প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আজম খান | ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫
শিক্ষা কখনো পণ্য হতে পারে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বর্তমানে তা হয়ে গেছে। আমার মনে আছে, ২০০২-০৩ সালে আমি এবং আমার বন্ধু সুমিত ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন টেস্ট দেই কম্পিউটার সাইন্সে ভর্তি হতে। তখন মোটমাট খরচ ছিলো ২ লক্ষ ৯৮ হাজার টাকা। এই টাকাতে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়ে যাবার কথা ছিল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সুবাদে আমাকে সেখানে পড়তে হয়নি কিন্তু বন্ধু সুমিত আমাকে জানিয়েছিলো এরপর যে হারে সেমিস্টার ফি বাড়ানো হয় তাতে তার খরচ আরো লাখের উপরে বেড়ে গিয়েছিলো। আমি সঠিক জানি না এখন এর খরচ কতটুকু। তবে যতটুকু শুনেছি তাতে জেনেছি খরচ দুই তিন গুণ হয়ে গেছে।
একই অবস্থা অনান্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। মুদ্রাস্ফীতি কি এতটা বেড়ে গেছে, নাকি এর পেছনে অন্য গল্প আছে। সে আলোচনায় আসবো এখন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিটের সংখ্যা নিতান্ত অপ্রতুল। যে পরিমাণ সিট আছে তার অন্তত দশ থেকে পনেরো গুণ বা তারও বেশি ছাত্র ছাত্রী প্রতি বছর এইচএসসি পরীক্ষা পাশ করে বের হয়।
আমাদের রাষ্ট্র কি বিগত ৩০ বছরে তা লক্ষ্য করেনি? অবশ্যই করেছে কিন্তু কোন সরকারের এ সমস্যা সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি কোন পরিকল্পনা দেখা যায়নি। হাতে গোনা কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। এর মধ্যে আবার কয়েকটি কলেজ যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্তরা কোন প্রশ্ন উঠলেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার অধীনস্ত কলেজগুলো দেখিয়ে দেয়। কিন্তু সেখানে এত অনিয়ম আর দুর্নীতি, উদাসীনতা যে চার বছরের অনার্স শেষ করতে ৭-৮ বছর লেগে যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে নাকি সেশন জট খানিকটা কমেছে। সত্য মিথ্যা জানি না। খুব স্বাভাবিকভাবে, একটু সচেতন শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবক সে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নিচ্ছেন। তাদের এই ছাড়া কোন অপশনও থাকছে না। ফলাফল, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় একটা মনোপলি ব্যবসার কেন্দ্রস্থল হয়ে গেছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রাইভেটের শিক্ষার্থীরাও নির্বিবাদে এসব সয়ে গেছেন। হয়তো সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা যতটা সোজা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা ততটাই কঠিন। এখানেও রাষ্ট্রের দায় বেশি। সে যেহেতু সকলকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে পারছে না তাই সে সুযোগে কেউ যাতে শিক্ষাকে পণ্য করে কড়া মুনাফার ক্ষেত্র বানিয়ে না ফেলতে পারে তার দেখভালের দায়িত্ব তার ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে ইউজিসি সহ সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা চোখে পড়ার মত।
আমি মনে করি, নাগরিক এবং দেশের ভবিষ্যত এসব তরুণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষার দায় এড়ানোর সুযোগ রাষ্ট্রের নেই। যেহেতু রাতারাতি শ’ খানেক বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী করার সামর্থ্য আমাদের এই গরীব রাষ্ট্রের নেই, তাই এর দায় তাকে চুকাতে হবে। বরং এর চাপ অভিভাবক কিংবা শিক্ষার্থীদের উপরে দেয়া যাবে না। অমুক দেশ কি করেছে, তমুক দেশ কি করেছে সে উদাহরণ এখানে গ্রহণযোগ্য নয়।
কল্যাণমুলক রাষ্ট্রের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে চিকিৎসা, শিক্ষার মত ব্যাপার নাগরিকদের জন্য নিজে থেকে নিশ্চিত করা। ভ্যাটের আন্দোলন আমি মন থেকে সমর্থন করি না। বরং মনে করি এই আন্দোলন কোন সমাধান নয়। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা লোন দিতে হবে বিনা সুদে অথবা স্বল্প সুদে। দাবি করলে বরং এটাই করা উচিত। নচেৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফি বাড়ালে তারা কি করতে পেরেছে বা পারবে? সে তো প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
এখন অজুহাত আসতে পারে, তারা যদি পাশ করে লোন শোধ না করে? তার জবাবে অট্টহাসি দিয়ে বলা যায়, অমুক বাবা, তমুক বাবারা ঋণখেলাপি হয়ে এই দেশের যত টাকা মেরে খেয়েছে তাতে বাংলাদেশের দুই চার বছরের বাজেট হয়ে যাবে। রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে যায়নি। বরং কখনো শুনি নাই মধ্যবিত্ত কিংবা দরিদ্র কেউ লোন না শোধ করে পার পেয়েছে। আমি শতভাগ নিশ্চিত ৯০ ভাগ ছেলেমেয়ে দেশের টান আর দায়িত্ববোধ থেকে এ টাকা পরিশোধ করবে।
আমি অবশ্যই তাদের এই অংশ থেকে আলাদা করবো যারা "জয় বাংলা, ভ্যাট সামলা" স্লোগান দেয়। স্বাধীনতার স্লোগান নিয়ে যারা কৌতুক করতে ভালবাসে তারা হয় চূড়ান্ত আত্মকেন্দ্রিক, নয়তো এই দেশকে ধারণ করে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই টাকা কোথা থেকে আসবে?
