আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

একুশের গানটি যেদিন প্রথম গীত হলো

ইনাম আহমদ চৌধুরী  

বন্ধুবর আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী চলে গেলেন। আমাদের জন্য রেখে গেলেন অসামান্য অনেক স্মৃতি। সুদূর লন্ডন নগরী থেকে তাঁর মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর ঢাকায় বসে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সেসব স্মৃতি একের পর এক মনে পড়ছে। তাঁর সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্বের গত সাত দশকে জমা হয়েছে স্মৃতি ও সখ্যের কত উপলক্ষ! কিন্তু আজ বিশেষভাবে মনে পড়ছে একটি ঘটনা। তাঁর যে কবিতা পরবর্তী সময়ে সুরারোপিত হয়ে গান হিসেবে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির অনিবার্য অনুষঙ্গে দেশ-বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত, এই ঘটনা ছিল সেই কবিতাকে ঘিরে।

প্রসঙ্গত বলি, গত শতকের পঞ্চাশের দশকে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর মেধার স্ম্ফূরণ ঘটেছিল প্রাথমিকভাবে সাহিত্য-সংস্কৃতি ঘিরেই; সাংবাদিকতায় ততটা নয়। তখনই তিনি অসাধারণ কবিতা, গল্প ও উপন্যাসের স্রষ্টা। পঞ্চাশের দশকেই তার কৃষ্ণপক্ষ, সম্রাটের ছবি, চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান সাড়া জাগিয়েছিল। সব সাহিত্যপত্রে তার লেখা ছাপা হয়। আমরা বন্ধুরাও গর্ব নিয়ে সেসব লেখা পড়তাম। মনে আছে, একটি সাহিত্য পত্রিকার নাম ছিল 'অগত্যা'। সেখানে গাফ্‌ফার নিয়মিত লিখতেন। আমরা ওই পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যার জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম।

আমার মনে হয়, আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী পরবর্তী সময়ে যদি সাংবাদিকতায় অধিক মনোযোগী না হয়ে সাহিত্যচর্চায় সার্বক্ষণিক সময় দিতেন, তাহলে সাহিত্যিক হিসেবেও তিনি আরও বড় অবস্থানে অধিষ্ঠিত থাকতেন। অবশ্য কলাম হিসেবে তাঁর ক্ষুরধার লেখনীও অতুলনীয়। তাঁর প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা সমাজের অগ্রগতি সাধনে সহায়ক হয়েছে। তাঁর লেখা কলামগুলো অতীতের সঙ্গে বর্তমানের যোগসূত্র তৈরি করতে পারত।

যা হোক, আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী রচিত একুশের গান নিয়ে সেই অক্ষয় স্মৃতির কথা বলি। ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের বিভিন্ন কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মধ্যে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি। বলা বাহুল্য, কর্তৃপক্ষ তা সুনজরে দেখছে না। ঢাকা কলেজের ছাত্রদের মধ্যেও এ নিয়ে উৎসাহ-উত্তেজনা। আমি তখন ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত জেনারেল সেক্রেটারি। আমরা স্থির করলাম, কলেজ প্রাঙ্গণেই একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করব নিজেরাই। আর একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করব এ উপলক্ষে; ৩ এপ্রিল, ব্রিটানিয়া হলে।

কলেজ কর্তৃপক্ষ জানাল, শহীদ মিনার স্থাপনে অনুমোদন দেওয়া যাবে না। এটা সরকারি কলেজ। আমরা অবশ্য বিনা অনুমোদনেই ২১ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা স্থানীয়ভাবে ইট-সুরকি-সিমেন্ট জোগাড় করে হাতে হাতে একটি ছোট শহীদ মিনার বানিয়ে ফেললাম। ঢাকা কলেজ তখন সিদ্দিকবাজারে একটি ভাড়াটে বাড়িতে অবস্থিত। এলাকার সমাজপতি মতি সরদার। তাঁর স্থাপনা থেকে যথেষ্ট সহায়তা ও সহযোগিতা পেলাম। মিনার উদ্বোধনের সময় কলেজেরই ছাত্র সংগীতশিল্পী আতিকুর রহমান একটি দেশাত্মবোধক গান গাইলেন। দুটো কবিতা থেকে অংশবিশেষ পাঠ করা হলো। একটি হলো গাফ্‌ফার চৌধুরীর 'একুশে ফেব্রুয়ারি, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো'; আরেকটি ছিল হাসান হাফিজুর রহমানের 'আম্মা তার নামটি ধরে একবারও ডাকবে না তবে আর'।

যা হোক, ঘণ্টা দুই পর কলেজের দারোয়ান এবং পিয়নরা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এসে মিনারটি ভেঙে দিল। আমরা স্থির করলাম- সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি খুব জোরেশোরে বৃহদাকারে করব। ব্রিটানিয়া হল বলে একটি প্রেক্ষাগৃহ ছিল রমনায়, সেখানে প্রায়শ ইংরেজি ছবি প্রদর্শিত হতো। তবে মাঝে মাঝে সেখানে অনুমতি নিয়ে অন্যবিধ অনুষ্ঠানও হতো।

