প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ড. শামীম আহমেদ | ০৫ অক্টোবর, ২০২২
ঘুম থেকে উঠলে শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে আসে, রাতে ঘুমাবার সময়ে চরণে ফুল ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে এমন কোন শিক্ষক আমার জীবনে আসেনি। হতে পারে এ একান্তই আমার ব্যর্থতা। ছাত্র হিসেবে দুর্বিনীত, একরোখা, বাংলাদেশি সংস্কৃতির চিরচেনা 'জি হুজুর' স্বভাবের ছিলাম না বিধায় কোন শিক্ষক কখনও আমাকে পোষ মানাতে পারেননি। আবার জীবনের শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান-দর্শন সবই প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে আহরণ করার খুব অল্প বয়সের অভ্যাসের কারণে মনে হয়নি কোন শিক্ষক আমার জীবনের আদর্শ-চেতনা আমূল পাল্টে দিয়েছেন! আবার হতে পারে এমন কোন শিক্ষক জীবনে পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি!
বেত দিয়ে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছেন, কানের সাথে কলমের ঢাকনা চেপে ধরেছেন, উচ্চস্বরে অশ্রাব্য ভাষায় চিৎকার করে পড়িয়েছেন, নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করিনি বিধায় নাম্বার দেবার সময় বৈষম্য করেছেন- এমন শিক্ষকদেরও আমাদের সমাজে মাথায় তুলে রাখবার যে শতাব্দীব্যাপী চেষ্টা, তা আমাকে কখনই স্পর্শ করতে পারেনি। এমন কোন শিক্ষকের কথা ভাবতে পারি না, যিনি না থাকলে আজকে গঙ্গার জলে ভেসে যেতাম।
তার মানে এই নয় কিছু শিক্ষক মনে দাগ কাটেননি। ওই যে ক্লাস সেভেনে থাকতে ঢাকা কলেজের এক সংগ্রামীছাত্রকে আর্থিক সহায়তা করার জন্য আমার বাবা নিজ সন্তানদের পড়া দেখিয়ে দিতে বলেছিলেন, সেই রেজা স্যারের কাছ থেকে বাংলা ভাষার গভীরতা শিখেছিলাম। তা স্কুলজীবনে কোন কাজে না আসলেও, এখনও যে দিস্তার পর দিস্তা মনের কথা অসংকোচে লিখে যেতে পারি, তাতে তার অবদান আছে বৈকি! অথবা নটর ডেম কলেজে প্রাণিবিজ্ঞানের শিক্ষক গাজী আজমলের মনোমুগ্ধকর ক্লাসের কথা তো ভুলতে পারি না। সেই নটরডেমেরই বাংলার শিক্ষক মুখতার স্যার যে অদ্ভুত দক্ষতায় রসিকতার রস মিশিয়ে পদ্মা নদীর মাঝি পড়াতেন, তা ভুলবার জো নেই! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনের আনন্দে ক্লাস করেছি শুধুমাত্র অর্থনীতির শিক্ষক আবুল বারকাতের। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে হার্ভার্ডের অধ্যাপক রিচার্ড ক্যাশের সংক্রামক ব্যাধির ক্লাসে শিহরিত হয়েছি বার বার। মুগ্ধ হয়েছি।
জীবিকার জন্য শিক্ষক যারা, তাদের চাইতে অনেক বেশি শিখেছি অন্য পেশার মানুষদের কাছ থেকে। রাস্তায় হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়বার পর যে মানুষটি টেনে দাঁড় করিয়েছেন, রেস্তোরায় ঢুকবার সময় যে মানুষটি দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থেকেছেন, চরম বিপদের সময় একদম অপ্রত্যাশিতভাবে যে মানুষটি আস্থা রেখেছেন, মিথ্যা অপবাদে ভাসিয়ে দেবার সময় সবচেয়ে কম কথা হওয়া যে মানুষটি বুক চিতিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, নিজের বিপদকে লুকিয়ে রেখে যে মানুষটি হাসি মুখে নিয়মিত খবর নিয়েছেন, তাদেরকেই শিক্ষক হিসেবে চিনেছি, জেনেছি এই জীবনে।
নিকেতনের বাসার কেয়ারটেকার দুলাল, ফার্মগেটের অচেনা অজানা কোন রিকশাওয়ালা, হাতিরঝিলে ঝোল মাখানো ঝালমুড়ি বিক্রেতা, টরোন্টোর ল্যাবে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা ঘর ঝাড়ু দিতে আসা সুইপার, বাসার নিচের ডলারামার কাউন্টারে বছরের পর বছর কাজ করতে থাকা শ্রী লংকার ক্যাশিয়ার আমার আদর্শ শিক্ষক। নানা আলাপে, আয়োজনে, কথায়, কাজে তারা আমাকে জীবনকে চিনতে শিখিয়েছেন, জানতে শিখিয়েছেন।
তবে জীবনে সবচেয়ে বেশি যে দুজন মানুষের কাছ থেকে এগিয়ে যাবার শিক্ষা পেয়েছি, এখনও পাচ্ছি; তারা হচ্ছেন আমার ৭৬ বছর বয়সী বাবা ও ১৪ বছর বয়সী মেয়ে।
সবার জীবনে শ্রদ্ধা করার মতো, মাথা শ্রদ্ধায় নুয়ে আসবার মতো শিক্ষকের আবির্ভাব ঘটুক। দাবি করে না এমন আগ্রাসী, অসহিষ্ণু কাউকে যেন আমরা গুরু মেনে তার চরণে সেজদা না দিই। আমাদের সমাজের এই অতি ভয়ংকর কপট শ্রদ্ধা প্রদর্শন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছি যে আমাদের সন্তানেরা তাদের নিজেদের অর্জনকেও অর্জন মানতে শেখে না, ভাবে এটি তাদের কেউ পাইয়ে দিয়েছে, আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগে।
নিজের যৎসামান্য শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি শিক্ষক কেবল তিনিই নন যিনি শেখান, বরঞ্চ তিনিও যিনি প্রতিনিয়ত শেখেন।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য