Advertise
এখলাসুর রহমান | ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
ভারতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতের আমন্ত্রিত পর্যবেক্ষক হিসাবে অংশ গ্রহণ করলেন। বাংলাদেশ জি-২০ অন্তর্ভুক্ত সদস্য দেশ নয়। ভারত সরকারের আমন্ত্রণে পর্যবেক্ষক হিসাবে অংশগ্রহণ ছিল এটি। একটি সেলফি ও একটি ছবি নিয়ে বাংলাদেশে তোলপাড় হওয়ায় তা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সংবাদ হলো। ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর সমাধিতে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে হাঁটু গেড়ে দাঁড়ানো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের ছবি নিয়েও তোলপাড়। সেটাও ব্রিটিশ গণমাধ্যমে খবর হয়ে এসেছে। এই ছবি দেখিয়ে এক শ্রেণির অতি উৎসাহী সোশ্যাল মিডিয়ায় হাঁটু গেড়ে বসাকে আমাদের জন্য গৌরবের বলে প্রচার করেছে। আর ব্রিটিশ জনগণ এই ছবি দেখে তাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছে। জো বাইডেনের সাথে সেলফি নিয়েও এদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গদগদ শারীরিক ভাষা অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছে পৃথিবীর মানুষ। অথচ এই সেলফির খবর ও শেখ হাসিনার সাথে আলোচনার খবর মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানে না। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সকল বৈঠকের খবর স্টেট ডিপার্টমেন্টে প্রেরিত হয়। জি-২০ সম্মেলনে শেখ হাসিনার সাথে সাইড লাইনে আলোচনার কোন তথ্যও নেই। সুতরাং জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের যে কোন প্রাপ্তি নেই এটা বলা যায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গদগদ শারীরিক ভাষা বলে দিলো যে জো বাইডেনের সাথে সেলফি তুলে আমরা যেন ধন্য হয়ে গেছি। এতে করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের মানসিক দৈন্যই ফুটে উঠেছে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বিনয় দেখিয়েছেন। মহাত্মা গান্ধীর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের পরে খালি পায়ে হাঁটু গেড়ে বসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছেন। এতে তিনি বিনয় প্রদর্শন করে বড়ই হয়েছেন, ছোট হননি। কিন্তু বাংলাদেশের এক শ্রেণির লোক ছবিটা এমন ভাবে প্রচার করেছে যে এতে করে আমরা যেন বড় হয়ে গেছি। এসব ছেলেমানুষি সুলভ বড়ত্ব ভাবা নয় কি? লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা ডেইলি মেইলে এই ছবির বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এটাতেও কি আমাদের মানসিক দৈন্যই ফুটে ওঠেনি? বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর স্তুতি ছাড়া কোন কাজটা করেছেন? নির্বাচন, ড. ইউনূস, বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন, বিশ্ব নেতাদের চিঠি সব মিলিয়ে বাংলাদেশে একটি টালমাটাল অবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে কী পেলো বাংলাদেশ? তার উপস্থিতিতেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শারীরিক ভাষা গদগদ। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করতে পাশে থাকবেন বললেন। আর এর প্রতিক্রিয়ায় কী বলল মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট?
তারা বলল, যে দেশ অন্য একটি দেশে হামলা চালায় স্থাপনা ধ্বংস করে নারী শিশুসহ নিরপরাধ মানুষ হত্যা করে তাদের পক্ষে বিদেশী হস্তক্ষেপের কথা শোভা পায় না। রাশিয়া সফর করে গেছে আমাদেরকে তার শত্রুর শত্রু বানাতে। অথচ তার আগমনকে ঘিরেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শারীরিক ভাষা ছিল গদগদ। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো আসল। ১০টি এয়ার বাস কেনার চুক্তি করে গেল। ফ্রান্সে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ব্যঙ্গ কার্টুনকারীর পক্ষ নেয়ায় মুসলিম জনগোষ্ঠী তার প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। ম্যাক্রোর আগমনে তারাও অসন্তুষ্ট। ক্ষমতার শেষ প্রান্তে ম্যাক্রোর আগমনে তেমন কোন লাভ হয়েছে কি? এখন এমন কথাও শোনা যাচ্ছে বেশি দামে এয়ার বাস কেনা হচ্ছে। আমেরিকা নাকি তার চেয়েও কম দামে এয়ার বাস বিক্রি করে থাকে। যদি এ কথা সত্য হয় আমেরিকা কি অসন্তুষ্ট হবে না আরও? বাংলাদেশ আশা করে ভারত আমেরিকার সাথে সম্পর্ক ভালো করে দেবে। কিন্তু ভিয়েতনামে গিয়ে জো বাইডেন সংবাদ সম্মেলনে ভারতের মানবাধিকার নিয়েই প্রশ্ন তুললো। ভারত জি-২০ সম্মেলনের পরে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করতে দেয়নি।
সরকার দেশী-বিদেশী চতুর্মুখী চাপে বিধ্বস্ত। এখন অস্ট্রেলীয় পার্লামেন্টেও বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উঠেছে। এর আগে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে উঠেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে বাংলাদেশে মানবাধিকার, দমনপীড়নের অস্বচ্ছ নির্বাচন বিচারিক হয়রানি নিয়ে কথা উঠছে। তার সত্যতা প্রমাণেও সহায়ক হচ্ছে খোদ বিচারপতিরাই। একজনতো নিজেই নিজেকে শপথবদ্ধ রাজনীতিক হিসাবে দাবী করলেন। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের উপর প্রায় দুই শতাধিক মামলা নিয়ে দেশে বিদেশে তোলপাড়। বিশ্বব্যাপী তার বিচারিক হয়রানি বন্ধের দাবী উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের দুইজনকে শেষ মুহূর্তে কারাদণ্ড দেয়া হল কেন? কেন আগে হলো না ও পরে হলো না? ২০১৩ সালের মামলা। আর এই রায়টি বাস্তবায়নে এই সময়টাকেই কেন বেছে নেয়া হলো? এগুলো কি আত্মঘাতী নয়?
