা ভিন্ন বাড়িতে আটকে রেখেছিলো। ছোট ভাইবোনদের স্কুলে পাঠাতে হবে, সেটা বিবেচনায় এনে তাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি পুলিশ প্রহরায়। সেখানে গিয়ে আলমারির উপর দিকে খাতাগুলো নিয়ে কাঁথা দিয়ে মুড়িয়ে তিনি নিয়ে আসেন সেগুলো। ভাগ্য ভালো যে তিনি খাতাগুলো উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। যে কারণে আমরা আমাদের স্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ নায়কের নিজস্ব ভাবনা-চিন্তাগুলো জানতে পেরেছি।

আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধু এইগুলোকে বই আকারে ছাপানোর ব্যাপারে কখনোই আগ্রহ দেখাননি। ফলে, তাঁর বইয়ের যে সব শিরোনাম আমরা দেখি, সেগুলো অন্যদের দেওয়া। 'কারাগারের রোজনামচা'-র নামকরণ করেছেন শেখ রেহানা।

যে কোনো বিচারেই কারাগারের রোজনামচা একটা অসাধারণ বই। কারাগারে বন্দি থেকেও প্রতিদিন তিনি যেসব ভাবনা-চিন্তা করেছেন, যে সব ঘটনাপ্রবাহ ঘটেছে, সেগুলো কারণে তাঁর নিজস্ব যে সব ব্যাখ্যা এসেছে, সেগুলো আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অনেকের ধারণা শেখ মুজিব খুব একটা শিক্ষিত লোক ছিলেন না। তিনি মূলত ময়দানের জনসভায় বজ্রকন্ঠে মানুষকে মুগ্ধ করতে পারতেন। তাদের সেই ধারণা একেবারেই ভুল। কারাগারে নিয়মিত তিনি বই পড়তেন। তাঁর পড়ার আগ্রহ এতো তীব্র ছিলো যে কারাগারের গ্রন্থাগারও তাল মেলাতে পারতো না তাঁর আগ্রহের সাথে। তিনি নিজেও তাঁর এই পাঠাভ্যাস সম্পর্কে লিখেছেন, ‘দিনভরই আমি বই নিয়ে আজকাল পড়ে থাকি। কারণ, সময় কাটাবার আমার আর তো কোনো উপায় নেই। কারও সাথে দু'এক মিনিট কথা বলব তা-ও সরকার বন্ধ করে দিয়েছে।'

কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় অনেকই তাঁদের কারাগার জীবন নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু, সেই সব লেখার সঙ্গে এই লেখার একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। অন্যেরা সাধারণত বই ছাপানোর আগে সেটাকে ঘষামাজা করে নেন। ফলে, সেখানে একটা কৃত্রিম কৃত্রিম ভাব থাকে। নিজেকে মহান করার, বড় করার একটা প্রচেষ্টা থাকে। বঙ্গবন্ধুর এই রোজনামচা একেবারেই কৃত্রিমতা বর্জিত। তিনি যে ভাষায় কথা বলতেন, ঠিক সেই ভাষাতেই তাঁর কারাগারের জীবন লিপিবদ্ধ করেছেন। সেই লিপিবদ্ধতাও আশ্চর্য রকমের সারল্যে ভরা। মানুষের প্রতি তাঁর অসীম মমতার ছাপ সর্বত্র বিরাজমান। সেই মমতা থেকে জেল কাটা নিম্নস্তরের আসামিরাও পর্যন্ত বঞ্চিত হয়নি। কারাগারে তাঁর অন্যদের সাথে কথা বলা নিষিদ্ধ ছিলো। কিন্তু, তিনি কথা বললে, তাঁকে পাহারা দেওয়া লোকদের সামর্থ্য ছিলো না তাঁকে বাধা দেবার। কিন্তু, এইসব সিপাহিরা তাঁর কারণে বিপদে পড়বে বলে তিনি নিজেই কারো সাথে কথা বলতেন না। এই ধরনের সংবেদনশীলতা খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। তাঁকে এক জেল থেকে আরেক জেলে স্থানান্তরের সময়ে একই কাজ তিনি করতেন। লঞ্চে অনেকেই তাঁকে সালাম দিতো, তাঁর সাথে কথা বলতে এগিয়ে আসতো। তিনি সালামের উত্তর দিয়ে বলতেন, 'আমি বন্দি। আমার কথা বলা মানা। আমি কথা বললে এরা বিপদে পড়বে।'

সবশেষে বলবো, এই বইটাকে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্য বই করা উচিত। একজন আদর্শ রাজনীতিবিদ কেমন হওয়া উচিত সেটা যেমন এখনকার তরুণ প্রজন্ম জানতে পারবে, একই সাথে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসটাও জানা হবে, জানা হবে এর পিছনের অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগের কাহিনিও। দেশটাকে আমরা বিনা ত্যাগে পাইনি, বিনা মূল্যেও এটা আসেনি। এর মূল্য অপরিসীম।

ফরিদ আহমেদ, কানাডা প্রবাসী লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