আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

অমরত্ব নিয়েই মৃত্যু!

কবির য়াহমদ  

প্রথিতযশা সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি, সাহিত্যিক, প্রগতিশীলতার পুরোধা কণ্ঠস্বর আবদুল গাফফার চৌধুরী। যত পরিচয়ই থাকুক তার সবচাইতে বড় পরিচয় তিনি ‘একুশের স্মারক সংগীত’ হিসেবে পরিচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানের রচয়িতা। কিংবদন্তি ছিলেন তিনি। তিনি কবিতা লিখেছেন, গান লিখেছেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে সমসাময়িক বিষয়ের বিশ্লেষণ করেছেন; ছিলেন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের একান্তজন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন যেমন তাকে নাড়া দিয়েছিল, তেমনি নাড়া দিয়েছিল একাত্তর।

তাকে অমরত্ব এনে দেওয়া একুশের সংগীত রচনা সম্পর্কে আমরা জানতে পারি—ঢাকা কলেজে পড়ার সময়ে আহত ভাষা সংগ্রামীদের দেখতে গিয়েছিলেন তিনি ঢাকা মেডিকেলে। সেখানে বহির্বিভাগে পাকিস্তানিদের গুলিতে নিহত ভাষা সংগ্রামী রফিকের লাশ দেখেন তিনি। মাথার খুলি ওড়ে যাওয়া রফিকের লাশে এতখানি আবিষ্ট হয়েছিলেন তিনি সেখান থেকেই আসে তার প্রথম লাইন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’; এরপর আসে পূর্ণাঙ্গ কবিতা। গাফফার চৌধুরী বলেছিলেন ‘রফিকের লাশ দেখে মনে হয়েছিল ওটা আমার ভাইয়েরই লাশ’! প্রথমে আবদুল লতিফের এবং এরপর আলতাফ মাহমুদের সুরারোপে সেই কবিতার প্রথম অংশ হয়ে গেছে ইতিহাস, হয়ে পড়েছে একুশের স্মারক সংগীত।

জীবদ্দশায় ক’জন লোক পারে তার মতো এমন অমরত্ব লাভ করতে, কিন্তু সেটা তিনি লাভ করেছেন। তার সাংবাদিকতা, কবিতা কিংবা কথাসাহিত্য নয়; তিনি অমর হয়েছেন একুশের সংগীত দিয়ে। জাতির মর্মমূলে গেঁথে আছে তার রচিত অমর সংগীত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’! যতদিন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি পৃথিবীর বুকে টিকে থাকবে ততদিন উচ্চারিত হবে তার লেখা, তার নাম।

আবদুল গাফফার চৌধুরী দীর্ঘজীবন পেয়েছিলেন। দীর্ঘ ও সফল জীবনে কখনও আদর্শচ্যুত হননি। আমৃত্যু ছিলেন তিনি বাংলাদেশের লোক। তাই বিদেশ বিভূঁইয়ে থেকেও দেশকে নিয়ে ভেবেছেন। ছিলেন আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী। দলটির প্রতি তার ঐতিহাসিক দুর্বলতা সত্ত্বেও যখনই আওয়ামী লীগ প্রগতির বিপক্ষে যাচ্ছে বলে মনে হয়েছে তখন সমালোচনা করেছেন, দিয়েছেন দিকনির্দেশনা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার লেখাগুলোও নিয়মিত পড়তেন।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়া ওঠা গণআন্দোলন গণজাগরণের পক্ষে ছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। যুক্তরাজ্যে থেকেও তারুণ্যের অগ্নিস্ফুলিঙ্গে দিয়েছিলেন সমর্থন। লিখেছেন আন্দোলনের পক্ষে, দিয়েছেন দিকনির্দেশনাও। তার সে লেখাগুলোর প্রভাব ছিল; তারুণ্যে ও সরকারে-প্রশাসনে। কিছুদিন আগে ঢাকাই চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী পরীমণি যখন ক্ষমতাবানদের ‘হেনস্তার শিকার’ হন তখন তিনি পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ওই অভিনেত্রীর। এটাকে কেউ কেউ নানা ভাবে বিশ্লেষণ করলেও শেষ পর্যন্ত তার ওই অবস্থানই পরীমণির ন্যায়বিচারের পথ রচনায় সহায়ক হয়েছে। ওটা এখনও আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে ঠিক তবে তার শক্তিশালী অবস্থান বিচারের আগে অবিচারের চেনা যে পথ তাতে কিছুটা হলেও বাধ সেধেছিল। এ থেকেও প্রমাণ হয় কেবল রাজনীতি নিয়ে নয়, দেশের বাইরে থেকে দেশের সবকিছু সমানভাবে খেয়াল রাখতেন তিনি।

