আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

শরণার্থী জীবন নয়, আয়লানরা বাঁচুক নিজ দেশে

কবির য়াহমদ  

শরণার্থীদের আশ্রয় বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপের প্রসঙ্গ তুলে ইউরোপের দেশগুলোকে একতরফা সমালোচনা করা হচ্ছে। এতে করে অনেকটা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে কোন পরিস্থিতিতে মানুষজন সাগরে নিজেদেরকে ভাসাচ্ছে একটূকরো আশ্রয়ের জন্যে, আর সে পরিস্থিতি তৈরি করছে কারা?



কোন দেশ কাদেরকে আশ্রয় দেবে আর কাদের দেবে না সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তাদের রয়েছে, একই সঙ্গে তারা বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে দেখতেও পারে। মানবিকতা দেখিয়ে ইউরোপের দেশগুলো আগেও আশ্রয় দিয়েছে, এখনও দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে। কিন্তু স্রোতের মত ভেসে আসা শরণার্থীদের প্রতি তারা কিছু ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করলে সেখানেও থাকতে পারে যৌক্তিক কারণ, নিজেদের সামর্থ বিবেচনা করত নিরাপত্তা ইস্যু। এ বিষয়গুলো আবেগ দিয়ে না দেখে বাস্তবতা দিয়েও দেখা দরকার।

সিরিয়ার আয়লান কুর্দির সাগরের তীরে পড়ে থাকা মৃতদেহ দেখে আমি নিজেও আবেগ সংবরণ করতে পারিনি। আমারও কান্না পাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। এটুকু একটা বাচ্চা মরে যাওয়ার সময়ে পৃথিবীর ভয়ঙ্কর নির্মমতার শিকার হয়েছে। একই অবস্থা হয়েছে তার ভাইয়েরও। আয়লানের কোন দোষ ছিল না, সে নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসেনি। আর যখন এসেছে তখন আয়ুর পুরোটা সময় পৃথিবীতে কাটিয়ে দেওয়ার অধিকার তার ছিল।

আয়লানের এ অধিকার কেড়ে নিয়েছে খিলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর ইস্লামিস্টদের নৃশংসতাজনিত সিরিয়ার পরিস্থিতি এবং পিতা-মাতার খামখেয়ালিপনা। এখানে ইউরোপের দেশগুলো তাদেরকে আশ্রয় দেবে কি, দেবে না এটা প্রাথমিক প্রশ্ন হতে পারে না।  কানাডা তাদেরকে রাজনৈতিক আশ্রয় কেন দেয়নি এটাও মূখ্য বিষয় না।

এক্ষেত্রে আয়লানের মৃত্যুর জন্যে পশ্চিমা বিশ্ব প্রধানত দায়ি, এটা বলার আগে আমাদের ভেবে দেখা উচিত আয়লানদের আশ্রয়ের বিষয়টি সে দেশগুলোর প্রধান বিষয় নয়। সিরিয়ায় বেঁচে থাকার পরিবেশপ্রাপ্তি ছিল আয়লানদের প্রধানতম অধিকার, এবং তার দেশ সেটা দিতে বাধ্য ছিল।

আয়লান মুসলিম, নাকি খ্রিস্টান অথবা কোন ধর্মাবলম্বী সেটা ধর্তব্যের বিষয় নয়। একটা মানুষ নির্মমভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে সেটাই দেখার বিষয়। কে তাকে আশ্রয় দিল, কে দিল না কে আশ্রয়ের উদ্দিষ্ট ছিল, কে ছিল না সে আলোচনার আগে আলোচিত হওয়া উচিত আয়লানদের নাগরিক অধিকার ছিল সিরিয়ায় থাকা, কিন্তু সেটা তারা পারছে না। এক্ষেত্রে সভ্য বিশ্বের উচিত সর্বশক্তি দিয়ে অসভ্য ক্ষমতাশীল ফ্যাসিস্ট ও জঙ্গিদের উৎখাত করা। এটাই হওয়া দরকার এই মুহুর্তের প্রধানতম এজেন্ডা।

আয়লানের দুঃখজনক মৃত্যুর পর হয়ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো অভিবাসী কিংবা শরণার্থীদের বিষয়ে কিছুটা হলেও নমনীয় হলেও হতে পারে। এত এত শরণার্থী আশ্রয় দেওয়া কিংবা তাদেরকে অভিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া সব সমস্যার সমাধান না। সমাধান খুঁজতে হবে যার যার রাষ্ট্রে তাকে নিরাপত্তাসহ ফিরিয়ে দেওয়া। কিন্তু তা কি সম্ভব এই মুহুর্তে?

