আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

আতংকের নাম ধর্মীয় অবমাননা

এখলাসুর রহমান  

সেই যে কবে সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নিজ স্বার্থে ও একটি বিশেষ মহলকে পক্ষে টানতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম চালু করলো। আর চালু করে রোপণ করে গেল একটি বিষবৃক্ষ। এখন এই বিষবৃক্ষটিকে উপড়াতে বললেই তেড়ে আসে এক শ্রেণির উগ্রপন্থীরা। ইসলাম গেল ইসলাম গেল বলে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের উস্কে দেয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলের পক্ষে যে কথা বলবে তার বিরুদ্ধে। স্বৈরাচার এরশাদকে আন্দোলন করে হটাতে পারলেও রাষ্ট্রধর্মকে হটানো যাচ্ছে না। কারণ এটির বিরুদ্ধে যে কথা বলবে তাকেই ধর্মীয় অবমাননা ইস্যুতে আক্রমণ করবে। এই ভয়ে কেউ ইচ্ছে হলেও ভয়ে তা প্রকাশ করে না। রসরাজ নামের সামান্য একটি জেলে যে ফেসবুকের কিছুই বুঝে না, তার কথিত ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল। রসরাজ অ্যারেস্ট হল তবু উগ্রপন্থীরা থামলো না। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি ঘরে নির্বিচার হামলা চালালো। আর এই হামলাকারীদের সরকার ও পুলিশ ভয় পায়!

সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সরকারের সংসদ রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের বিলটি পাশ করতে পারলো না। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ধর্মনিরপেক্ষ দল আওয়ামী লীগের সাংসদরাও রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের সাহস পেলো না ধর্মবাদী উগ্রপন্থীদের ভয়ে। সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের মতো একজন ঝানু পার্লামেন্টারিয়ানও চুপসে গেল। কারণ তিনি নিজেও কথিত ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে কুপিবাতি রাখবো না। আর সেটাকে টুপি রাখবো না বলে দেশময় অপপ্রচার চালাতে শুরু করলো। সংসদে গোটাকয়েক বামপন্থী সংসদ সদস্য রয়েছেন। তারা সে সময় রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের পক্ষে ছিলেন। উগ্রপন্থীরা এসব সাংসদদের ইসলামের দুশমন ও নাস্তিক মনে করে থাকেন। তাই সরকারে থেকেও তারা মূল্যায়িত নন। অসাম্প্রদায়িক মতাদর্শে ১৪ দল গঠিত হলেও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে খুশি করতে তাদেরকে সরকার পরিচালনা হতে বাদ দেয়া হয়েছে। মন্ত্রিসভায় বামপন্থী সাংসদ কেউ নেই। কেন এই সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে আপোষকামিতা?

যে হেফাজত সরকারকে ফেলে দিতে রাজপথে নেমে গেল। অবশেষে কঠোরভাবে নির্মূল করা হল সেই হেফাজতকেই কেন আবার কাছে টানা? দেশে এখন আশাবাদী কোন বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই। বিএনপির রাজনীতি নৈরাশ্যের কালো মেঘে ঢাকা। দলের চেয়ারপার্সন সরকারি করুণা নিয়ে অসুস্থ অবস্থায় মুক্ত আছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন লন্ডনে থাকেন। সাজাপ্রাপ্ত আসামি হওয়ায় তার দেশে ফেরারও সুযোগ নেই। এমন পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক ধর্মব্যবসায়ীরাই যেন একমাত্র ভরসা। প্রতিবেশী দেশ ভারতে যেমন সাম্প্রদায়িক জুজু তুলে বিজেপি ক্ষমতায় গেল বাংলাদেশেও একটি মহল এমনই স্বপ্ন দেখে চলছে। ভারতের নূপুর শর্মার বক্তব্য নিয়ে এগিয়ে গেল ভারতের সাম্প্রদায়িক শক্তি। এদেশেও এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা জোরসে চলতে লাগলো। নূপুর শর্মার বক্তব্য সমর্থনকারীকে গণরোষ হতে বাঁচাতে গিয়ে গণরোষের শিকার হলো স্বপন বিশ্বাস। কোন আইনে রয়েছে একজন মানুষকে গণপিটুনির হাতে তুলে দেয়া? স্বপন বিশ্বাস যা করা সঠিক তা-ই করলো। আর এই সঠিকতার বিনিময়ে তাকে পুলিশের উপস্থিতিতেই জুতার মালা পরিয়ে নেয়া হল থানায়। সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে কতোটা জিম্মি হলে এমনটি ঘটা সম্ভব?

