আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রাংকেনস্টাইনের খোঁজে

নিখিল নীল  

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়টা বেশ জটিল আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে যদিও এরচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনাও আগে ঘটেছে, এ-ঘটনাটি, ভিন্ন আঙ্গিকে, অভূতপূর্ব। শিক্ষকদের নোংরা রাজনীতির পরিণাম অভূতপুর্ব কিছু নয়।



তবু, অভূতপূর্ব বললাম দুটো কারণে। প্রথমত, ছাত্ররা, সুনির্দিষ্ট করে বললে ছাত্রলীগাররা, ব্যবহৃত হয়েছে সেসব শিক্ষকদের বিরুদ্ধেই যাদের পক্ষেই মূলত তাদের থাকার বা ব্যবহার হওয়ার কথা। দ্বিতীয়ত, ছাত্ররা ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে সরাসরি অপদস্থ করেনি, কিন্ত ঘটনাটা জমে ওঠেছে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে কেন্দ্র করেই। আর এ-কারণেও অভূতপূর্ব যে, বিষয়টা এমন কোনও আদর্শিক দ্বন্দ্ব থেকেও উদ্ভূত নয়, বা এমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও নয় যে-কারণে ছাত্ররা নেমে যেতে পারে শিক্ষকদের বিপরীতে!



ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের অভিমান ও ক্ষোভ তাই যুক্তিসঙ্গত বটে! এ-ঘটনা আবারও প্রমাণ দিল ছাত্র কর্তৃক শিক্ষকদের অপমান আরও ঘটবে। পাথর্ক্য কেবলঃ আগে হত স্বৈরাচারী শিক্ষক বা কর্তৃপক্ষের বিরূদ্ধে, এখন তুচ্ছ তুচ্ছ কারণে।



যাই হোক, বলে নেয়া ভাল, শাবির ভিসি বিরোধীতা কিংবা ভিসি পক্ষপাতিত্ব এসবের আদ্যোপান্ত আমি জানি না। তবু, সহজেই বোঝা যায়, একই দলের হওয়ার পরেও কিছু শিক্ষক ভিসিবিরোধি আন্দোলনে ছিলেন, আর কিছু ছিলেন পক্ষে। পক্ষে বিপক্ষের সবাই মোটাদাগে সরকারদলীয় সমর্থক। দ্বন্দ্বটা স্বভাবতই আদর্শের নয়— কদাচিৎই সেটা আদর্শের হয়— দ্বন্দ্ব ব্যক্তির বা দলগত ভাললাগা না-লাগার, বা সরাসরি বললে স্বার্থের দ্বন্দ্ব।



যুক্তি মানলে, ভিসি যেহেতু সরকার বসায়, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্বশাসন আসলে একটি ওভাররেটেড টার্ম। তবু, এসব বহু ব্যবহৃত শব্দাবলীকে পুজিঁ করে আমরা আমাদের অবস্থানকে বৈধতা দেই। এক্ষেত্রেও মূলত তাই হয়েছে। আবার বলছি, বাংলাদেশে ভিসি নিয়োগের পদ্ধতিটাই যেহেতু দুর্নীতিমুক্ত নয়, তাই “ভিসি দুর্নীতিবাজ” বক্তব্যটাই হাস্যকর।



এবার আসা যাক অপমান ও ক্ষোভ পর্বে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে তাদের সুবিধা অসুবিধায় দলীয় ছাত্রদের ব্যবহার করেন সেটা অনস্বীকার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশ্রয় না পেলে ছাত্ররা সন্ত্রাসী হয় কী করে? বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাচক্রে আইডেয়েলি শিক্ষক ক্ষমতাবান, আর ছাত্ররা ক্ষমতাহীন। যখন ছাত্ররা ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে বুঝতে হবে সেখানে ক্ষমতাবান শিক্ষকদের যোগসাজশ আছে।



এ যোগসাজশ এর মাত্রা শাবিতে গত দশক দেড়ে এতটাই প্রকট হয়েছে যে এমন কি যে সব শিক্ষক মূলধারার রাজনীতির বাইরে অবস্থান করেন বা সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সাথে সম্পৃক্ত থাকেন তাঁরা সবসময় সন্ত্রস্ত থাকেন রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ছাত্র কর্তৃক অপমানিত হওয়ার। এ-চর্চাটা যে শিক্ষকদের ফ্রাংকেনস্টাইনের ভূমিকায় অবতীর্ণ করতে পারে সে দূরদর্শী ভাবনা শিক্ষকদের আছে বলে মনে হয় না। অথবা থাকলেও, নিজের ওপরে আঘাত আসার আগ পর্যন্ত তাঁরা মনে করেন "সব ঠিক আছে।" এ-ধরণের অগণতান্ত্রিক ভাবনা ও চর্চা বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে এসেছে যেখান থেকে ফিরে আসা খুব কঠিন কাজ। আর, এমন নৈরাজ্য সৃষ্টির চর্চা বন্ধ না-হলে এসব ঘটনা নিয়মিত বিরতিতে ঘটবে।

