Advertise
রহিম আব্দুর রহিম | ১২ মার্চ, ২০২৩
যুগ যুগ ধরে ধর্ম মানুষকে সত্য সুন্দর আর কল্যাণের পথ দেখাচ্ছে। আইয়্যামে জাহেলিয়া যুগের বর্বরতার বিরুদ্ধে এবং মানব সমাজে শান্তির বার্তা নিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সৃষ্ট ইসলাম প্রতিষ্ঠিত। যে ধর্মের নীতি আদর্শ মানবের কল্যাণ এবং পৃথিবীর প্রাণিকুলের প্রতি সদয় হওয়া। সকল জাতি, সম্প্রদায়ের জান মালের হেফাজত করাও এই ইসলামেরই অন্যতম আদর্শ।
হিন্দুরা বিশ্বাস করেন তাদের ধর্ম শ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে বৃহত্তম জনসংখ্যার খ্রিস্টধর্ম মনে করেন তাদের ধর্মের উপরে অন্য কোন ধর্ম নেই, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস তাদের ধর্মই সর্বশ্রেষ্ঠ। আমরা ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা বিশ্বাস করি যে, পরকালের ৮টি জান্নাত ইহকালের পুণ্যবানদের জন্য। ৭টি জাহান্নামে প্রবেশ করবে ইহকালের পাপীরা। ধর্মভীরু বা ধর্মান্ধরা বিশ্বাস করে তারা ছাড়া পৃথিবীর সকল ভিন্নধর্মীরা জাহান্নামে যাবে। একমাত্র তারাই জান্নাতবাসী হবে। ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্ম ব্যবহার করে ব্যক্তি, পরিবার কিংবা তাদের দলভুক্তদের আখের গোছানোর কাজটি করে। ধর্মব্যবসায়ী এবং ধর্মান্ধরা তাদের কথায় ও কাজে স্পষ্ট করেন, তারা ব্যতীত ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা মৃত্যুর পর অনন্তকাল আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলবে। জ্বলতে থাকবে অনবরত কিন্তু মৃত্যু হবে না! বিষয়টি ভাবতেও বেশ হৃদয়বিদারক। এভাবে পৃথিবীতে বিদ্যমান ৪ হাজার ৬শ ধর্ম-মতের বিশ্বাসীরা তাদের নিজেদের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম মনে করেন।
আজ থেকে চৌদ্দ'শ বছর পূর্বের সৃষ্ট পৃথিবীর মহান ধর্ম বলে খ্যাত ইসলাম ধর্মের অনুসারী একদল ধর্মান্ধ প্রায়শই হিন্দুদের মন্দিরে আক্রমণ, তাদের পূজনীয় দেব-দেবীর মূর্তি ভাঙচুর করে আসছে। আহমদিয়া মুসলিম জামায়াতের অনুসারীদের উপর আক্রমণ ও তাদের ধর্ম বিশ্বাস পালনে বাধা দিচ্ছে। কারণে অকারণে ধর্মকে ব্যবহার করে দেশকে উত্তপ্ত করছে।
সম্প্রতি ভিন্ন মতাবলম্বী হওয়ার কারণে শরিফুল ইসলাম নুর নামে একজন ধর্মীয় বক্তার জিব কেটে ফেলেছে ধর্মান্ধ উগ্রপন্থী একদল নরপিশাচ। আহমদিয়া মুসলিম জামায়াতের কথা না হয় বাদই দিলাম।
এই আমরা কেউ সুন্নি, ওহাবী, ইবাদি, খারিজী, যায়িদী, জাহিরি, ইসমাইলি, হানাফি, সালাফি, মালিকী, হানবালি, আশারি, আহমাদিয়া, বারেলভি, দেওবন্দী, দ্রুজ, সুফরিশ, হারুরিস, আজারিকা, দ্বাদশী, আলারাইট, মুতাজিলা, শাফি, তাবলীগ জামাতি, সুফী জাফরি, আহলে-হাদিসসহ ইত্যাকার নানা গোত্রে বিভক্ত। নূর মোহাম্মদ নামের কাতার প্রবাসী এক লেখকের মতে, "কবি-শায়েরদের বানানো কিছু উর্দু-ফারসি কবিতা যেমন তালিবউদ্দিন আহমদের লেখা 'ইয়া নবী সালামু আলাইকা', আহমেদ রেজা খান বেরলভীর 'মুস্তফা জানে রহমত পে লাখো সালাম', ফারসি কবি রুমির "বালাগুল ওলা বেগুমালিহি" অথবা 'হাসবি রাব্বি জাল্লাল্লাহ মাফি কালবি গাইরুল্লাহ – এই গজল গেয়ে ধার্মিক হওয়া যায় না। ধার্মিক হাওয়ার প্রথম শর্ত অন্যান্য ধর্ম, মত, আক্বিদার প্রতি সহনশীল হওয়া।"
