প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ড. কাবেরী গায়েন | ২৮ মার্চ, ২০২২
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং বাম গণতান্ত্রিক জোটের ডাকে আজ সারা দেশে সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত পালিত হয়েছে অর্ধদিবস হরতাল। এবার কমিউনিস্ট পার্টি সারা দেশে, প্রতিটি জেলায় দলীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি লাগামহীন হয়ে যাবার শুরু থেকেই, মাসব্যাপী পথসভা করেছে, জনসংযোগ করেছেন দলীয় কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং সারা দেশের নেতাকর্মীরা, বিপুল অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে।
উন্নয়নের জোয়ারের তত্ত্বে ভেসে যাওয়া দেশের মানুষ নিজেদের হঠাৎই আবিস্কার করতে শুরু করলেন টিসিবির ট্রাকের পেছনে। কিন্তু তারও আগে মধ্যবিত্ত নিজের রান্না ঘরে নিত্য খাবারের জিনিসের দামের আঁচ বুঝতে শুরু করেছেন। প্রান্তিক মানুষের কথা নতুন করে কী বলার আছে? কারণ তাদের বারোমাস যুদ্ধের আঁচ আমাদের গায়ে লাগে না। মাস দেড়েক আগে একদিন ক্যাম্পাস থেকে ফিরছি। রিকশাওয়ালা ভাই বললেন, আপা, ত্যাল পাওয়া যায় না বাজারে। জিজ্ঞেস করলাম, ক্যানো? বললেন 'রাশিয়ায় যুদ্ধ হইতাছে, ওরা বাংলাদেশে ত্যাল দেবে না।'
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এমন সরাসরি সম্পর্কের কথা সরাসরি আলাপে সেই প্রথম শুনলাম। দু'দিন বাদে বাসায় তসলিমা খালা, ঘরে সাহায্যকারী, বললেন, 'দোকানে ত ত্যাল পাওয়া যায় না।' এ কথা বললেন তিনি চাল-ডালডটকম থেকে আনা আমার দুই লিটারের তেলের বোতলের দিকে তাকিয়ে। খালা এমনিতে খুব অসচ্ছল নন। ছেলের দর্জির দোকান, দুই মেয়ে গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করেন, নিজে তিনি তিন বাসায় কাজ করে ১৩ হাজার টাকা পান, খাওয়া ফ্রি। কিন্তু তার মুখে উদ্বেগ। এরও তিন-চারদিন বাদে তিনি বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন, বাসায় লাগে ৫-৬ কেজি তেল তার, কিন্তু এবার কিনেছেন ৪ কেজি, দাম সাড়ে আটশো টাকা। এরপরে একদিন বাসা থেকে বের হচ্ছি। কয়েক ফ্ল্যাটের গৃহকর্মীদের কথা কানে এলো। কথার সারমর্ম অনেকটা এমন যে ''বাড়ির ম্যাডামরা সুস্বাদু রানতে কয় কিন্তু ত্যাল কম দিয়া।'' বুঝলাম, জিনিসপত্রের দাম নিম্নবিত্তের পরিসর ছাড়িয়ে মধ্যবিত্তের রান্নাঘরে ভালোভাবেই ঢুকেছে। তেল না পাবার কথা শুনলাম আমার এক সহপাঠীর মুখে, যিনি নিজেই চাকরিজীবী। প্রান্তিক মানুষের মুখ থেকে প্রতিদিনকার জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কথা তারপর মধ্যবিত্তের কথায় পরিণত হয়ে উঠতে দেখলাম।
আরও একটি জিনিস চোখ এড়ালো না। ফেব্রুয়ারি মাসের ২৫-২৮ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বাদশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো মহানগর নাট্যমঞ্চে। দেয়ালঘেরা মঞ্চ পরিসরের ঠিক বাইরে, ফুটপাত জুড়ে অনেক মানুষকে যেমন ভিক্ষা করতে দেখলাম, আবার বেশ কিছু মানুষকেই দেখলাম পথে শুয়ে থাকতে। তাদের দু'একজন ঠিক পুরনো পথে ঘুমানো মানুষ মনে হয়নি। তাড়া থাকায় এইসব মানুষের কাছে গিয়ে খোঁজ নেয়া আর হয়ে ওঠেনি। এদিকে ফুলার রোডের সামনে থেকে যে রাস্তা গেছে নীলক্ষেত পর্যন্ত, সেখানেও দেখি মানুষের রাতে শুয়ে থাকার সংখ্যাটা বুঝি বেড়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। গত পরশু জ্যামে আটকে আছি। দেখি এক ভদ্রমহিলা গাড়ির দরজার পাশে দাঁড়িয়ে খুব নিচু গলায় বলছেন, আমাকে একটু সাহায্য করবেন? শাড়ি, হাত-পা বেশ পরিস্কার। আমি পার্স খোলার আগেই গাড়ি চলতে শুরু করলো। তিনি ঠিক অভিজ্ঞ ভিখারির মত দৌড়াতে পারলেন না চলন্ত গাড়ির সাথে। মনটা খারাপ হলো খানিক। নিজেই ভাবলাম, কেন খারাপ হলো মন? তার পরিস্কার শাড়ি, পরিস্কার হাত-পা, বিনম্র হাসির জন্য? সদ্য আমার শ্রেণি থেকে বিচ্যুত হয়েছেন বলেই কি লাগলো বেশি?