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মত অন্যান্য মন্ত্রণালয়গুলোও ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙার ক্ষেত্রে অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন। ব্যর্থ বিমানমন্ত্রী। লকার ভেঙে চুরি হয়ে গেছে সোনা। আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কে সফল? সফলতার ধার না ধেরে সবাই কি কেবলই প্রধানমন্ত্রীর স্তুতিতে ব্যস্ত নয়? সরকারকে দেশে বিদেশে লাগাতার বিব্রত করেই চলছে এসব স্তুতিকাররা। ডিসি নৌকা মার্কায় ভোট চায়। ওসি নৌকা মার্কায় ভোট চায়। সচিব এলাকায় গিয়ে নৌকা প্রত্যাশী হিসেবে গণসংযোগ করে। কে আমলা কে নেতা চেনাই দায় হয়ে উঠছে। সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের এমন প্রকাশ্য রাজনৈতিক ভূমিকায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে এই প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন সম্পন্ন করার বিষয়টি। বিরোধী পক্ষ তা ফলাও করে প্রচার করছে যে প্রশাসন প্রকাশ্য নৌকা মার্কায় ভোট চায় তাদের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না। এমনই হযবরল পরিবেশে দুজন মানবাধিকার কর্মীকে কারাদণ্ড দেয়া হল। আর এই রায় ঘোষণার পরপরই ৭২টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবাদী বিবৃতি এলো। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুললো।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানালো। কোন বার্তা দিতে ডাকলেন তিনি। ইউনূসের বিচারিক হয়রানির অভিযোগের পর এটিও প্লাস হলো। আন্তর্জাতিক মহল বলছে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হবে। বিএনপি, গণতান্ত্রিক মঞ্চসহ ক্রিয়াশীল অন্যান্য বিরোধী দল নির্বাচনে না এলে কি তা গ্রহণযোগ্য হবে? এদিকে বিএনপি বলছে এ সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তাদের এই দাবীর পক্ষে যুক্তি এনে দিলো কতিপয় ডিসি, ওসি নৌকায় ভোট চেয়ে। এই ভোট চাওয়ায় সরকারের কোন লাভ হয়নি। চরম ক্ষতি হয়েছে। চাকরি বিধির শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সরকারকে বিব্রত করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ইচ্ছে, সাহস কোনটাই নেই সরকারের। কেন এই আমলা নতজানুতা? দেশের অর্থনৈতিক চরম দৈন্যেও ডিসি, ইউএনওদের বিলাসী গাড়ি প্রদান করলো। তবে কি নতুন গাড়ির ফ্রুটিকা খেয়েই জামালপুরের ডিসি নৌকায় ভোট চাইলো?
সব মিলিয়ে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে এক অনিশ্চয়তা। কী ঘটতে চলেছে? অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচন সম্পন্ন করতে চাইলে এই সরকারের অধীনে কি তা সম্ভব? সম্ভব না হলে কি কেয়ারটেকার সরকার হবে, না নির্বাচনকালীন সরকার হবে। ২০০৮ সালে ছিল কেয়ারটেকার সরকার। আর সে নির্বাচনটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। ২০১৪ সালে ছিল নির্বাচনকালীন সরকার। সেটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে রয়েছে অনেক প্রশ্ন। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচন তখন আবার নির্বাচনকালীন সরকার ছিল না আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই তা হয়েছিল। নির্বাচনটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে রয়েছে অনেক প্রশ্ন। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপরীতে নির্বাচনকালীন সরকারকেও একটা সিস্টেম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলো না। একবার নির্বাচনকালীন একবার নিজ দলীয়। এটাও কি এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা নয়? তবে এবার কী হতে যাচ্ছে? বর্তমান সরকার না কেয়ারটেকার সরকার না নির্বাচনকালীন সরকার। সবার কৌতূহল অক্টোবর মাসের দিকে। কী হয় সময় বলবে। কী ঘটে কী ঘটতে চলেছে এই নিয়েই সর্বত্র আলোচনা।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য