আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

চিকিৎসকদের পেশার শক্তি বাড়বে যেভাবে

ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ  

গত ২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনের পর ডাক্তারদের একটি মহল চিকিৎসা চর্চা ও গবেষণা বাদ দিয়ে সরকারি চাকরি অথবা রাজনীতিতে চলে যান। আরেক শ্রেণি আছেন, তারা শুধু টাকা কামাতেই ব্যস্ত। এটা কাম্য নয়। অনেকে আবার একইসঙ্গে সরকারি চাকরি ও প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করেন। চাকরি ও প্র্যাকটিসের পর তাদের গবেষণার কাজটা আর করা হয়ে ওঠে না।’

প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে আমাদের চিকিৎসকদের অনেকেই মনক্ষুণ্ণ হয়েছেন, বিশেষ করে চিকিৎসকদের মাঝে আমরা যারা সরাসরি স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) রাজনীতি করি তাদের অনেককেই দেখলাম চিকিৎসকদের রাজনীতিকে নিরুৎসাহিত করে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে যারপরনাই বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন।

আমি অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে ভিন্নভাবে দেখতে চাই। আমরা যারা ছাত্রজীবনে রাজনীতি করে আসার পর প্রফেশনাল লাইফেও রাজনীতির (স্বাচিপ) সাথে সংযুক্ত আছি, তারা আসলে মূল সংগঠন দ্বারা কতোটা মূল্যায়িত হওয়ার সুযোগ পাই সেটা কি একবারও ভেবে দেখেছি?

আওয়ামী লীগের অন্যান্য সহযোগী বা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের মাঝে যেগুলো কিছুটা কম গুরুত্বপূর্ণ, দলীয় হাইকমান্ড কি আমাদেরকে তাদের কাতারেও আদৌ কখনো মূল্যায়ন করে?

আমাদের মাঝে যারা এমবিবিএসের পাঠ চুকিয়ে প্রফেশনাল লাইফ ছেড়ে সরাসরি শুধুমাত্র জাতীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকেছেন তাদের মাঝে কয়েকজন মূল দল বা হাইকমান্ড দ্বারা মূল্যায়িত হয়েছেন বটে, তবে তাদের মূল্যায়নের হেতু আমাদের পেশাজীবী সংগঠন স্বাচিপ নয়, বরং তাদের মূল্যায়নের হেতু জাতীয় রাজনীতিতে তাদের ত্যাগ ও শ্রম। এবং এটাও সত্য যে তারা জাতীয় রাজনীতিতে তাদের চিকিৎসক পরিচয় ভুলে গিয়েই এই মূল্যায়ন অর্জন করতে পেয়েছেন।

পক্ষান্তরে যারা চিকিৎসক পরিচয় ধরে রেখে পেশাজীবী সংগঠনের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকেন, তারা না পারেন পেশার জন্য কিছু করতে, না পারেন মূল সংগঠনে মূল্যায়িত হতে!

একুশে আগস্টের নির্মমতায় আহতের শুশ্রূষায় নিজের বুক উজাড় করে তাদের ভূমিকা, বিরোধী দলে তাদের নিষ্ঠা ও শ্রম, লগি-বৈঠার মিছিলে তাদের ত্যাগ ও বলিষ্ঠ অবস্থান, রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় তাদের তড়িৎ তৎপরতা, শাহবাগের মোহনায় তাদের অংশগ্রহণ, বন্যা-খরা, করোনা-ডেঙ্গু বা যেকোনো মহামারিতে পেশাজীবী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে তাদের সাংগঠনিক ভূমিকা কোনোটাই মূল দলের কাছে কোন গুরুত্বই পায় না, কোনভাবে মূল্যায়িত হয়ও না।