প্রগতিশীলতার ধারক-বাহক হওয়ায় আবদুল গাফফার চৌধুরী প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্ষুশূল হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার হয়েছে, তবু তিনি আদর্শচ্যুত হননি। তিনি বর্ণচোরা নন, তাই আদর্শকে উপজীব্য করে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান পরিস্কার রেখে গেছেন। আওয়ামী লীগের প্রতি পক্ষপাত থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনাও করেছেন। এর ক্ষুরধার লেখনিতে অধুনা আওয়ামী লীগারদের কেউ কেউ সমালোচনা করলেও ওসবে কর্ণপাত করতেন না তিনি। করবেনই বা কেন, তিনি কি ওই পর্যায়ের!

তার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ অধিকাংশ লেখায় ঢাকা থেকে টেলিফোন কলের কথা বলেন। সেটাকে ধরে এগোয় লেখা। দেশের বাইরে থাকায় তার সঙ্গে সোর্স কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী টেলিফোন যোগাযোগ হতেই পারেন, সেখান থেকে কোন বিষয়ের তথ্য জানতেও পারেন, এখানে আপত্তির কী? অথচ অনেকের আপত্তি সেখানে। আরেক অভিযোগ তিনি যাদের উদ্ধৃত করেন তাদের বেশিরভাগই মৃত। আশি পেরুনো এক লেখক, সাংবাদিক যাদের উদ্ধৃত করতে পারেন তাদের বেশিরভাগই জীবিত নাও থাকতে পারেন। তিনি সোর্স উল্লেখ করেন না বলেন যারা তাদের অজানা থাকার কথা না যে ইতিহাসকথক যিনি তার লেখাগুলোই ইতিহাস, এবং নিজেই এখানে রেফারেন্স। মোদ্দাকথা, শক্তিশালী লেখার বিপরীতে কাছাকাছি পর্যায়েরও যুক্তি উপস্থাপন করতে না পারা লোকদের ইতিহাসকথককেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো অস্বাভাবিক নয়। আবদুল গাফফার চৌধুরী বলছেন এটাই কি রেফারেন্স হিসেবে যথেষ্ট নয়? তার পরিচিতি, অর্জন, লেখালেখির প্রতি নিবেদন তাকে সেই পর্যায়ে নিয়ে গেছে বলে আমাদের ধারণা।

তিনি ভাষা সংগ্রামী, তিনি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের কলমযোদ্ধা। বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরা নিয়ে ছিল তার আগ্রহ। ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতায় ছিল পক্ষপাত। তবে সব আশা পূরণ হয়নি তার। বাংলাদেশকে দেখে যেতে পারেননি ওই পর্যায়ে, যে পর্যায় দেশ হারিয়েছিল সেই বেদনাবিধুর পঁচাত্তরে!

তার শেষ নিঃশ্বাস পড়েছে যুক্তরাজ্যে, তবে আকাঙ্ক্ষার অন্তিম শয়ান তার প্রিয় বাংলাদেশ। তার বীরত্ব-পর্ব অসি নয়, মসি! মৃত্যুতে তিনি অমরত্ব লাভ করেননি, অমরত্ব লাভ করেই মৃত্যু হয়েছে তার। বাংলাদেশের লোক ছিলেন তিনি, বাংলাদেশের লোক থেকেই মহাপ্রস্থান হয়েছে তার। বাংলাদেশের সবুজ জমিনেই হবে তার শেষ আশ্রয়!

কবির য়াহমদ, প্রধান সম্পাদক, সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর; ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