আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

শুভ বিদায় আবদুল গাফফার চৌধুরী

হাসান মোরশেদ  

গত শতাব্দী শেষ হবার এক যুগ আগের দুপুরগুলো দ্রুতই বিকেলের দিকে আলস্যে হেলে পড়তো। আমাদের মফস্বল শহর থেকে উত্তরের পাহাড় নীল দেখাতো, উজ্জ্বল রোদেলা দিনে একটা ঝর্নাও হতো দৃশ্যমান। এসময় আব্বা ফিরতেন বাসায় পত্রিকা হাতে নিয়ে। জেলা শহর থেকে পত্রিকা আসতে আসতে এরকম শেষ দুপুর হয়ে যেতো। পত্রিকার নাম কোনদিন ‘সংবাদ’ কোনদিন ‘বাংলার বাণী’। কোন কোনদিন দুটোই একসাথে। কোন কোন দিন আব্বাকে একটু বেশি উজ্জ্বল, ঝলমলে দেখাতো- ওই দূরের ঝর্নার মতো। নিজে অনেকবার পড়ে আমার দিকে এগিয়ে দিতেন পত্রিকা—পড়ে দেখো, গাফফার চৌধুরী লিখেছেন!

আমরা আশির দশকের কিশোরের রাজনৈতিকভাবে ইঁচড়ে পাকা ছিলাম। স্কুল ফাঁকি দিয়ে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ মিছিল দেয়া শুরু করে দিয়েছি আরও আগেই। বাজার চক্কর দেয়া মিছিল থেকে আব্বার সাথে চোখাচোখিও হয়েছে কয়েকবার। একবার ১৫ আগস্টের মিছিলে আমরা একসাথে হেঁটেছিও। তখন দিনটি শোকের এবং মৌনতার ছিলো।

গাফফার চৌধুরী যে একুশে'র গান লিখেছেন সেটাও ততদিনে আমরা জেনে গেছি। আমাদের ওই সময়ে একুশে ফেব্রুয়ারি তো প্রভাতফেরিই ছিলো৷ খালি পায়ে ভোরবেলা ‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো’ গেয়ে শহীদ মিনারে যাওয়া। রাত জেগে ফুল জোগাড় করা, আর্ট পেপার আর তুলিতে ব্যানার লেখা। ফুল জোগাড় মানে তো ফুল চুরি। যাদের বাড়িতে ফুল গাছ ছিলো তাদেরও থাকতো সস্নেহ প্রশ্রয়। একবার তো থানার বাগানে ঢুকে নিয়ে এসেছিলাম চন্দ্রমল্লিকা!

‘‘বঙ্গবন্ধু” শব্দটিই আমাদের শৈশব ও কৈশোরে ছিলো উজ্জীবনী। আর গাফফার চৌধুরী নামে একজন মানুষ দূরদেশে থেকে পত্রিকার কলামে বঙ্গবন্ধুকে ছড়িয়ে দিতেন, তার স্মৃতি তর্পণ ও চারণে কালো কালো অক্ষরে যেন বঙ্গবন্ধু আমাদের চেতনার ক্যানভাসে হয়ে উঠতেন প্রগাঢ়তম শিল্প সুষমা।

আরও পরে, আরও বড় হয়ে উঠার পর আমার কৈশোরের সেই মফস্বল যখন দূরে সরে যায়, উজ্জ্বল রোদেলা দিনেও ঝর্নাটি আর দৃশ্যমান নয় আর দীর্ঘজীবন খদ্দরের পাঞ্জাবি গায়ে কাটিয়ে দেয়া আমার মৌন তাপসের মতো বাবা যখন পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যান, যখন বঙ্গবন্ধু শব্দটিও বেশ সম্ভার সদৃশ হয়ে উঠেছে সুবিধাজনক সময়ের সগোচরে তখন দেখি বেশ শিক্ষিত সচেতন মানুষেরাও ওই মানুষটিরও নিন্দা করেন, সমালোচনা করেন।

জিজ্ঞেস করি, বুঝতে চাই—গাফফার চৌধুরীর দোষ কী? সবই ভাসাভাসা নিন্দামন্দ, কেউই সুনির্দিষ্টভাবে বলে না—লোকটি আসলেই এই অপরাধ করেছে!

