আজ সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪

Advertise

প্রধানমন্ত্রী কি পারবেন বিবিধ চাপ সামলাতে?

এখলাসুর রহমান  

ক্ষমতার প্রতি একশ্রেণির স্তুতিকার স্তুতি আসক্তিতে যেন সবসময় মুখিয়ে থাকে। তারা মুখিয়ে থাকে ক্ষমতাধরকে অভিনন্দনের ফুলের তোড়া দিতে। মুখিয়ে থাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দিয়ে ও লাইক কমেন্ট করে ক্ষমতাধরের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টায়। আরও উদ্দেশ্য থাকে অন্যদের বুঝানো যে এই ক্ষমতাধর আমার নিকটজন। কে নেতা, কে আমলা, কে চাকরিজীবী বুঝাই দায় হয়ে উঠেছে এখন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ালেই দেখা মিলে তাদের। লাইক কমেন্টের বন্যায় ক্ষমতাধরের কমেন্ট বক্স উপচে ওঠে।

বড় আশা করে মানুষ ২০০৮ সালে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় শক্তি হিসাবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলো। দলটির প্রধান শরিকের নেতারা এমন স্তুতিলিপ্সু, ক্ষমতান্ধ ও আমলা তোষণকারী হয়ে উঠবে তা কেউ ভাবেনি। আদর্শিক পথেও অটল থাকতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর কথা বলা মানে যে কেবল বঙ্গবন্ধুর বাক্যস্তুতি নয় তার আদর্শের বাস্তবায়ন এটা বুঝতে চায়না কেউ। মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলেছে আবার তার সাথে বিভিন্ন সময় আপোষও করেছে। একের ঘরে না থাকলে যা হয় তাই ঘটতে চলছে। সামনের নির্বাচনটা তাই দিনে দিনে কঠিন হয়ে উঠছে।

দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ বাজারে যেতে ভয় পায়। বাণিজ্যমন্ত্রীর বাজারে কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। খাদ্যমন্ত্রীর খাদ্য দ্রব্যে নিয়ন্ত্রণ নেই। সড়কমন্ত্রীর নেই সড়কে নিয়ন্ত্রণ। শিক্ষামন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী সর্বত্রই নিয়ন্ত্রণহীনতার দৃশ্য। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে চিকিৎসক হয়ে যাবার খবরও বেরিয়েছে। স্বাস্থ্যখাত ধ্বংস। অথচ মন্ত্রীরা সামান্য অসুখ হলেই লজ্জার মাথা খেয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশ চলে যায়। এক্ষেত্রে বিরোধী দলীয় নেতারাও পিছিয়ে নেই। তারাও দেশীয় স্বাস্থ্য খাতের দৈন্যদশা নিয়ে কোন কর্মসূচি দিচ্ছে না। নিজেরা চিকিৎসা নিতে বিদেশ চলে যাচ্ছে। সবাই বেপরোয়া হয়ে উঠছে ক্ষমতায় থাকার জন্য ও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় যে জনদুর্ভোগ ও জনভোগান্তি এদিকে কারো নজর নেই। দেশের সরকারি প্রশাসনের কিছু ব্যক্তির সাম্প্রতিক দলীয় বক্তব্যে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। দেশে বিদেশে প্রশাসনের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হওয়াটাকে আরও এগিয়ে দিয়েছে। ফুটে উঠেছে আমলা নির্ভরতা ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নির্ভরতা। কোন দিক সামলাবে সরকার দ্রব্য মূল্য, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ, বিদেশে অর্থ পাচার, প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজনের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের অভিযোগ? সবমিলিয়ে বহুবিধ সমস্যা জটে পড়েছে সরকার।

সরকার পরিচালনায় মন্ত্রী পরিষদগত সিদ্ধান্ত না নিয়ে সবক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রী নির্ভরতায় সমস্যা জট বেড়েছে। একক কর্তৃত্ববলয়ের অভিযোগ উঠেছে। ২০০৪ সাল হতে ওয়ান ইলেভেনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় ছিল ১৪ দলের লিয়াজোঁ কমিটি। ২০০৮ এর পর হতে তা হারিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক সিদ্ধান্তই মুখ্য হয়ে ওঠে সকল ক্ষেত্রে। অথচ অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ নিয়ে ১৪ দল গড়ে উঠেছিল রাজপথে কিছু আদর্শিক দফার ভিত্তিতে। কিন্তু ক্ষমতাগ্রহণের পর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ১৪ দলের সেই আদর্শিকতার ভূমিকা চলে যায় শূন্যের কোঠায়। ২০০৯ সালে সারাদেশের মানুষ প্রত্যাশা করেছিল মন্ত্রিসভায় যাবে রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু। বিভিন্ন সংবাদপত্রেও তাদের নামই আসছিল। কিন্তু সকল আলোচনা ও সংবাদকে ছাপিয়ে তখন মন্ত্রী হয়ে গেলেন দীলিপ বড়ুয়া। যা তিনি নিজেও প্রত্যাশা করেননি। তিনি কোন সংসদ সদস্যও নন। তার দল সাম্যবাদী দল ২০০৮ এর নির্বাচনে জোটগত ভাবে একটি আসনও পায়নি। এক কথায় প্রধানমন্ত্রী যে কাউকে মন্ত্রী বানিয়ে দিতে পারেন তার কোন সংসদ সদস্য হওয়ারও কোন দরকার নেই। তার ইচ্ছাই মুখ্য। তাই সকলে ব্যস্ত হয়ে উঠে কেবল তারই স্তুতিতে। কারণ সবাই এটিই ভাবছে যে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলেই হল। পোষ্টার ব্যানার ছেয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন, প্রধানমন্ত্রীর স্নেহধন্য ইত্যাদি বাক্যে। দলীয় আস্থাভাজন, দলীয় ত্যাগ তিতিক্ষা এসব কেউ লিখে না। চলছে কে কত প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন তারই প্রতিযোগিতা।

