প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ | ৩০ জানুয়ারী, ২০২৩
সাম্প্রতিক সময়ে 'গুজব' যেন একটা মরণব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে, এই গুজবের কারণে বিগত প্রায় একযুগ ধরে আমরা যেমন সীমাহীন রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত সম্পদের বিনাশ হতে দেখেছি তেমনি অনেক মূল্যবান জীবন ক্ষয় হতেও দেখেছি।
আমরা কিছুদিন পরপর মসজিদের মাইকে গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধিয়ে জীবন ক্ষয় হতে দেখেছি! 'পদ্মাসেতুতে মানুষের মাথা লাগবে' এমন গুজবের ভিত্তিতে ছেলেধরা তকমা দিয়ে শিশুকন্যার সামনে তার জন্মদাত্রী মা'কে পিটিয়ে মেরে ফেলতেও দেখেছি আমরা! 'সাঈদিকে চাঁদে দেখা গেছে' গুজব ছড়িয়ে দাঙ্গা ফ্যাসাদ বাঁধিয়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করতেও দেখেছি আমরা! আমরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অন্তরালেও গুজব ছড়িয়ে ব্যাপক বিধ্বংসী নৈরাজ্য ঘটাতে দেখেছি!
গুজব থেকে রেহাই পায়নি আমাদের কোমলমতি বাচ্চাদের পাঠ্যপুস্তকও। সাম্প্রতিক সময়ে বাচ্চাদের ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ে ডারউইনের মতবাদ নিয়ে ধর্মীয় গুজব ছড়ানো হয়েছে, ধর্মীয় গুজব ছড়ানো হয়েছে একই শ্রেণির আরেকটি গল্পে ভালুকের দাঁড়ি কামানো নিয়ে। একইভাবে সপ্তম শ্রেণির বইয়ে 'ট্রান্সজেন্ডার' বিষয়ক একটি গল্প নিয়ে না বুঝেই সমকামিতার গুজবও ছড়ানো হয়েছে।
শুরুর দিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিংবা উগ্র মৌলবাদী ধর্মীয় ব্লগেই শুধু গুজব ছড়ানো হতো। কিন্তু এখন গুজবেরও যেন একটা স্বীকৃতি মিলে যাচ্ছে সহসাই, আমাদের প্রিন্ট কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোও 'সবার আগে সর্বশেষ খবর' পৌঁছে দেওয়ার নামে কোনরকম যাচাইবাছাই না করেই সোশ্যাল মিডিয়ার অনেক গুজব তাদের মিডিয়াতে ছাপিয়ে দিয়ে সেইসব গুজবকে যেন প্রকারান্তরে স্বীকৃতি দিয়ে যাচ্ছে! এমনই একটা গুজব বেশ কয়েকবছর যাবত ফেসবুকের বিভিন্নজনের নিউজফিডে বিভিন্ন সময়ে ঘুরতে দেখছি।
গুজবটি হলো এমন- 'বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলে গরুকে যে ইনজেকশন দেওয়া হয়, সেই ইনজেকশনের সিরিঞ্জ যেভাবে প্রয়োগ করা হয়, ঠিক প্রাইভেট হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত রোগীকে সেভাবে সেই সিরিঞ্জ পুশ করে ২৮ থেকে ৩২ দিন কৃত্রিমভাবে জীবিত রাখা যায়। দেখে মনে হবে রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস আছে। যা সাধারণ মানুষের বোঝার কোনো উপায় থকে না। তাই কোনো রোগীকে মৃত অবস্থায় আইসিইউ থেকে বের করার পর সঙ্গে সঙ্গে রোগীর বগলে কোনো ছিদ্র আছে কিনা সেটা ভালো করে দেখতে হবে। যদি কোনো ছিদ্র থাকে বুঝে নিতে হবে মৃত রোগীকে দীর্ঘ সময় কৃত্রিমভাবে জীবিত রাখা হয়েছিল। এ ছিদ্রটি পরীক্ষা করলেই পরিষ্কার ধারণা মিলবে যে, মৃত রোগী অনেক আগেই মারা গেছে। গরুর ইনজেকশন দিয়ে বাঁচিয়ে রেখে দীর্ঘদিন বাণিজ্য করেছে হাসপাতাল মালিকরা!'
এটি যে স্রেফ একটি গুজব সেটা যেকোনো শিক্ষিত লোকের পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব। অথচ এই ব্যাপারটিকে কোনরকম যাচাইবাছাই না করেই একদিন দেখলাম একটি বহুল পঠিত পত্রিকা ছেপে দিয়েছে! এ যেন নিরেট একটি গুজবের একটি মার্জিত আভিধানিক স্বীকৃতি!