বাংলাদেশের আয়কর বিভাগের তথ্যমতে, মাত্র ১ ভাগ মানুষ তাদের আয় বাৎসরিক ২ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা প্রদর্শন করেন। অন্যদিকে, প্রাইভেট কারের সংখ্যা দেড় কোটি। কি পরিমাণ মানুষ ইনকাম ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছে এ তথ্য থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়। সরকারের টাকার অভাব পড়লে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের বাবা মায়ের ইনকাম ট্যাক্স এবং ব্যয়ের সঙ্গতি-অসঙ্গতি খতিয়ে দেখা হোক। একইভাবে দেখা হোক সরকারী, বেসরকারী চাকুরে, ব্যবসায়ী, আইনজীবি, ডাক্তার সহ সকল পেশাজীবিদের সম্পত্তি আয় ব্যয়ের খতিয়ান। চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়, অনেক বিলাসী বনের রাজা ওসমান গনি ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু এটা করা আর বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়া একই কথা হবে। তাতে অনেক রাঘব বোয়ালের ফেঁসে যাবার শতভাগ সম্ভাবনা আছে।
তবু বলবো, প্রবল জনমত এবং কিছু মানুষের মধ্যে সদিচ্ছার উদ্রেক হলে সম্ভব, খুবই সম্ভব। তবুও যদি রাষ্ট্রের আয় ব্যয়ের হিসেব না মিলে তবে ভ্যাট নিন, তবে সেটা অবশ্যই শিক্ষা লোন থেকে। যার সামর্থ্য নেই তার উপরে অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দিয়ে নয়।
সবশেষে, রাষ্ট্র এবং নাগরিক একে অন্যের পরিপূরক। একজন ভাল না থাকলে আরেকজন থাকবে না এটাই নিয়ম। রাষ্ট্রের কাছে আমি দাবি জানাই, ভ্যাট নয় শিক্ষা ঋণ চাই। শিক্ষার্থীদের ভালো লাগবে না জানি, তবু এটাই বাস্তবতা- বর্তমান ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন হচ্ছে অন্ধের হাতি দর্শন। বরং আন্দোলন চাই সরকারীভাবে প্রতিটি ছাত্রের বিনা সুদে অথবা নামমাত্র কিংবা স্বল্প সুদে শিক্ষা ঋণ নিয়ে। এটা তাদের ন্যায্য পাওনা। এই পদ্ধতি বাস্তবায়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয় সমুহেরও চাইলে ফি বাড়ানোর সুযোগ থাকবে না।
আপনারা ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন করছেন, সময়ের প্রয়োজন মেটাচ্ছেন। কিন্তু বারবার এভাবে পারবেন না। স্থায়ী সমাধানের জন্য শিক্ষা ঋণের দাবি করুন। ও হ্যাঁ, "জয় বাংলা, ভ্যাট সামলা" ওয়ালা মানুষদের থেকে সাবধান। যে বা যারা নিজের স্বাধীনতা নিয়ে উপহাস করতে পারে তারা সুযোগ পেলে আপনাদের পিঠেও ছুরি বসিয়ে দিতে পারে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য