অন্য কারো ধর্মবিশ্বাস আপনার ধর্মবিশ্বাসের কাঠামো, আকৃতি, প্রকৃতি এক নাও হতে পারে। এ নিয়ে কারো মাথা ফাটিয়ে দিতে হবে, মেরে ফেলতে হবে, জিহ্বা কেটে ফেলতে হবে, হাত পায়ের রগ কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করতে হবে, এই ধর্মতত্ত্ব পৃথিবীর কোন ধর্মে নেই এবং থাকার কথা নয়। যদি কোন ধর্মে এমনটা থাকে তবে বুঝতে ওই ধর্মটিই জল্লাদ ধর্ম। ধর্মের নামে আপনি কাউকে আঘাত, ক্ষতি, জখম, অপকার, অনিষ্ট, মন্দ কিছু করবেন, তা শান্তি বা ন্যায়ের প্রতীক হতে পারে না। যখন তখন, যে কাউকে কাফের, মুশরিক, মুনাফিক, নাস্তিক ইত্যাদি উপাধি দিয়ে বসবেন না। এতে করে নিজের ঈমান এবং আমল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
আপনি যেহেতু বিশ্বাস করেন, আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, তাহলে আপনার বিশ্বাস করা উচিত- কে প্রকৃত ঈমানদার বা মু'মীন আর কে কাফের, কে মুশরিক আর কে তাওহীদের পথে হাঁটছেন, কে জান্নাতি আর কে জাহান্নামি, তা একমাত্র আল্লাহ জানেন। এজন্য - ঈমানদার, বেইমান, কাফের, মুশরিক, মুনাফিক ইত্যাদি উপাধি যে কাউকে যখন তখন দেয়া যায় না। যদি কারো কোনো কাজ শিরক, কুফর কিংবা নিফাক বলে গণ্য করা হয় এবং তার সংশোধন দরকার বলে আপনি মনে করেন, তবে আপনি আলোচনা সভার আয়োজন করতে পারেন, বই লেখতে পারেন, পত্রিকায় কলাম লেখতে পারেন। জানাতে পারেন আপনার মতামত। এমনকি আপনি কারো আদর্শ, চিন্তা, বিশ্বাস কিংবা কর্ম দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিংবা ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন এমন আশঙ্কা থাকলে রাষ্ট্রের কাছে নিরাপত্তা চাইতে পারেন। কিন্তু বিশ্বাস নিয়ে যুদ্ধে নেমে নিজের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কাউকে আঘাত করতে পারেন না, কারো উপরে আপনার বিশ্বাস চাপিয়ে দিতে পারেন না, কাউকে আপনার বিশ্বাস আত্মস্থ করতে বাধ্য করতে পারেন না।
মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র সবার। যিনি আপনার ধর্ম পালন করেন এবং যিনি আপনার আদর্শিক ধর্মের বাইরে ভিন্ন কোন ধর্ম পালন করেন , রাষ্ট্র উভয়েরই। যিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন তিনিও যেমন রাষ্ট্রের কাছে নিরাপত্তা পাওয়ার বৈধতা রাখেন, তেমনি যিনি বিশ্বাস করেন না, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
সবার নৈতিক চিন্তা, বিশ্বাস এবং কর্মের স্বাধীনতা আর নিরাপত্তা দেবে রাষ্ট্র। এটাই রাষ্ট্রের কাজ। মনে রাখবেন, আপনার বিশ্বাস মতে যিনি কাফের, তার বিশ্বাসে হয়তো আপনি কাফের। রাষ্ট্র যেহেতু সবার, ঈশ্বর নিজেও যেহেতু সবার, তাই যে যার ধর্ম পালন করবে, কারো বিশ্বাস কারো উপরে চাপিয়ে দেবে না, এটা ধর্ম এবং রাষ্ট্রের শিক্ষা।
যারা প্রকৃত ধার্মিক, তারা সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করেন নিজের চিন্তা এবং কাজ নিয়ে। "আমি ঈমানদার কি না, আমার বিশ্বাস কিংবা কর্ম অন্য কারো জন্য ক্ষতির কারণ হচ্ছে কি না,আমার ধর্ম-বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অন্য কারো ক্ষতি হচ্ছে কি না, কারো সম্পদ লুট করছি কি না, বিশ্বাসের যুদ্ধে নেমে রক্তপাত করছি না তো? নিজের বিশ্বাস এবং কর্ম দিয়ে সত্যিকার অর্থে ধার্মিক হতে পেরেছি তো?"
এই আত্মসমালোচনা গুলোই হলো ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির আদর্শ। এরবাইরে যারা অবস্থান করছে, তারা ধর্মের লেবাসে প্রতিষ্ঠিত ভয়ংকর রকমের ধর্মের নীতি আদর্শের শত্রু।
ধর্মের নামে রক্তপাত, লুটতরাজ, খুন যারা করছেন নিঃসন্দেহে তারা ধর্মের নীতি আদর্শকে কলঙ্কিত করছেন।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য