আগেই বলেছি, ফেসবুকের নিউজফিডে গুজবটি বহুবার দেখেছি কিন্তু পাত্তা দিইনি। কিন্তু যখন একই গুজব একটি বহুল পঠিত পত্রিকার পাতায় দেখলাম তখন তো পাত্তা না দেওয়ার আর সুযোগ থাকে না। এক্ষেত্রে এগিয়ে এলো রিউমার স্ক্যানার বাংলাদেশ (Rumor Scanner Bangladesh) নামে ফেসবুকের একটি পেজ। এই পেইজটি তৈরি হয়েছে প্রায় বছরখানেক আগে, গুগল প্লে-স্টোরে এই সংক্রান্ত তাদের একটি অ্যাপও আছে। এখানে বেশকিছু উদ্যমী তরুণ সোশ্যাল মিডিয়াসহ ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচারিত বিভিন্ন গুজবের ফ্যাক্ট চেক করে প্রকৃত সত্য তুলে আনার চেষ্টা করেন।
তাদের সাফল্য নিতান্ত কম নয়। তাদেরকে নিয়ে আশাবাদী হয়ে প্রায় বছর খানেক আগে তাদের সূচনালগ্নেই আমিও ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। গুজবটি যখন রিউমার স্ক্যানারের চোখে পড়ে তখন তারা এর সত্যতা জানতে আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। আমি সহজ ও বোধগম্য কথ্যভাষায় তাদেরকে যেটা বলার চেষ্টা করেছি সেটা অনেকটা এরকম- গরুকে যে ইনজেকশন দেওয়া হয় হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত রোগীকে সেই সিরিঞ্জ পুশ করে ২৮ থেকে ৩২ দিন কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখার দাবিটি নির্জলা মিথ্যা ও বানোয়াট একটি তথ্য। আইসিইউতে মৃত রোগীর বগলে সূক্ষ্ম ছিদ্র থাকলেই ধরে নিতে হবে যে মৃত রোগীকে গরুর ইনজেকশনের সিরিঞ্জ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হয়েছে এমন দাবিরও কোন যৌক্তিকতা নেই।
বস্তুত: আইসিইউতে যেসব রোগী থাকে তাদের চিকিৎসা ও ফিজিক্যাল নিউট্রিশনের প্রয়োজনে অনেকসময়ই তাদের শরীরের উপরিভাগে কলারবোন (Clavicle)'র নিচে (বগলের কিছুটা কাছাকাছি তবে বগলে নয়) বিশেষায়িত একধরনের সিরিঞ্জ (সেন্ট্রাল ভেনাস ক্যাথেটার) দ্বারা একটি চ্যানেল (TPN Access) তৈরি করা হয় যার মাধ্যমে রোগীকে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও নিউট্রিশনাল সাপোর্ট দেওয়া হয়। এটা করা হয় জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও নিউট্রিশনাল সাপোর্ট দিয়ে রোগীকে সুস্থ করে বাঁচিয়ে তোলার জন্য, মৃত রোগীকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নয়।
যদি দুর্ভাগ্যবশত আইসিইউতে কোন রোগী মারা যায় তাহলে তাকে আইসিইউ থেকে বের করার সময় তার শরীরে সংযুক্ত এই বিশেষ চ্যানেলটি (সেন্ট্রাল ভেনাস ক্যাথেটার)-সহ সকল পেরিফেরাল্স যেমন ইউরিনারি ক্যাথেটার কিংবা এনজি টিউব (যদি থাকে) খুলে ফেলা হয়। কেউ হয়তো এমনই কোন মৃত রোগীর বগলের কাছাকাছি জায়গায় এই বিশেষ চ্যানেল বা সেন্ট্রাল ভেনাস ক্যাথেটারের এই ছিদ্রটি দেখে এটাকেই গরুর ইনজেকশনের সিরিঞ্জের ছিদ্র বলে চালিয়ে দিয়েছে! আর তা দেখেই পত্রিকাওয়ালারা কোনরকম যাচাইবাছাই না করেই সেটাকে মৃতরোগীকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখার উপায় হিসেবে ছেপে দিয়েছে!
আমাদের দুর্ভাগ্য হলো তারা ঘটনার গভীরে যাওয়ার কোন চেষ্টাই করেনি, অথচ বর্তমানের এই ডিজিটাল বাংলাদেশে তারা আর কিছু না পারুক নিদেনপক্ষে একটু গুগল করলেই দেখতে পেতেন- এই ছিদ্রটি করা হয়েছিলো রোগীকে সুস্থ করে বাঁচিয়ে তোলার জন্যই, মৃত রোগীকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নয়।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য