আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা: দায়ী কে, কারা?

খুরশীদ শাম্মী  

একটু ঠান্ডা মস্তিষ্কে তদারকি করলে দেখা যায় যে প্রায় প্রতিদিনই বিশ্বের কোথাও না কোথাও ধর্মকে কেন্দ্র করে কোনো বাগবিতণ্ডা ও সংঘর্ষ হচ্ছে। কখনো কখনো ওইসকল সংঘর্ষ এতই ভয়াবহ রূপ ধারণ করে যে মানুষের জীবন পর্যন্ত বিনাশ হয় এবং অবশেষে তা আগুনের ফুলকি হয়ে বাতাসে উড়তে উড়তে দেশান্তরী হয়েও ছড়িয়ে পড়ে। দাউ দাউ জ্বলতে থাকে মানুষের অন্তরে। এর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, শুরু থেকে আজ অবধি ধর্ম শিক্ষার কৌশল। ধর্ম শিক্ষা মানুষের অন্তরে অদৃশ্য ঈশ্বরের জন্য স্থান সংকুলান নিশ্চয়তা করতে যেয়ে কখন যে দৃশ্যমান মানুষের জন্য ঘৃণা উৎপাদন কারখানা হয়ে ওঠে, তা অনেকেই অনুমান করতে পারে না। প্রতিটি ধর্মগ্রন্থ যদি শান্তির কথাই বলে থাকে, একাত্মতার কথাই বলে থাকে, তবে এই একবিংশ শতাব্দীতেও কেন ধর্মকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে এত হানাহানি? এত রক্তপাত? এত ভাগাভাগি? কারণ তো একটাই- ‘ধর্মের নামে মনগড়া মতামত চালাচালি’।

প্রতিটি জীবের মতো মানুষও প্রকৃতির অংশ। স্থান, কাল ও অবস্থাভেদে প্রকৃতির সকল ক্রিয়াকলাপের প্রভাব পড়ে মানুষের জীবনেও। জীবন বাঁচাতে সর্বপ্রথম প্রয়োজন হয় বায়ু, পানি ও আলো। প্রাণিদের জন্য এগুলো সবই প্রকৃতিতে বিদ্যমান। মানুষের খাদ্য, বস্ত্র চাহিদাও প্রকৃতি দ্বারা পূরণ হয়। প্রকৃতি থেকে এগুলো আমরা গ্রহণ করি কোনো প্রকার শর্ত কিংবা খাজনা দেওয়া ছাড়াই। এমনকি বিনিময়ে তার এবাদত করতেও হয় না। তবে মানুষ ও অন্যান্য জীব প্রয়োজনবোধ ও কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে প্রকৃতির প্রতি সদয় হয় এবং অন্যকে সদয় হতে অনুপ্রাণিত করে। এই যে জীব ও পরিবেশের মধ্যে দেওয়া-নেওয়ার চর্চা, তা হিতকর পরিবেশের জন্য জরুরি।

বাহুবলে ধর্ম প্রতিষ্ঠাও রাজনীতি। সেই কারণে আজও রাজনৈতিক নেতাদের ধর্মশালাগুলোতে যাতায়াত খুব বেশি। মৌলবাদীরা রাজনীতির অন্যতম চাবিকাঠি। সুতরাং ক্ষমতালোভী ধোঁকাবাজদের প্রয়োজনেই এখনো চাষ করা হয় মৌলবাদ।

চাষাবাদের জন্য প্রথমে প্রয়োজন হয় উর্বর জমি। মাটির উর্বরতা বাড়াতে কৃষক কখনো কখনো ব্যবহার করেন জৈব ও রাসায়নিক সার। তবে উর্বর মাটি পেলে কৃষক মনের আনন্দে কৃষি কাজ করেন, ইচ্ছেমতো ফসল ফলান। হ্যাঁ, মৌলবাদ চাষেও প্রয়োজন হয় উর্বর জনগোষ্ঠী। দিনদিন বাংলাদেশে মৌলবাদীদের দৌরাত্ম্য দেখে মনে হচ্ছে মৌলবাদ চাষের জন্য বাংলাদেশ একটি উর্বর জনগোষ্ঠীর দেশ। মাত্র পঞ্চাশ বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সম্ভাবনাময় একটা দেশের এতটা অবনতির জন্য আসলে দায়ী কে বা কারা?

