প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫
বেয়াইপুরের ঘরে ঘরে আজ যেন ঈদ। মদিনার সৌরভ। এই প্রথমবারের মত বেয়াইপুরে একটি চক্ষু হাসপাতালের দ্বার উদঘাটন হতে যাচ্ছে। বেয়াইপুরে স্বস্তির হাওয়া রাত। সত্যজিত নির্বাসিত; মিথ্যাজিতের ঢাক ঢোল কাসর বাজছে; সম্প্রীতির কমলা বৃষ্টিতে গোপন পালেদের মুখমন্ডল কমলায়িত। দয়াময় বেয়াইপুর পরগণার এখন জায়গীরদার; আগের জায়গীরদার করুণ গুহ এখন দয়াময়ের দাবা খেলার নিত্যসঙ্গী। পড়তি জমিদার ও উঠতি জমিদারের এমন প্রেমগাথা হয়তো কিংবদন্তী হবে; সম্প্রীতির ফেভিকল নৈকট্যের মাইলফলক হবে।
বেয়াইপুরের কারাগারে মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষক তাপস মুখার্জির মানসচক্ষুর উন্মীলন হয়। করুণ গুহ এবং দয়াময় বেয়াই এ দুজনের শ্রেণীচরিত্র তার কাছে স্পষ্ট হয়ে আসে। বুঝতে পারে মুক্তির মন্দির সোপানতলে এতো প্রাণবলি কেবলই শাসকের চেহারা বদলায়। কিন্তু শ্রেণী চরিত্র বদলায় না। মুক্তিযুদ্ধের সময় এক পাঞ্জাবের নরভোজী মেজরকে তাপস দেখেছিলো; ভাবতে অবাক লাগে দয়াময় বেয়াইয়ের সঙ্গে চেহারা আর মেজাজের কী মিল! কে জানে ওদিকেও কোন বেয়াই ঘুড়ির লাটাই ছিলো হয়তো। অথবা সৃষ্টিকর্তা চেহারায় গেঁথে দেন মনের চিহ্ন। এই যে দয়াময় বেয়াই চোখ পিট পিট করে ধমক দেয়; ঐ পাঞ্জাবের মেজরটিও ঠিক তাই করেছিলো।
প্রথমে দয়াময় জায়গীরদার যখন সাংবাদিক সুবীরকে পাগল বলেছিলো; সবাই ভেবেছিল উনি হয়তো পাগলের ডাক্তার; সুতরাং বেয়াইপুরে মানসিক হাসপাতাল নির্মাণের জন্য কোন হিন্দু সম্পত্তি দখল করা যায় তা সবল চন্দ্র আর গোপন পাল প্রায় ঠিক্-ঠাক করে ফেলেছিলো। পরে আইনজীবী রণো দাশের কারণেই চক্ষু হাসপাতাল নির্মাণের প্রয়োজন হয়ে পড়লো। দানবীর দয়াময় বেয়াই ২০ কোটি টাকার সম্পত্তি চটের থলেতে ২ কোটি টাকা দিয়ে করুণ গুহর কাছ থেকে কিনে অশেষ নেকি হাসিল করেছেন। সেই কৃতজ্ঞতায় করুণ গুহের চোখ দিয়ে গোলাপী অশ্রু ঝরে; তার মেয়ে সেই গোলাপী রঙের অশ্রু দিয়ে তুলিতে আঁকে সম্প্রীতির আনন্দচিত্র।
কোথাকার কোন রণো দাশ বেয়াইগ্রামের লোক; বেয়াই নগরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের পক্ষে ওকালতি করে; সে কেন বেয়াইপুরের এই হিন্দু সম্পত্তি অত্যন্ত ন্যায্যমূল্যে চটের থলেতে সুখের বিনিময়ে ক্রয় বিক্রয় নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। করুণ গুহ হচ্ছে দানবীর দয়াময় বেয়াইয়ের হরিণ; তাকে উনি সুখ দিয়েছেন; অশ্রুসিক্ত কৃতজ্ঞতা দিয়েছেন; পারবে রণো দাশ এতো নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ আদায় করতে। রণো দাশকে কীভাবে টাইট দেয়া যায়; সেটাই আলোচ্য বিষয়। গোপন পাল জানায়, বেয়াই নগরে গুঞ্জন রায় নামে সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হয়েছে। সে একটা গুজবের ব্যঞ্জন রেঁধে দেবে কথা দিয়েছে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা তো করতেই হবে।