এই মুহুর্তে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর প্রধানতম সমস্যা ইস্লামিস্ট জঙ্গিবাদ। মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ মুসলিমপ্রধান, তবু সেখানে মুসলমান মারছে মুসলমানকে। এক গোষ্ঠীর কাছে আরেক গোষ্ঠী সাচ্চা মুসলমান নয়। ফলে হিংসা আর সন্ত্রাসকে বেছে নিয়েছে তারা খিলাফত প্রতিষ্ঠার ধারণায়। এখানে অনেকে বলে থাকেন পশ্চিমা বিশ্বের হাত আছে এ হিংসা ছড়াতে। যারা বলে তারা নিজ থেকেই স্বীকার করে এসব দেশ অন্যের তল্পিবাহক, ধর্ম তাদের অন্যের কাছে বন্ধক দেওয়া। কথিত খিলাফত আর ধর্ম প্রচার যদি অন্যের বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের চিন্তায় পরিচালিত হয় তাদের ধর্ম বড়াই থাকল কোথায়?

শরণার্থী বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার সফটকর্ণার আছে কারণ একাত্তরে আমরাও শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলাম ভারতে। ভারত আমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিল, দানাপানি দিয়েছিল এবং একই সঙ্গে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার সব ধরণের সুযোগ সুবিধা দিয়েছিল। সেটা ছিল ভারত রাষ্ট্রের মহানুভবতা আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ। ভারত জানত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার জন্যে লড়ছে, এবং এর লড়ার একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য স্বাধীনতা- তা আছে। এক সময় সেটা আসতে পারে।

কিন্তু বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ইউরোপে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় প্রার্থনা কিংবা পদ্ধতিকে কোনভাবেই একাত্তরের বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। কারণ সে সময় বাংলাদেশের মানুষেরা  যুদ্ধ করছিল এবং দেশ স্বাধীনের একটা ব্যাপার সেখানে সম্পর্কিত ছিল। কিন্তু এই মুহুর্তে মধ্যপ্রাচের দেশগুলোর কেউ নিজ দেশে বহিশত্রুর আক্রমণের শিকার হয়নি। তারা নিজেরা নিজেদেরকে মারছে। ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্টি হওয়া এ সংঘাতে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে বাতিল করে দিচ্ছে। ফলে শরণার্থী হিসেবে অন্যদেশে ঢুকা তাদের জন্যে চিরস্থায়ী যে না- সেটা কেউ বলতে পারবে না।

আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যে রোহিঙ্গারা মায়ানমারে নির্যাতিত হচ্ছে বলে অনেকেই বলে থাকেন। অনেকেই বলে থাকেন রোহিঙ্গাদের এদেশে আশ্রয় দিতে, আছেও অনেকে। কিন্তু যারা আছে তাদের ইতিহাস অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া। কক্সবাজার অঞ্চলে এ রোহিঙ্গারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি মাদক চোরাচালান ও ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশের নিশ্চয়ই অধিকার আছে তাদের দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দেওয়া। বাংলাদেশের নিশ্চয়ই অধিকার আছে সে অপরাধীদের বহিস্কার কিংবা ভবিষ্যত অপরাধী রুখতে অগ্রিম ব্যবস্থা নেওয়া। এখানে হয়ত মানবিকতা চলে আসবে আশ্রয় দেওয়া, না দেওয়া বিষয়ে। কিন্তু একটা রাষ্ট্র প্রথমত তার নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করতে অনেক সময় অনেকভাবে কঠোর হতে পারে। এখানে তার কঠোর সিদ্ধান্ত কিছু ক্ষেত্রে কারও জন্যে অমানবিক বিবেচিত হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার নাগরিকের নাগরিক অধিকারকে সুরক্ষিত করে।

আয়লানের মৃত্যু পরবর্তী পরিস্থিতিতে ইউরোপের দেশগুলো হয়ত শরণার্থীদের আশ্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে আরও নমনীয় হবে, অনেক লোক আশ্রয় পাবে সে দেশগুলোতে। এখন পর্যন্ত জার্মানি ও অষ্ট্রিয়া রাজি হয়েছে আশ্রয় দিতে, ইংল্যাণ্ডও দেবে। এটাই কি এর সমাধান? আমরা বলছি বিশ্ববিবেক জাগ্রত হোক আয়লানদের আশ্রয় বিষয়ে, কিন্তু কেন বলছি না বিশ্ববিবেক শক্ত হোক আয়লানদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে। আর  ইস্লামিস্ট জঙ্গি সংগঠন আইএস-কে সমূলে নির্মূল করতে এটাই হতে পারে বিশ্ববিবেকের জাগ্রত হওয়া কিংবা শক্ত হওয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ!

আয়লানরা যদি নিজ দেশে বেঁচে থাকার নাগরিক অধিকারটুকু পেত তাহলে তাদেরকে অনিশ্চিত পথে পা বাড়াতে হত না, তাহলে তাদেরকে সাগরে ভাসতে হত না!

৩ বছরের আয়লান কুর্দি মরে গিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে দিয়েছে, বাকি সব বয়সের সব নামের আয়লানরা নিজ দেশে বাঁচুক, তাদের কপালে যেন না জুটে অনিশ্চিত আর শরণার্থী জীবন!

কবির য়াহমদ, প্রধান সম্পাদক, সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর; ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