প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ফরিদ আহমেদ | ১৯ আগস্ট, ২০২৩
১৯৭১ সালে জামায়াত যারা করেছে, তারা সকলেই রাজাকার ছিলো। ওই সময় জামায়াত করারা সবাই বাই ডিফল্টই রাজাকার। এর কোনো ব্যত্যয় নেই। এর মূল কারণ হচ্ছে জামায়াত দলীয়ভাবেই আমাদের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলো। পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে আমাদের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছে। এই বিরোধিতা শুধু আদর্শিক বিরোধিতা ছিলো না, জামায়াত অস্ত্র হাতে তাদের কর্মীদের নামিয়ে দিয়েছিলো বাংলাদেশের বাঙালিদের বিরুদ্ধে। তারা রাজাকার নামে একটা মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করেছিলো পাকিস্তান আর্মিকে সক্রিয় সহায়তা করার জন্য। শুধু রাজাকার না, আল-বদর এবং আল-শামসের মতো ঘাতক বাহিনীর জন্মও তারা দিয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে যে জামায়াতের হাই-কম্যান্ড হয়তো এমন কাজ করেছে, এর কারণে জামায়াতের সবাইকে কেন রাজাকার বলতে হবে? জামায়াতের সবাইকে রাজাকার বলতে হবে এই দলটার গঠন প্রক্রিয়া অনুযায়ী। এটা একটা ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন। এখানে যে কেউ ইচ্ছে করলেই দলে ঢুকতে পারে না, বা দল থেকে বের হতে পারে না। দলের আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ধীরে ধীরে একজন ব্যক্তির এই দলে প্রমোশন হতে থাকে। দলের প্রতিটা কর্মীর কর্মকাণ্ডকে মনিটর করা হয়। এই রকম একটি আদর্শভিত্তিক এবং ক্যাডারভিত্তিক সংগঠনে কোনো ব্যক্তির পক্ষে দলের নির্দেশের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। নির্দেশের বাইরে আসলে কেউ যায়ও না।
এখানে এমনভাবে মস্তিষ্ক ধোলাই করা হয় যে একজন জামায়াতের কর্মীর দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে চিন্তা করার মতো সামর্থ্য থাকে না। দল যেটা বলে, সেটাকেই তারা কোরান বাক্য হিসাবে বিশ্বাস করে নেয়। যে কারণে একাত্তরে পাকিস্তান আর্মি যখন হত্যা, ধর্ষণে লিপ্ত জামায়াতের একজন সদস্যকেও খুঁজে পাওয়া যায় না, যার বিবেক জাগ্রত হয়েছে, যে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে কিংবা নিষ্ক্রিয় অবস্থান নিয়েছে। এদের প্রতিটা সদস্য একাত্তরে সক্রিয় ছিলো। সেই সক্রিয়তা পাকিস্তানের পক্ষে আর বাংলাদেশের বিপক্ষে। ফলে, একাত্তরে জামায়াত এবং শিবিরের পূর্বসূরি ইসলামি ছাত্র সংঘের প্রতিটা সদস্যকে রাজাকার হিসাবে নিশ্চিন্তে অভিহিত করা যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়াতে এরা তাদের রাজাকার পরিচয়কে গোপন করে, বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে একেকজন রাজাকার হিসাবে পাকিস্তানের বীরত্ব পদক নিতো।
আমি আমার আগের লেখাতে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকেও বাই ডিফল্ট রাজাকার বলেছিলাম। জামায়াতের লোকদের একটা যুক্তি হচ্ছে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী একাত্তরে জামায়াত করতেন না। তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীও এক জন সভাতে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন যে তিনি তিয়াত্তরের আগে কখনো জামায়াত করেননি। তিয়াত্তরের আগে জামায়াত না করলে তাঁকে আসলে বাই ডিফল্ট রাজাকার বলা যায় না। হয়তো রাজাকার ছিলেন, তবে জামায়াত করলে যে বাই ডিফল্ট রাজাকার হয়, সেটা তিনি নন।
দেখা যাক, একাত্তরে তিনি কী করতেন। তিনি যেহেতু পিরোজপুরের মতো শহরে তখন খুব সাধারণ একটা জীবন যাপন করতেন, সেহেতু জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তাঁর নাম পাওয়া যায় না। স্থানীয় জামায়াতের সাথে হয়তো তিনি জড়িত ছিলেন। এর পিছনের শক্ত একটা কারণ আল্লামা সাঈদীর নিজের বক্তব্যই।