নিজে যখন লেখার জন্য পড়তে শুরু করি, বিশ্লেষণ ও অনুধাবন করতে সচেষ্ট হই তখন এক ধরনের উপলব্ধি হয়। আবদুল গাফফার চৌধুরী, এম আর আখতার মুকুল, এবিএম মুসার মতো বরেণ্য সাংবাদিক যারা ইতিহাসের সাক্ষী তারা ইতিহাসের বয়ান লিখেছেন বৈঠকি আলাপের ঢংয়ে। ইতিহাস বয়ানের এটা দুর্বল পদ্ধতি, এই পদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জ করা যায়। এর চেয়ে জোরালো পদ্ধতি হচ্ছে নির্মোহভাবে ফ্যাক্টস এন্ড ফিগার তুলে ধরা। তারা ফ্যাক্টস এন্ড ফিগারে খুব মনোযোগী ছিলেন না, যতোটা ছিলেন আবেগের সুষমায়। এটা তাদের অপরাধ নয়, তারা তাদের মতো করে চিহ্ন রেখে গেছেন—এগুলোও কাজে লাগে। এ ছাড়া যে সময়ে দাঁড়িয়ে আমি এমন মনে করছি, সে সময়েই যে ফ্যাক্টস এন্ড ফিগার ধরে কাজ হচ্ছে তাতো না।

গত বছর দুয়েকের মধ্যে দুটো অনলাইন আলোচনায় তার সঙ্গী হবার সুযোগ হয়েছিলো আমার। আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতো জ্ঞানীবৃক্ষ যেখানে থাকেন সেখানে নিজের এবং অন্যদের আলাপও আসলে সময়ের অপচয়। গাফফার চৌধুরীর কথা শোনা যেন প্রখর রোদে বৃক্ষের ছায়ায় বসার প্রশান্তি। একটা আলোচনা ছিলো বাকশাল প্রসঙ্গে। আমি সময় নষ্ট না করে আমার পর্বে দ্রুত কিছু কথা বলে শেষ করে তার কথা শুনার অপেক্ষা করছিলাম। তার কথা শেষ হবার পর, অনুষ্ঠান লাইভ পর্ব শেষে তিনি আমার বয়স জিজ্ঞেস করেছিলেন। উত্তর দেয়ার পর আবার বলছিলেন—তুমি তো বাকশাল বিষয়ে অনেক জানো!

এই ‘অনেক’ শব্দটি আমাকে সলজ্জ বিব্রত করছিলো। তার লেখা কৈশোরে পড়া কলামগুলো, তার লেখা একুশের গান কি আমাকে ‘একটু’ হলেও জানার পথটুকু চিনিয়ে দেয়নি?

সকলেই যায়, সকলকেই যেতে হয়। নীল পাহাড়, উচ্ছল ঝর্না, মৌন পুরুষ, জ্ঞানীবৃক্ষ সকলের গন্তব্য—চলে যাওয়া। এই চলে যাওয়ার নিশ্চিত নিয়তির মাঝে কারো কোন সৃষ্টি অমর হয়ে যায়। আঠারো বছরের এক সদ্য তরুণের লেখা গান—একটা জাতির অস্তিত্বের অংশ হয়ে গেলো, ভাবা যায়?

টেক্সটের জাদু বলে যদি কিছু থাকে, সৃষ্টির শক্তি বলে যদি আসলেই কিছু থাকে—সে তো এই!

এটুকু কিন্তু রয়ে গেলো অমরতায়।
আপনি যান, শুভ বিদায় আবদুল গাফফার চৌধুরী।

হাসান মোরশেদ, লেখক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