এই প্রশ্নের উত্তরে আমি বারবার একই কথা বলব, বাংলাদেশে এত প্রবলভাবে মৌলবাদ বৃদ্ধির জন্য দায়ী আমরা অর্থাৎ বাংলাদেশের নাগরিক। হোক তা রাজনীতিবিদ, ধার্মিক, নাস্তিক, ধর্মভীরু, মুক্তমনা সমাজ। প্রত্যেক নাগরিকই কমবেশি এর জন্য দায়ী।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উৎপীড়ন ও মৃত্যুর ভয়ে পালিয়ে যাওয়া হিন্দুদের বহু সম্পত্তি রাজাকারেরা দখল করল। যুদ্ধ শেষে পালিয়ে বেড়ানো মানুষগুলো যখন নিজ গৃহে ফিরে আসতে শুরু করল, তখনও সুবিধাবাদী মুসলমানেরা হিন্দুদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি দখল করে নিজেদের সমৃদ্ধ করল। একটা যুদ্ধের পর স্বাভাবিকভাবেই মানুষ শান্তি খোঁজে। সুতরাং শান্তিপ্রিয় নাগরিক তা’ চেয়ে চেয়ে দেখল। দৃষ্টান্তমূলক কোনো প্রতিবাদ হোলো না। যুদ্ধপরবর্তী অনটনের সময় যখন পূর্বশত্রুর দল মাথা চাড়া দিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারকে হত্যা করল, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি করে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করল, তখনও জনগণ ভয়ে নীরব থাকল। তখনও জনগণের কাছে তাদের জবাবদিহির প্রয়োজন হয়নি। অতঃপর যারা দেশ শাসনের দায়িত্ব নিল, তাদের ছত্রছায়ায় ধীরেধীরে রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠিত হলো, সাপ্তাহিক ছুটির দিন পরিবর্তন হলো, জামায়াতের মতো একটা মৌলবাদী দল প্রতিষ্ঠিত হলো, জামায়াত সংসদে স্থান করে নিলো, পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু পরিবর্তন হতে শুরু করল, হাইকোর্টের প্রবেশ পথ থেকে ভাস্কর্য সরানো হলো, আরও কত কিছু। সবই হলো রাজনীতির বিনুনিতে জনগণের কাছে কোনো প্রকার জবাবদিহি ছাড়াই। আমি বলব না যে শতভাগ নাগরিকই নিশ্চুপ ছিল পুরো বিষয়গুলোতে। তবে জবাবদিহির জন্য পর্যাপ্ত প্রতিবাদ কিংবা দাবি ছিল না।

জনগণের দাবির মুখে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছিল। আজ লতা সমাদ্দারকে টিপ পরার জন্য গালাগালি করা, কিংবা বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে কারাবাসে পাঠানো, কিংবা হিন্দু শিক্ষকের বিরুদ্ধে হিজাব পরার অপরাধে ছাত্রীকে প্রহার করার মিথ্যা অভিযোগের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদের মুখে প্রশাসন হয়তো অভিযুক্ত পুলিশকে বরখাস্ত করেছে, শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে জামিন দিয়েছে, হিন্দু শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রহারের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এগুলো জনগণের প্রতিবাদের চাপের মুখে সম্পন্ন হওয়া কাজ। এটা সাময়িক, কোনো প্রতিষ্ঠিত সমাধান নয়। এখানেও রাজনীতি। তারা জানে যে প্রতিটি বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ করার সময় নেই সাধারণ মানুষের। সুতরাং রাজনীতির চালে তারা মূল সমস্যা জিইয়ে রেখেছে।

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে যে বিষয়গুলি বিবেচনা করা জরুরি, সেগুলো হচ্ছে:
১. দেশের রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করা।

২. স্কুল শিক্ষায় বাধ্যতামূলক ধর্ম বিষয়কে বাতিল করা।

৩. স্কুল ইউনিফর্মে হিজাব ও নিকাব বাদ দেওয়া।

৪. ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত পরিবেশনা নিশ্চিত করা এবং জাতীয় দিবসগুলো পালন বাধ্যতামূলক করা।

৫. সরকারি ছুটির দিনগুলো পুনরায় বিবেচনা করা। (যেমন মিলাদুন্নবী, শবে-বরাত, আশুরা’র মতো ধর্মীয় দিবসগুলোতে ছুটি দরকার আছে বলে হয় না। সরকারি ছুটির ক্ষেত্রে একটি ধর্মকে গুরুত্ব দেওয়া অনিরপেক্ষতা।)

৬. পৈতৃক সম্পত্তি বণ্টনে কোনো ধর্মীয় আইন নয়, কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় আইন বাধ্যতামূলক করা, যেখানে সকল সন্তানের অধিকার হবে সমান।

৭. যেকোনো ধর্মীয় সমাবেশে আলোচিত বিষয়বস্তুগুলো হিংসাত্মক কি না, তা খতিয়ে দেখা।

৮. রাষ্ট্র পরিচালনায় সকল ধরণের ধর্মীয় প্রভাব বাতিল করা।

এরপরও আমাদের মতো সাধারণ জনগণের দায়িত্ব হবে মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলার অভ্যাসটা বাঁচিয়ে রাখা।

খুরশীদ শাম্মী, কানাডা প্রবাসী লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