কমিউনিস্ট পার্টির নারী শাখার উদ্যোগে একটা পথসমাবেশ হলো ১৪ মার্চ, টোকিও স্কয়ারে। ওখানে দেখলাম রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালারাসহ অনেক মানুষ ওই সংক্ষিপ্ত সমাবেশের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। আযানের জন্য বিরতি হলে এইসব পথসভার ভাসমান শ্রোতারা চলে যান সচরাচর। কিন্তু সেদিন দেখলাম অনেককেই দাঁড়িয়ে থাকতে সমাবেশ শেষ না হওয়া পর্যন্ত। সারাদেশে হরতালের জন্য যে জনসমাবেশ হয়েছে প্রায় মাসব্যাপী, সেখানে সাধারণ মানুষের সমর্থন চোখ এড়ায় না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে কয়েক দশক ধরে, সাধারণ মানুষ সেই কারণে রাজনীতির প্রতি একধরনের মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তবে ন্যায্য দাবিতে, সাধারণ মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নামলে মানুষ সে কথা যে শুনতে চায়, তার প্রমাণ এবারের এই হরতাল। না, দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ হয়নি। স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালত বন্ধ হয়নি।
কিন্তু সারা দেশের মানুষ জেনেছেন, জনগণের ন্যায্য দাবিতে কমিউনিস্ট পার্টি এবং তার বাম শরিক দলগুলো হরতাল ডেকেছিল। সেই ডাকটা দৃশ্যমান ছিলো। যাদের ভয় লাগার কথা, তাদের ভয় লেগেছে। সরকার দেশের নানা জায়গায় ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি এবং অন্যান্য বাম দলের নেতাকর্মীদের উপর হরতালের জন্য জনসংযোগের সময় থেকেই চড়াও হয়েছে, মারধোর করেছে, গ্রেপ্তার করেছে এবং সমাবেশ পণ্ড করে দিতে চেষ্টা করেছে। আজ হরতালের দিনে সারাদেশে লাঠিচার্জ, জলকামান দাগা থেকে শুরু করে গ্রেপ্তার, মারপিট সবই করেছে। কেন?
এদেশে কি হরতাল এবং সমাবেশ করা নিষিদ্ধ?
বামদলীয় জোটের কোন নেতা-কর্মী-সমর্থক কি কোন ধ্বংসাত্মক পথ বা পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলো? কারো দিকে পেট্রোল বোমা ছুড়েছিলো? কাউকে আহত করেছিল? কোন যানবাহনের টায়ার খুলে নিয়েছিলো?
না, এমন কিছুই করেনি একজন নেতাকর্মীও। তবুও সরকারের এই আক্রমণের কারণ কী? কারণ একটাই। সরকার ভয় পেয়েছে। সরকারবিরোধী পক্ষ এবার কোন স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার-আলবদর-হেফাজত বা এমনকি বিএনপিও নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষের, জনগণের দাবিতে লড়াই করা অসাম্প্রদায়িক পরীক্ষিত মানুষেরা যখন জনগণের ন্যায্যদাবিতে মাঠে নামেন, সেই লড়াইকে অচিরেই ভয় এবং জুলুমবাজি দিয়ে বন্ধ করাই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া সরকারের উত্তর হবার কথা, হয়েছেও তাই। সরকার তরফের এই ভয়ই প্রমাণ করে, ২৮শে মার্চের হরতাল একটি সফল হরতাল। জনগণ অন্তত বলছেন, এই হরতাল ন্যায্য দাবির হরতাল। সমর্থন করি, বাস্তবায়ন করতে পারি বা না পারি। জনগণের প্রকৃত দাবি-দাওয়া নিয়ে ন্যায্য যে কোন আন্দোলনই সফল আন্দোলন।
বামজোট আহুত আজকের এই হরতালকে আমি একটি সফল হরতাল বলেই মনে করি। ভবিষ্যতের সফলতার ধারাবাহিক আন্দোলন আমার আজকের এই দাবিকে কেবল জোরালো করবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য