অথচ আমরা দেখেছি সেই বায়ান্ন থেকে শুরু করে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে, একাত্তরের রক্তধোয়া অগ্নিঝরা সংগ্রামে এবং নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে চিকিৎসকদের সংগ্রামী ভূমিকা তাদেরকে সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল স্তরে কীভাবে গৌরব ও শ্রদ্ধার শিখরে নিয়ে গিয়েছিলো।

আমরা দেখেছিলাম কোন পেশাজীবী রাজনৈতিক সংগঠন না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র বিএমএ-এর নেতৃত্বে চিকিৎসকরা তাদের পেশার বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায়ে আশির দশকের শেষের দিকে এরশাদশাহীর তখতকে কিভাবে কাঁপিয়ে দিয়েছিলো।

বস্তুত: বিএমএকে পাশ কাটিয়ে নব্বই দশকের শুরুর দিকে যেদিন থেকে ড্যাব ও স্বাচিপসহ চিকিৎসকদের বিভিন্ন পেশাজীবী রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম হয়েছে, সেদিন থেকেই বিএমএ যেমন তার শক্তি হারিয়েছে তেমনি পেশাজীবী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও মূল দলের লেজুড়বৃত্তি ছাড়া পেশার জন্য ইতিবাচক কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি, মূল সংগঠন দ্বারা মূল্যায়িতও হতে পারেনি।

এসব পেশাজীবী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর কাছে সাধারণ চিকিৎসকদের চাওয়া খুব বেশি না; শুধু একটাইমাত্র চাওয়া, একটাইমাত্র প্রাণের দাবি। আর সেটা হলো- 'নিরাপদ কর্মস্থল ও নিরাপদ কর্ম পরিবেশ।' এই একটামাত্র দাবি পূরণেও তারা আজ পর্যন্ত শতভাগ ব্যর্থ।

আমরা দেখেছি, শুধুমাত্র এই একটা দাবিতেই যতবারই আমরা চিকিৎসকরা সোচ্চার হয়েছি, ততবারই কোন না কোন মুলা ঝুলিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে; কিংবা যতবারই আমরা দাবি আদায়ের কাছাকাছি পৌঁছেছি, ততবারই আমাদের চিকিৎসক নেতারা পেশার স্বার্থ ভুলে গিয়ে মূল দলের লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে দাবি আদায়ের বারোটা বাজিয়েছে!

নিকট অতীতে আমরা বগুড়া মেডিকেলের ইন্টার্ন আন্দোলনকে এভাবেই মুখ থুবড়ে পড়তে দেখেছি, সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসক নির্যাতনের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলনেরও এমনিভাবে যবনিকাপাত ঘটতে দেখেছি!

অতি সম্প্রতি খুলনাতে অপরারেশন থিয়েটারে (ওটি) ঢুকে চিকিৎসক নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা স্থানীয় চিকিৎসক আন্দোলনও মনে হয় একই পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

সেখানে স্থানীয় বিএমএ'র উদ্যোগে চিকিৎসকদের কর্মবিরতি চলছিল। হঠাৎ করে চিকিৎসক নির্যাতনকারী সেই পুলিশ সদস্যের কোনরকম দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়াই সংশ্লিষ্ট উভয়পক্ষের উচ্চমহলের সমঝোতায় বিএমএ তাদের কর্মসূচি স্থগিত করতে একরকম বাধ্য হয়েছেই বলা যায়!

নির্মম পরিহাস হলো, এখানে পুলিশের উচ্চমহল তাদের অভিযুক্ত সদস্যকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে আর চিকিৎসকদের উচ্চমহল 'জি হুজুর, জি হুজুর' করে নিছক আত্মসমর্পণ করেছে! সেলুকাস!

চিকিৎসকদের জন্য এটাও একটা দুর্ভাগ্য যে তাদের নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর কখনোই সহমর্মিতার পরশ নিয়ে তাদের পাশে এসে শক্ত অবস্থান নিয়ে দাঁড়ায়নি!