জায়গীরদার সাহেব ভদ্রলোক। শুধু রেগে গেলে হিন্দুদের –লু বলে গালি দেয়; গোপন পালেরা এটাকে আজকাল আদরের সম্ভাষণ হিসেবে মেনে নিয়েছে। তবে সবলচন্দ্র মনে করে জায়গীরদার সাহেবের একটা স্বামী বিবেকানন্দ ইশটাইলে প্রেস কনফারেন্স করা জরুরী।
জায়গীরদার দয়াময় বেয়াই বলেন, আমরা শুধু দিয়েই গেলাম, নিতে শিখিনি; এ পরগণায় যে সম্পদ আছে তা ভোগ করার লোক নেই। কী আছে সম্পদে; দুইদিনের দুনিয়া! বেয়াইপুরের লোকেরা সমবেত ক্রন্দন কর্মসূচী পালন করে। ওদিকে ৭০ বছর বয়েসী তাপস মুখার্জির জামিন বারবার বাতিল হয়। পুতুল বিচারালয় কখনো পকেটমারা, কখনো চামচ চুরি, কখনো জোরে হাঁচ্চি দেয়া ইত্যাদি নানা ফৌজদারী অপরাধে ৭০ বছরের বৃদ্ধ মুখার্জিকে জেলের ঘানি টানাচ্ছে। দয়াময় বেয়াই তাপস মুখার্জিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও সারাজীবন শিক্ষকতার পুরস্কার দিয়েছে। কিছু নেয়নি। উনারা তো শুধু দিয়েই অভ্যস্ত। মনে পড়ে, পাঞ্জাবের সেই মেজরের সম্মানে ক্যাম্পে শান্তি কমিটির বুজুর্গরা মুরগা-মোসাল্লাম পাঠাতো। জায়গীরদার সাহেবের আব্বাও শান্তিকার ছিলেন। শান্তির জন্য তিনি একটি ছাগল জবেহ করেছিলেন বৈকি।
তাপসের অবাক লাগে; এদের কী ক্ষমতা কপাল! পতাকার রঙ বদলালেও কিংবা মানচিত্র সংবিধান বদলালেও শান্তিকারেরা বসে থাকে মনোহর ক্ষমতার চেয়ারে। অশ্রু জমাট হতে হতে মুক্তিযোদ্ধা মুখার্জির চোখ দুটো পাথর হয়ে যেতে থাকে। কারাগারের বাইরে থেকে “বাংলার হিন্দু-বাংলার বৌদ্ধ... বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালি” গানটি ভেসে আসে। বেয়াইপুরে সারাক্ষণই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান বাজছে। সম্প্রীতির বিশাল বিজয়ের প্রতীক হিসেবে শোনা যাচ্ছে করুণ গুহ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হবে।
সাংবাদিক গুঞ্জন রায়ের পান্ডুলিপি এসে পড়ে। গুঞ্জনের একই পান্ডুলিপি। অন্যায়ের প্রতিবাদকারীকে বিদেশী এজেন্ট বলে দেয়া। এজেন্ট যেন গুঞ্জন রায়ের গাছের মোয়া। অত্যন্ত দুর্বল ছাত্র বলে তার প্লট বারবার দুর্বল হয়ে যায়। তবু সে ঐ একটাই পান্ডুলিপি ফেরি করে। গোপন পাল আরো খারাপ ছাত্র। গোরুর রচনা ছাড়া আর কিছুই লিখতে পারে না। ফলে গুঞ্জন রায়ের ষড়যন্ত্র তত্ত্বটিই জায়গীরদার সাহেবকে জানায়।
বেয়াই সাহেব এটা লুফে নেয়। গল্পটা তো ভালোই। সুতরাং অগ্রপশ্চাত না ভেবেই প্রেস কনফারেন্সে আইনজীবী রণো দাশকে এজেন্ট বলে দেয়। আর সাবধান করে দেয়। বেয়াইপুরের দিকে তাকাবেন না রণো দাশ; আপনার চোখ তুলে নেবো!
