আজ বৃহস্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪

Advertise

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে

ড. শামীম আহমেদ  

গত কয়েকদিন ধরে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রস্তাবিত নতুন নাম “স্যার ফজলে হাসান আবেদ ইউনিভার্সিটি” নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরগরম। তবে বাংলাদেশে সাধারণত সরকার ও বিরোধীদল নিয়ে উত্তপ্ত বাগবিতণ্ডা হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন নিয়ে এই বিতর্ক বেশ ভিন্নধর্মী ও কৌতূহলোদ্দীপক। যারা লিখছেন বেশিরভাগই এই নাম পরিবর্তনের বিপক্ষে, খুব অল্প কিছু মানুষ নাম পরিবর্তনের পক্ষে।

আমার সাথে ব্র্যাকের সম্পর্ক দুভাবে। আমি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি থেকে এমপিএইচ করেছি। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের সেকেন্ড ব্যাচের ছাত্র ছিলাম আমি। প্রায় ৯০০ এর অধিক শিক্ষার্থীর মধ্যে বাছাই করে যে ১৩ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে নেওয়া হয়, তার মধ্যে আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ। আমাদের সাথে প্রায় আরও ১৪ জন বিদেশি শিক্ষার্থীও ছিল। এখান থেকে পাশ করবার পর আমি ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালে যোগ দিই, ৩ মাস সেখানে কাজ করার পর ব্যক্তিগত কারণে ব্র্যাক বাংলাদেশে চাকরি শুরু করি। দুবছর ব্র্যাকে কাজ করেছিলাম। এই এক বছরের পড়ালেখা এবং দুবছরের কাজের সুবাদে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা আবেদ ভাইকে চেনার, জানার ও দেখার সুযোগ হয়। এছাড়াও আমি এলামনাই এসোসিয়েশন অব ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্টও ছিলাম। এরপর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেছে, কিন্তু আমি যেখানেই গিয়েছি সবাইকে বলেছি, বাংলাদেশের স্বনামধন্য মানুষেরা নিজেদের নাম প্রকাশ ও প্রচার করতে পছন্দ করেন, একমাত্র ব্যতিক্রম আবেদ ভাই। তিনি চাইতেন তার প্রতিষ্ঠানের নাম ছড়িয়ে পড়ুক, তার নিজের নয়। আবেদ ভাইয়ের অবদান বাংলাদেশের উন্নয়নে অসামান্য। আমাকে ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞেস করলে আমি বলব বঙ্গবন্ধু এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পর বাংলাদেশের উন্নয়নে ফজলে হাসান আবেদের ভূমিকা অগ্রগণ্য।

যারা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির নাম পরিবর্তন পছন্দ করছেন না, তারা মূলত তরুণ, বেশিরভাগই হয় এখন সেখানে পড়ছেন, আগে পড়েছেন কিংবা ভবিষ্যতে পড়তে চান। এটি খুব স্বাভাবিক তরুণরা আবেগী এবং তাদের কাছে নাম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আমার জানামতে বর্তমানে বাংলাদেশে ব্র্যাক ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি শীর্ষ দুটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীরা এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনটিতে ভর্তি হবে তার ক্ষেত্রে পছন্দের নাম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ভবিষ্যতে রাখতেই পারে। আমার মনে আছে আমি আব্বার চাকরির সূত্রে দেশের নানা স্কুলে পড়েছি। অবশেষে থিতু হয়েছিলাম ক্লাস ফাইভে মিরপুর বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ে এসে। সেখান থেকেই এসএসসি দিই। আমরা যখন খুলনা থেকে ঢাকা আসব এপ্রিল মাসে, তখন আমার সরকারি চাকরিজীবী আব্বা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলেন আমরা কোথাও আদৌ ভর্তি হতে পারব কিনা। অন্যদিকে আমার বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরিরত ছোট চাচা জিয়াউদ্দিন আহমেদ তার মুক্তাক্ষরে লিখিত চিঠিতে আমাকে বলেন, “এমন একটা স্কুলে ভর্তি হলে যার নাম মিরপুর বাংলা, তোমার বন্ধুরা তো তোমাকে ক্ষ্যাপাবে।” সুতরাং নামের ব্যাপারে এই উদ্বেগ খুব একটা অমূলক নয়।

পরবর্তী জীবনে আমি নটর ডেম কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব আমস্টার্ডামে এবং বর্তমানে ক্যানাডার শীর্ষ - ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টোতে পড়ছি। বাংলাদেশে থাকতে নটর ডেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি এই বিষয়টি বেশ প্রশংসা পেত। কিন্তু দেশ ছাড়ার পর এগুলো সব অর্থহীন হয়ে গিয়েছে। শুধুমাত্র যারা শিক্ষাক্ষেত্রে জড়িত তারা বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির নাম জানলেও, শিক্ষা ক্ষেত্রের বাইরে কেউ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও শোনেনি। এখানে ভর্তি ও চাকরির ক্ষেত্রে ডিগ্রি অবশ্যই গুরুত্ব পায়, কিন্তু সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় শিক্ষার্থীর অর্জন। তাই আমি যখন দেখলাম ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টোতে - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের চাইতে ঢাকার বাইরের অনেক কম পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বা ঢাকার অনেক কম খ্যাতিসম্পন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অহরহ পড়তে আসছে, শুরুতে অবাকই হয়েছিলাম। পরে সেই অবাক হওয়া কেটে গেছে। বুঝেছি শিক্ষার্থীর অর্জিত শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার মান এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নয়। তাই ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির নাম পরিবর্তন করলে বাইরে পড়তে আসার ক্ষেত্রে কোন ভূমিকাই রাখবে না, শিক্ষার্থীর নিজের অস্বস্তি ছাড়া।