তিনি তাঁর আরেক ভাষণে বলেছেন ১৯৭৩ সালে তিনি জামায়াতের রুকন হয়েছিলেন। আগেই বলেছি যে জামায়াত একটা ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন। এখানে সদস্যদের ধাপে ধাপে নিজেকে প্রমাণ করে উপরের দিকে যেতে হয়।
জামায়াতের সাংগঠনিক জনশক্তির স্তরবিন্যাসের তিনটি ধাপ রয়েছে;
১. সহযোগী সদস্য
২. কর্মী
৩. সদস্য (রুকন)
এই তিনটা ধাপের কারা যেতে পারবে সেটা দেখি আমরা।
সহযোগী সদস্য: জামায়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে একমত হয়ে তিন দফা দাওয়াত মানসিকভাবে গ্রহণ করলে এবং চার দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নে আগ্রহ প্রকাশ করলে যে কোনো ব্যক্তি জামায়াতের সহযোগী সদস্য হতে পারবেন।
কর্মী: জামায়াতের সহযোগী সদস্যদের মধ্য থেকে যারা নিয়মিতভাবে বৈঠকে যোগদান করেন এবং দাওয়াতি কাজ করেন, ইয়ানত দেন, রিপোর্ট রাখেন ও বৈঠকে পেশ করেন এবং দাওয়াতি কাজ করেন ও সামাজিক কাজ করেন তাঁদেরকে জামায়াতের কর্মী বলা হয়।
সদস্য (রুকন): জামায়াতের গঠনতন্ত্রে বর্ণিত শর্তাবলী ও নিয়ম মেনে যে কোনো কর্মী জামায়াতের সদস্য (রুকন) হতে পারেন। জামায়াতের মূল জনশক্তি হচ্ছে সদস্য (রুকন)। সদস্যদের (রুকনদের) দ্বারা নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়। নীতি নির্ধারণ, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, কাজের অগ্রগতির তদারকও হয় এঁদের দ্বারাই। মোটকথা জামায়াতকে সঠিকভাবে এগিয়ে নেয়া সদস্যগণেই দায়িত্ব।
জামায়াতের সংগঠন পদ্ধতি থেকে এটা পরিষ্কার যে তাদের জনশক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে সদস্য বা রুকন। জামায়াত আওয়ামী লীগ বা বিএনপি না যে আজকে কেউ দলে যোগ দিতে চাইলেই তাকে দলের সদস্য করে নেবে। জামায়াতের একজন সদস্য বা রুকন দীর্ঘ পথ পরিক্রমা পাড়ি দিয়ে আসে। তাকে সহযোগী সদস্য হতে হয়, সেখান থেকে নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে সম্পাদনের পরে কর্মীতে উত্তরণ ঘটে, তারপরে এই পর্যায়ে নিজেকে প্রমাণের মাধ্যমে একজন কর্মী সদস্য বা রুকন হয়। সহযোগী সদস্য থেকে এই পর্যায়ে আসতে বেশ কয়েক বছর লেগে যায়। তাঁদের সংগঠন পদ্ধতিতেই লেখা আছে, “সহযোগী সদস্য ফরম পূরণ করে একজন লোক জামায়াতের সীমানায় আসে মাত্র। চিন্তায় ও চেতনায় জামায়াতের লক্ষ্যকেই নিজ জীবনের লক্ষ্য মনে করা, কর্মনীতি ও কর্মসূচি মুতাবিক সমস্ত কাজ করা, সঠিকভাবে জামায়াতের গঠনতন্ত্র ও নীতিমালা মেনে চলা, আচার-ব্যবহার লেন-দেনে সতর্ক মুসলিমের পরিচয় দেয়া ইত্যাদি গুণাবলি একজন কর্মীর ভেতর বাস্তবভাবে দেখা না গেলে তাকে সদস্য (রুকন) করা হয় না।
জামায়াতের সংগঠন পদ্ধতি অনুযায়ীই আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৭৩ সালে হুট করে জামায়াতের রুকন হয়ে যেতে পারেন না। রুকন হবার আগে নিশ্চিতভাবেই তিনি সহযোগী সদস্য এবং কর্মী হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। অথচ, তিনি সেই সময়টাকে অস্বীকার করছেন। কেন? এর কারণ ওই ১৯৭১ সাল। তিনি যে একাত্তরেও জামায়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন সেটাকে লুকোতে চেয়েছেন তিনি।
আল্লামা সাঈদী এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন যে ১৯৬২ সালে তিনি শর্ষিনা মাদ্রাসাতে ছাত্র থাকা অবস্থাতেই জামায়াতের রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। জামায়াতের রাজনীতি প্রতি আকৃষ্ট হবার পরেও জামায়াত না করা এবং দশ এগারো বছর পরে গিয়ে হুট করে জামায়াতের রুকন হয়ে যাওয়াটা ঠিক খাপে খাপে মেলে না। একটা ফাঁক থেকেই যায়।
সেই ফাঁকটাকে আমরা অনায়াসে পূরণ করতে এটা দিয়ে যে আল্লামা সাঈদী স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই জামায়াতে সক্রিয় ছিলেন। বাই ডিফল্টই তিনি একজন রাজাকার। একাত্তরের ওই কুখ্যাত দেইল্লা রাজাকারটাই তিনি।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য