বেয়াইপুরে আনন্দের কলরোল। জায়গীরদার সাহেব শুধু পাগলের ডাক্তার নয়, সে চোখেরও ডাক্তার।
সুতরাং আর মানসিক হাসপাতাল নয়। এখানে গড়ে উঠবে দয়াময় চক্ষু হাসপাতাল। যে বেয়াইপুরের দিকে রণো দাশের মত তাকাবে, তাকেই এজেন্ট বলে চোখ তুলে নিয়ে, হাসপাতালের চক্ষু ব্যাংকের বয়েমে রেখে দেয়া হবে। সবল-চন্দ্র স্থানীয় পত্রিকায় বেয়াই স্তুতি কলাম প্রকাশ করে। দয়াময়ের মাঝে তিনি সাক্ষাত মুঘল সম্রাট আকবরকে দেখতে পান। হিন্দুর চোখ তুলে কানা মুসলমানের চোখে ফিট করে দিলে; এরচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তো আর হয়না।
এই আর্টিকেল পড়ে বেয়াইপুরে আবার কান্নার রোল পড়ে যায়। জায়গীরদার সাহেবের আইন-ই-দয়াময় ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
জায়গীরদার সাহেবের ধমকে কাজ হয়। আর কেউ ভুল করেও বেয়াইপুরের দিকে তাকায় না; কে আর ওদিকে তাকিয়ে চোখ খোয়াতে চায়।
অবশেষে দয়াময় চক্ষু হাসপাতালের শিলান্যাসের দিনটি আসে। এখন শিলান্যাসের দিনে জায়গীরদার মহোদয়ের সামনে একটি হিন্দু চোখ উপড়ে বয়েমে না ভরা হলে আয়োজনটি ঠিক জমে না। গোপন পাল চিন্তায় পড়ে যায়। সবল চন্দ্র কটা দিন একটু দূরে দূরে থাকে। পাছে কাউকে না পেয়ে তার চোখ দুখানি উপড়ে নিলেও বলার কিছু নেই; রাজা-বাদশাহদের কখন কোন খেয়াল চাপে বলা কঠিন।
এবং সত্যিই সে সমস্যা হয়। রণোদাশকে এতো সহজে মিথ্যা মামলা দিয়ে বেয়াইপুরে এনে চোখ তোলাটা খুব সহজ হবেনা। সুবীর সাংবাদিককে আনলেও ঝামেলা; বেয়াইনগরে এরা পরিচিত; ঘোড়ার ডিমের সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয়ে যাবে আন্দোলন। জায়গীরদার সাহেব বলে, ও গোপন পাল হিন্দু পাইনা তো; অগত্যা তোমার চোখ দুইটাই তুলতে হবে; নাইলে হাসপাতালের চক্ষু ব্যাংকের বয়েমটা যে একেবারেই খালি দেখা যায়। গোপনের মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ে। এই ছিলো মোর ভালে। ইচ্ছা করে দয়াময় ভবনের গোল পিলারে নিজের মাথাটা ঠুকে ফাটিয়ে ফেলে!
তার মাথায় তড়াং করে বুদ্ধি খেলে যায়। সে বলে, স্যার তাপস মুখার্জির চক্ষু তুইলা নিলেই হবে; তারে পুতুল সান্ত্রী সেপাই দিয়া চক্ষুদান কাগজ পত্রে স্বাক্ষর করায়ে নেয়া যাবেনে। আপনি চাইলে তাকে দিয়ে করুণ গুহের মত একটা প্রেস কনফারেন্সও করা যাবে। ঐ একই স্ক্রিপ্ট; বাড়ী-জমির জায়গায় চক্ষু বসাইয়া নিলে খাপে খাপে মিলে যাবেনে স্যার।
অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিপূর্ণ পরিবেশে দয়াময় চক্ষু হাসপাতালের শিলান্যাস হয়। একজন শান্তিকারের চোখে ছানি পড়ে গিয়েছিলো; সে ছানি কাটতে গিয়ে বেচারা অন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু যেহেতু সে পাঞ্জাবের সেনা কর্মকর্তার সম্মানে একটি মুরগী জবেহ করেছিলো আজি হতে ৪৪ বছর আগে। সুতরাং এখন মুক্তিযোদ্ধা মুখার্জীর চোখ তুলে শান্তিকারের চোখে প্রতিস্থাপন অত্যন্ত জরুরী। ঘটা করে মুক্তিযোদ্ধা মুখার্জীর চোখ তোলার অপারেশান করতে গিয়ে ডাক্তারেরা বলে, কী আশ্চর্য; উনার চোখ দুটো তো পাথর হয়ে গ্যাছে!
একটু দমে যায় বেয়াইপুরের লোকজন। একটা মানুষের অশ্রু শুকিয়ে চোখ দুটো পাথর হয়ে গেলো; অথচ আমরা তারজন্য কিছুই করতে পারলাম না! বেয়াইপুরে কী একজনও মানুষ নেই!
গোপন পাল আবার গুঞ্জন রায়কে ফোন করে। ও দাদা এখন করি কী!
গুঞ্জন একটু চিন্তা করে বলে, রটিয়ে দাও জেলখানায় বিদেশী এজেন্টরা এসে তাপস মুখার্জীর চোখ তুলে পাথর বসিয়ে দিয়ে গ্যাছে!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য