আমি ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজনের সাথে কথা বলে জেনেছি তাদের অস্বস্তি “আবেদ ইউনিভার্সিটি” এই নামটি নিয়ে। তারা মনে করছে আবেদ নামটি যথেষ্ট “স্মার্ট” নয়; এই নামের ইউনিভার্সিটিতে পড়লে তাদের নর্থ সাউথের বন্ধুরা তাদের ক্ষেপাবে, আত্মীয়-স্বজনদের কাছে মুখ দেখানো যাবে না। আমি তখন তাদের জিজ্ঞেস করেছি কী নাম রাখলে সেটি স্মার্ট হতে পারে? আমার প্রশ্ন শুনে তারা প্রথমে একটু ভড়কে যায় এবং পরবর্তীতে দেখা গেল কোন বাংলাদেশির নামই আসলে ইউনিভার্সিটির নাম রাখার জন্য যথেষ্ট স্মার্ট নয়। শামীম ইউনিভার্সিটি, জামান ইউনিভার্সিটি, লতিফ ইউনিভার্সিটি, আবুল ইউনিভার্সিটি, শাকিব ইউনিভার্সিটি, আরিফ ইউনিভার্সিটি, আমেনা ইউনিভার্সিটি, রাজিয়া ইউনিভার্সিটি, কেয়া ইউনিভার্সিটি – কোন বাংলাদেশি নামই ইউনিভার্সিটির জন্য বাংলাদেশিদের কাছে উপযুক্ত নয়। ওদিকে বাংলাদেশিদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকা হার্ভার্ড, স্ট্যান্ডফোর্ড, কলাম্বিয়া, প্রিন্সটন, ইয়েল, কর্নেল, ব্রাউন, ডিউক, জন হপকিন্স, ম্যাকগিল ইত্যাদি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের নামই কোন না কোন ব্যক্তির নামে রাখা হয়েছে।

নাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যারা আপত্তি করছেন, তারা বলছেন উপরোক্ত বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনটারই প্রতিষ্ঠার ২২ বছর পর নাম পরিবর্তন করা হয়নি। প্রতিষ্ঠার ২২ বছর পর নাম পরিবর্তন করা যাবে না, এই যুক্তি যদিও আমার কাছে যথেষ্ট শক্তিশালী মনে হয়নি। যারা নাম পরিবর্তন করবেন, তাদের প্রধান যুক্তি আবেদ ভাইর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। কেউ কেউ বলছেন তিনি বেঁচে থাকতেই এই প্রস্তাবে সমর্থন দিয়ে গিয়েছিলেন। আমার কাছে মনে হয় বাংলাদেশে যেসব রাজনৈতিক নাম পরিবর্তন হয়, তার অধিকাংশই শক্তি ও ক্ষমতার দাপট দেখানোর জন্য।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি নাম পরিবর্তন করলে আমি নিশ্চিত প্রাথমিকভাবে তারা বেশ কয়েক বছর ধরে অনেক মেধাবী ছাত্র হারাবে, তাই এখানে তাদের স্বার্থসিদ্ধির তেমন কোন সম্ভাবনা আমি দেখছি না। আপাতত দৃষ্টিতে এটি আবেদ ভাইর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বলেই আমার মনে হচ্ছে।

“আবেদ ইউনিভার্সিটি” শ্রুতিমধুর না হলেও “স্যার ফজলে হাসান আবেদ ইউনিভার্সিটি” নামটা অত মন্দ নয়। আর আমি নিশ্চিত কাগজে কলমে নাম যাই হোক না কেন, মানুষ এটিকে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি নামেই চিনবে, জানবে এর পেছনে আবেদ ভাইর মতো একজন মহতী মানুষ ছিলেন।

এই নাম পরিবর্তনের পক্ষে-বিপক্ষে মত থাকবেই, এর কোনটিই অকাট্য যুক্তি নয়। আমার প্রস্তাব যদি করতেই হয় তবে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির নাম পরিবর্তন করে “স্যার ফজলে হাসান আবেদ ইউনিভার্সিটি” করা হোক। সাথে এমন একটি ধারা সংযুক্ত করে দেওয়া হোক যে সংক্ষেপে “স্যার ফজলে হাসান আবেদ ইউনিভার্সিটি”কে “ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি” বলা হবে; “আবেদ ইউনিভার্সিটি” নয়।

সবদিক বিবেচনায় আমার মনে হয় এটিই হবে সবচেয়ে সুন্দর সমাধান; বিতর্কিত না করে আবেদ ভাইকে শ্রদ্ধা জানানোর শ্রেষ্ঠ উপায়।

ড. শামীম আহমেদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সামাজিক-বিজ্ঞান গবেষক।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০৪ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৮ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