অনুমোদনবিহীন শহীদ মিনার স্থাপনার জন্য কর্তৃপক্ষ আমাদের ওপর রুষ্ট এবং কেন শৃঙ্খলাবিরোধী কর্ম সম্পাদনের জন্য শাস্তি-বিধান করা হবে না- সে মর্মে 'শো-কজ' নোটিশ দেওয়া হয়েছিল আমাদের পাঁচজনকে। আয়োজিত বিচিত্রানুষ্ঠানে স্থির হলো গাফ্‌ফার চৌধুরীর 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...' কবিতাটি সুর দিয়ে গীত হবে। সুর দিলেন গায়ক আবদুল লতিফ এবং গাইলেনও তিনি।

শহীদ রফিকউদ্দিনের লাশ দেখে ('৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি) গাফ্‌ফার অতীব বিচলিত হয়ে কবিতাটি লিখেছিলেন। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের কবিতা সংকলনে কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাটি শুধু যে শহীদদের স্মরণে শোকগাথা, তাই নয়; সর্বাধিক অন্যায়-অবিচার-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামের উদাত্ত আহ্বান কবিতাটিতে বিধৃত। লতিফ ভাই যে সুর দিয়েছিলেন, তা বর্তমান সুর থেকে ভিন্ন ছিল। অনুষ্ঠানে নজরুলের 'কারার ওই লৌহ-কপাট ভেঙে ফেল...' এর পরে খুব বলিষ্ঠ এবং উদাত্ত কণ্ঠে লতিফ ভাই গানটি গাইলেন। কয়েক মাস পরেই সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদ গানটিতে বর্তমানের হৃদয়স্পর্শী ছন্দময় সুর আরোপ করেন এবং এটাই আজ এই গানের স্বীকৃত সুর। কালজয়ী এই সুরেই গানটি সকল প্রভাতফেরি এবং অনুষ্ঠানে গীত হতে থাকল। তবে আমরা গর্ব করে বলতে পারি- যে গানটি প্রশ্নাতীতভাবে যুগ যুগ ধরে একুশের চেতনাকে ধারণ করছে; বাঙালির জাতীয়তাবাদের অনুভূতিকে তীক্ষ্ম ও শাণিত করছে; নিপীড়িত মানুষের সুপ্ত শক্তিকে উদ্দীপিত করছে; সে গানটি আমাদেরই আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সর্বপ্রথম গীত হয়েছিল। লতিফ ভাই ছাড়াও ঐ গানটিতে কণ্ঠসুর সংযোজন করেছিলেন ছাত্র ও শিল্পী আতিকুল ইসলাম।

গানটির রিহার্সালের সময়কার একটি ছোট্ট ঘটনার কথা মনে পড়ছে। লতিফ ভাই গাওয়ার সময় 'আমার ভাই এর' জায়গায় গানের খাতিরে উচ্চারণ করেছিলেন 'আমার ভায়ের'। উপস্থিত গাফ্‌ফার আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন- না, 'আমার ভাই'ই পুরো উচ্চারিত হতে হবে এবং তা-ই করা হয়েছিল। বিচিত্রানুষ্ঠানে একটি দেশাত্মবোধক বিপ্লবী-চিন্তা প্রভাবিত গীতি-নকশাও পরিবেশিত হয়েছিল।

স্পেশাল-ব্রাঞ্চ পুলিশ রিপোর্ট করেছিল যে, এই বিচিত্রানুষ্ঠান থেকে জেল-ভেঙে বন্দি-মুক্তি এবং রাষ্ট্রবিরোধী সাম্যবাদী বিপ্লবের আহ্বান জানানো হয়েছিল এবং এর উদ্যোক্তারাই করেছিলেন কলেজে অনুমোদনহীন শৃঙ্খলাবিরোধী শহীদ মিনার স্থাপন।

কলেজের 'গভর্নিং বডি' জরুরি সভা আহ্বান করে সিদ্ধান্ত নিল শাস্তি প্রদানের। এতদানুসারে কলেজ থেকে বহিস্কৃত হলাম আমরা পাঁচজন- ভিপি মশির হোসেন (পরবর্তী জীবনে সাংবাদিক), জিএস আমি, ছাত্রনেতা ইকবাল আনসারী খান, গায়ক আতিকুল ইসলাম এবং গীতিকার আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী।

এই বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে কলেজে ছাত্র-ধর্মঘট শুরু হয়। এক সময় আমরা তৎকালীন বিরোধী নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে রমনা রেস্ট হাউসে গিয়ে দেখা করি তাঁর উপদেশ বা নির্দেশের সন্ধানে। সেখানে আমাদের দেখা হয় সর্বপ্রথম (তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু বলে অভিহিত হননি) শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কীর্তিমান শিষ্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি-আদায় সংগ্রামের সফল নেতা। তিনি আমাদের বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহারের আন্দোলনকে কলেজে সীমাবদ্ধ না রেখে অন্যান্য কলেজের ছাত্রছাত্রীকে শামিল করতে বললেন। অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা তা-ই করলাম। আর মাস খানেকের আন্দোলনের মুখে বহিস্কারাদেশটি প্রত্যাহৃত হলো।

প্রয়াত বন্ধু আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীকে নিয়ে ওই আমার একটি মহামূল্যবান অমর স্মৃতি আজীবন ভুলতে পারব না। একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে গাফ্‌ফার লিখেছিলেন- 'আমি কি ভুলিতে পারি'। সাত দশক আগের সেই স্মৃতি সম্পর্কে আমিও বলতে পারি- 'আমি কি ভুলিতে পারি'?

ইনাম আহমদ চৌধুরী, সাবেক সচিব; আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