শুধু কি তাই কয়েকদিন আগে বিজ্ঞান শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান পড়িয়ে গণরোষের শিকার হলেন ও আটক হলেন। শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল মুক্তি পেলেও আতংক কাটেনি। ক্লাসে পড়াতে ভয় পান। বিজ্ঞানের কথা বলতে গিয়ে কোন কথা ধর্মীয় অবমাননা ইস্যুতে পড়ে যায়। চট্টগ্রামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে দেবব্রত দাস নামে এক স্কুল শিক্ষককে আট বছরের কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দিলো। সোমবার (৪ জুলাই) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ জহিরুল কবিরের আদালত এ রায় দেন। ধর্মীয় অবমাননার মামলাটি করেছেন একজন পুলিশ সদস্য। তবে জানি না এই পুলিশ সদস্য নিজে কতোটা ধর্ম মেনে চলেন।

এই ধর্মীয় অবমাননা কোন ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে হয়? সেটা নিশ্চয়ই সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মানুসারীদের বেলায়। এদেশের কোন মুসলমান ওয়াজকারী হিন্দু দেব-দেবীদের নিয়ে কটাক্ষ করলে সেটা ধর্মীয় অবমাননা হয় না। আবার কোন ওয়াজকারী নবী মোহাম্মদ (সা.)-এর বিবাহ নিয়ে কটাক্ষ করলেও তা ধর্মীয় অবমাননা হয় না। মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী নবীপত্নী খাদিজাকে বুড়ি, উইডো, ভার্জিন নন, ইনটেক্ট নন, কয়েকবার তালাক খাইছে প্রভৃতি মন্তব্য করেছেন। এ নিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। এই কথাটা যদি তিনি না বলে অন্য কেউ বলতো তাহলে অনুভূতিওয়ালারা হই হই ধর ধর বলে চেঁচিয়ে উঠতো। আরেকজন ওয়াজে মুসলিম ওয়াজ শ্রবণকারীদের বলল, আপনাদের কাছে করোনা আসবে না। যদি আসে কোরান শরীফ মিথ্যে হয়ে যাবে। আরেক ওয়াজী বলল, কোরআনে আওয়ামী লীগ বিএনপির কথা উল্লেখ আছে। কোরানের দোহাই দিয়ে করোনার ওষুধের কথাও বলছেন কেউ কেউ।

কতিপয় ওয়াজী উপস্থিত মুসল্লিদের প্রকাশ্যে জঙ্গি হওয়ার আহবানও জানাচ্ছে। তারা নিজ ধর্ম ছাড়া অন্যদেরও যে ধর্ম থাকতে পারে সেটা মনে করেন না। তারা তাদেরকে বিধর্মী ও দোজখী মনে করে থাকেন। ধর্মের নামে মানুষকে উস্কে দেয় আর দোহাই দেয় আল্লাহ ও কোরআনের। নবীর অপমানে যারা জান কোরবান করে দিতে চায় ও অপমানকারীকে সম্প্রদায়সহ গর্দান কেটে দিতে চায় তারা কিন্তু নবীর আদর্শ মানার ক্ষেত্রে এতোটা আগ্রহী নয়। আর নবীর মান কি এতোটাই পিচ্ছিল কচুপাতার পানির মতো যে কেউ কিছু বললেই তা চলে যাবে। নবীর জীবদ্দশায় তায়েফের ময়দানে নবী বিরোধীরা নবীকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করেছিল। এই পাথর মারার চেয়ে কথা বলাটা কি বেশি অপমানজনক? নবীতো পাথরে রক্তাক্ত হয়েও অনুসারীদের পাল্টা আঘাতের নির্দেশ দেননি। তবে কথা বলা-ওয়ালাদের বিরুদ্ধে কেন কথিত অনুসারীদের এমন নৃশংস পাল্টা আঘাতের হুমকি। রসরাজ ইস্যুতে নারকীয় আক্রমণযজ্ঞ ঘটে গেল।

নূপুর শর্মার পক্ষে কথা বলায় একজন ছাত্রকে আক্রমণ করলো। শিক্ষক বাঁচাতে চেষ্টা করে দোষী হয়ে গেল! তবে কি স্বপন বিশ্বাসের উচিত ছিলো ছাত্রটিকে গণপিটুনির হাতে তুলে দেয়া? ধর্মীয় হুজুগীরা কি তবে দেশের প্রচলিত আইনের ঊর্ধ্বে? তারা যে আইন নিজ হাতে তুলে নেয়ার চেষ্টা করলো এজন্য কি তাদের শাস্তি হওয়া উচিত নয়? পুলিশ কেন নির্বিকার থাকলো। কেন তাদের লাঠিচার্জ করতে পারলো না? তাও নিশ্চয়ই ধর্মীয় অবমাননার ভয়ে। হেফাজত নেতা মামুনুল হক পরনারীসহ এক রিসোর্টে ধরা পড়লো। পুলিশের উপস্থিতিতে কথিত ধর্মান্ধ হুজুগীরা তাকে ছিনিয়ে নিল। পুলিশের এই অসহায়ত্বের মূলেও ধর্মীয় অবমাননার ভয় নিশ্চয়ই। গত বৎসর পাঠ্যসূচি হতে কয়েকজন হিন্দু কবির কবিতা বাদ দিয়ে দেয়া হল। জাতি এতেও চুপ থাকলো। সেটাও নিশ্চয়ই ধর্মীয় অবমাননার ভয়েতেই। এবারও ধর্ম শিক্ষা বাদ দেয়া হয়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে মানুষকে উস্কে দিচ্ছে সেই চক্রটাই। তবু সকলে নিশ্চুপ। কারণ এদের উস্কানি সত্য মিথ্যা যাই হোক কিছু বলার সাহস নেই। এদের ভয় পায় খোদ সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। এক কথায় এক ভয়াবহ আতংকের নাম হয়ে উঠেছে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ। সবাই আতংকে থাকে কে কখন এই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে যায়।

এখলাসুর রহমান, লেখক ও কলামিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