প্রতিটি মন্ত্রণালয় যদি কেবল প্রধানমন্ত্রীর স্তুতি না করে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করতো তাহলে নিশ্চয়ই ওই রকম বৈরী পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। বিরোধী দলে থাকাকালীন সময়ে সক্রিয় ১৪ দলের লিয়াজোঁ কমিটির মত যদি সরকারে থাকাকালীন সময়েও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হতো তাহলেও নিশ্চয়ই এমন বৈরী পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। ১৪ দল অনেক দিন আড়ালে ছিল। যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সুষ্ঠু নির্বাচন ও বিশ্বনেতারা ড. ইউনুস ইস্যুতে সরকারকে চাপ দিতে থাকল তখন আবার ১৪ দলকে সক্রিয় করা হল। রাজপথে ১৪ দল স্লোগান দিল: রুখো আমেরিকা রুখো বিএনপি-জামায়াত। এরপর কী দেখলো মানুষ। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সাথে সেলফি তুলেই আওয়ামী লীগ নেতারা গদগদ হয়ে গেল। পররাষ্ট্র মন্ত্রী বারবার বলতে লাগলেন আমেরিকার সাথে আমাদের মধুর সম্পর্ক। সুতরাং এই ক্ষেত্রে ১৪ দলের ব্যানারে রুখো আমেরিকা বলার মাজেজাটা কী তাহলে? অথচ একবার আমেরিকার বিরুদ্ধে কথা বলা হল। জো বাইডেনের সাথে সেলফি তোলার পরে উল্টে গেল। বলা হল মধুর সম্পর্ক। এখন আবার ভিসা নিষেধাজ্ঞার পরে আমেরিকার বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে।

বারবার এমন অবস্থান পাল্টানো কি চরম মানসিক দেউলিয়াত্বের পরিচয় নয়? আদর্শিক দৃঢ়তা ও গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী না চললে যা হয় তাই হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী আমেরিকা থাকাকালীন সময়েই মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা এলো। কারা কারা এই ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়েছে এই নিয়ে দেশ জুড়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা। সরকার সংশ্লিষ্টরা মুখে যতই বলুক ভিসা নিষেধাজ্ঞাকে পরোয়া করে না, ভেতরে ভেতরে ঠিকই টেনশন চলছে। এখন আরও ভাবিয়ে তুলছে প্রধানমন্ত্রীর এই কথা বলা যে, জয় আমেরিকা থাকে সম্পদ বাজেয়াপ্ত করলে করুক, আমাদের বাংলাদেশ আছে। বাস্তবতা ভাবিয়ে তুলছে সর্বত্র। অনেককেই আমেরিকা যেতে হয়। কারও আমেরিকা বাড়ি আছে কারও সন্তান লেখাপড়া করে। ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্তজনের সন্তানরাও পড়বে বলা হচ্ছে। তবে এ ভিসা নিষেধাজ্ঞায় সাধারণ মানুষের কিছু আসে যায় না। কারণ তাদের আমেরিকায় কিছু নেই তাদের কেউ থাকেও না।

সামনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী কি পারবেন সব চাপ উপেক্ষা করে নির্বাচনটি সম্পন্ন করতে? ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই তাই তারা পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক পাঠিয়ে তারাও যদি পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় কী হবে তখন। এই সরকারের অধীনে বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, সিপিবি, গণঅধিকার পরিষদসহ বেশ কিছু দল নির্বাচনে অংশ নেবে না বলছে। তারা যদি এই সিদ্ধান্তে অনড় থাকে নির্বাচন কি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হবে?

এ নিয়ে কি দেশে এক সংঘাতময় পরিস্থিতি অত্যাসন্ন নয়? এক কথায় আগামী নির্বাচনকে ঘিরে এক চরম সংকটে পড়েছে দেশ। কী আছে দেশ ও জনগণের ভাগ্যে সেটা জানার অপেক্ষার প্রহর খুব দীর্ঘ নয় অতি নিকটেই। সামান্য ক'টা দিনের অপেক্ষাতেই তা স্পষ্ট হবে।

এখলাসুর রহমান, লেখক ও কলামিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০৩ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৭ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