যখন শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়েছে তখন আমরা খোদ শিক্ষামন্ত্রীকে লাঞ্ছিত শিক্ষকের পাশে দাঁড়িয়ে সহমর্মিতা জানাতে দেখেছি, লাঞ্ছনাকারীদের শাস্তিবিধানে স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রীকে উদ্যোগ নিতে দেখেছি। কোন পুলিশ সদস্যের বিপদে-আপদে আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও দায়িত্ব নিয়ে পাশে দাঁড়াতে দেখেছি। অথচ ডেঙ্গু-করোনাতে নিহত আমাদের শতশত চিকিৎসকের একজনেরও স্বজনের পাশে দাঁড়িয়ে আজ পর্যন্ত তার খবরটা নেওয়ার সময় হয়নি আমাদের 'মহাব্যস্ত' স্বাস্থ্যমন্ত্রীর!

কেন এমনটা হলো, একবারও ভেবে দেখেছেন?

অনেক কারণই থাকতে পারে তবে সবচেয়ে মুখ্য এবং বড় যে কারণ সেটি হলো আমাদের পেশাজীবী রাজনীতি। এই পেশাজীবী রাজনীতির নামে লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়েই আমরা আমাদের গাটস হারিয়ে ফেলেছি, আমরা আমাদের পেশার সামষ্টিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছি।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন যে আমরা চিকিৎসকরা সরাসরি রাজনীতি করি এটা তিনি চান না। প্রধানমন্ত্রীর কথামতো আমরা যদি রাজনীতি ছেড়ে শুধু পেশা নিয়ে পড়ে থাকতে পারি, প্রধানমন্ত্রীর কথামতো আমরা যদি রাজনীতি ছেড়ে শুধু গবেষণা (গবেষণার জন্য অবশ্য তেমন অনুকূল পরিবেশ ও পর্যাপ্ত বরাদ্দ বা প্রণোদনাও প্রয়োজন) নিয়ে পড়ে থাকতে পারি, তাহলে দেখবেন আমাদের গাটস এবং পেশার শক্তির (পেশিশক্তি নয়, পেশার শক্তি) পারদ বাড়তে থাকবে।

কারণ তখন আমরা কর্মস্থলে নির্যাতিত বা লাঞ্ছিত হলে তার প্রতিবাদে যে প্রতিবাদ কর্মসূচি দেবো সেই কর্মসূচিতে কোন রাজনৈতিক পিছুটান থাকবে না, দলীয় লেজুড়বৃত্তির ধুম্রজালে জর্জরিত কোন সুতার টান থাকবে না, তখন তখতে কে বসে আছে সেটা নিয়ে আমাদের কোন দায়বদ্ধতা থাকবে না, তখন আমাদেরকে পেশার কল্যাণকামী স্বার্থের বাইরে আর কারো স্বার্থের পিছে ছুটতে হবে না।

তখন আমাদের প্রতিবাদের শক্তি কতোটা দুর্দমনীয় আর কতোটা অবিচল হতে পারে তা কল্পনাও করতে পারবেন না! তখন দেখবেন আমাদের ন্যায্য দাবি পূরণে রাষ্ট্র ও তার পরিচালকরা কীভাবে তড়িৎ গতিতে এগিয়ে আসবে।

সেই শুভদিনের সেই শুভক্ষণের প্রতীক্ষায় রইলাম।

পুনশ্চ: পেশাজীবী রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া মানে ব্যক্তি পর্যায়ে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া নয়। কোন একজন নাগরিকের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও আদর্শ থাকতেই পারে। প্রধানমন্ত্রীর কথামতো আমরা চিকিৎসকরা যদি সাংগঠনিক রাজনীতি ছেড়ে ব্যক্তিজীবনে রাজনৈতিক আদর্শটুকু ধরে রাখি তবে সেটুকুই যথেষ্ট। সেটা নিজের জন্য লাভজনক না হলেও পেশার জন্যও ক্ষতিকর হবে না, এটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়।

ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ, সাবেক সহ তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