যে ঘটনা শাবিতে ঘটেছে ওটাকে দুঃখজনক বললেও কম বলা হয়। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের সম্পৃক্ততা ঘটনাটিকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে সন্দেহ নেই। একদিক থেকে দেখলে, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের সম্পৃক্ততার কারণে কিছুটা ভাল হয়েছে, কারণ মানুষের টনক নড়েছে কিছুটা। যে নোংরা পরিবেশ শিক্ষকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তুলেছেন সেটা একটু বড় করে এবার সবার দৃষ্টিগোচর হয়েছে।



অন্যদিক থেকে, একটা ক্ষুদ্র প্রগতিশীল গোষ্টি ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের সমালোচনায় মেতে ওঠেছে। যা অবশ্যই কাঙিক্ষত নয়। কারণ এসব ন্যাক্কারজনক ঘটনার আওতা থেকে কেউই মুক্ত নয়। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ছাত্রলীগ নিয়ে বুধবার (২ সেপ্টেম্বর) আবার খুব নরম একটা বক্তব্য দিলেন। এটা অবশ্য কোনও ভাল নজির তৈরি করল বলে মনে হয় না। অপরাধ যারা করে এবং অপরাধের পেছনের কারিগর দুইই অপরাধী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের “অবুঝ” বলার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। একাত্তরের সব যুদ্ধাপরাধীও এ-প্রেক্ষিতে “অবুঝ” ছিলেন? এরকম বক্তব্য তাই তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়।

যা বলছিলাম, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিটটাকে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল যেভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন সেটা অতুলনীয়। অনেকটা অদ্বিতীয়ও। তাঁর এ-ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোনো কারণ নেই। হ্যাঁ, হয় ত বা ভোটের রাজনীতির গণতন্ত্রে এ-কাজের সুফলটা আওয়ামী লীগের ঘরে যায়। তা সব সময়ই যায়, সব ভাবেই যায়। বাংলাদেশে সব প্রগতিশীল আন্দোলনের সুফল আওয়ামী লীগই ভোগ করে আসছে, আরও ভোগ করবে।

মোদ্দাকথা হল, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের সমালোচনার পেছনের মূল যুক্তিটি হল তিনি ঘুরেফিরে আওয়ামী লীগেরই পাশে থাকেন। আর শাবির এ-ঘটনায় আঘাতটাও এসেছে “ঘর” থেকে। অপ্রত্যাশিত বটে। কিন্তু, একটু গভীরে গিয়ে দেখলে তা হতেই পারে। ছাত্রদের যেহেতু ব্যবহার করা যায়, করা হয়, তাই মাঝেমাঝে সে ব্যবহারিক সংস্কৃতির ফল পক্ষে নাও আসতে পারে। আর, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি একটা প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা কাঠামোর চূড়ায় অবস্থান করেন। সে-চূড়ায় আঘাত আসলে তিনি চূড়ান্তমূর্তি ধারণ করতেই পারেন! সে-রূপটা তিনি ভাল করেই দেখিয়েছেন এবার। একদম দলের ছাত্রদের লেলিয়ে দিয়েছেন দলেরই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে।



সেটাও কি নতুন বাংলাদেশে? অবশ্যই নয়। নতুন হল, আগেই যা বলেছি, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের সম্পৃক্ততা আর ক্ষোভ। এ-ক্ষোভের ব্যবচ্ছেদ হয় ত আরও অনেকভাবেই করা যাবে। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও গুণগত পরিবর্তন আসবেনা। যে-নোংরা শিক্ষাঙ্গন শিক্ষকেরা গড়ে তুলেছেন সেটাকে সংশোধন করার একটাই উপায় আছেঃ ছাত্রদেরকে শিক্ষার্থী হিসেবে গড়ে তোলা। কাজটা কীভাবে শুরু করা যাবে সেটার চেয়েও প্রথমত গুরুত্বপূর্ণ হল সমস্যাটাকে শিক্ষকদের উপলব্দি করা। তা তাঁরা করবেন বলে মনে হয় না। ঘটনার পরে তাহলে এত স্তম্ভিত ও অপমানিত হওয়ার কিছু নেই।

নিখিল নীল, শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, শাবিপ্রবি, সিলেট। বর্তমানে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব টেনেসিতে সমাজবিজ্ঞানে পিএইডি করছেন। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