আজ বৃহস্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪

Advertise

ক্রিকেট কোন ভদ্রলোকের খেলা?

ড. শামীম আহমেদ  

সোমবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটের খেলায় বাংলাদেশ শ্রী লংকাকে হারিয়েছে। এই খেলায় বাংলাদেশের জয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আলোচনা হচ্ছে সাকিব আল হাসান আর এঞ্জেল ম্যাথিউসেয়ের মধ্যে টাইমড আউট নিয়ে বিতর্ক। সাকিব আল হাসান সবকিছু নিয়ম মেনে করেছেন। ওদিকে ইচ্ছা করলে এই আউট না নিয়ে খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব দেখানো যেত, এই দুধরনের বিতর্ক আমরা জানি। জেনেই একেক জন একেক পক্ষ নিয়েছে। সে বিতর্কে যেতে চাই না।

আমি ভাবছিলাম যারা মনে করছেন আইসিসি'র সকল নিয়ম মেনে, দেশের স্বার্থে, নিজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে মেনেও সাকিব এই আউট নিয়ে ঠিক করেননি, তাদের প্রধান যুক্তি ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা। সেখান টাইমড আউট নেয়া ভদ্রোচিত আচরণ নয়। আমি এই জায়গাটি নিয়ে একটু কথা বলতে চাই।

ক্রিকেট যে ভদ্রলোকের খেলা - এই কথাটির প্রচলনের সূত্রপাত কলোনিয়ালিস্টিক, সাম্রাজ্যবাদী, বর্ণবাদমূলক শাসনের ধারাবাহিকতা। ক্রিকেটে একসময় রাজত্ব করত ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ, মূলত শাদা বর্ণের উচ্চবর্ণের মানুষদের খেলা ছিল ক্রিকেট। বহু বহু বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশ বা আফ্রিকার মানুষরা ক্রিকেট খেলতে পারত না, কারণ ব্রিটিশ রাজ বা তাদের মতো অন্যান্য ক্ষমতাশীল বর্ণবাদী সমাজগুলো কালো বা বাদামী মানুষদের কেবল দাস বা ভৃত্য হিসেবেই বিবেচনা করত, তাদের নোংরা এবং সভ্য সমাজের অযোগ্য বলে মনে করত।

ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা, এটির সূত্রপাত মূলত কীভাবে ক্রিকেটে উচ্চবর্ণের, ধনী, ক্ষমতাবান, চোস্ত ইংরেজি বলা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষরা জড়িত, কীভাবে এটিতে বর্বর ভারতীয়, আফ্রিকান কালো ও বাদামী মানুষরা অচ্ছুত তারই ইঙ্গিত দিত ব্রিটিশ ও তাদের অধীনস্থ অন্যান্য শাদা সাম্রাজ্যবাদ শাসকরা।

আপনি যখন অবচেতন মনে ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা বলে দাসত্ববাদের স্তুতি করছেন, নিজের দেশের বিরোধিতা করছেন, ভাবছেন ভদ্রলোকের খেলা মানে নিয়ম না মেনে আউট না নেয়া, তখন বিনীতচিত্তে আপনাদের একটু গভীর ভাবনা-চিন্তা করবার আহ্বান জানাই। গত অর্ধ দশকের ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া দলগুলোর স্লেজিং এর ইতিহাস ঘাঁটুন। দক্ষিণ এশিয়ার ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-শ্রী লংকা অথবা আফ্রিকার দক্ষিণ আফ্রিকা-জিম্বাবুয়ে-কেনিয়ার দেশগুলোর সাথে এইসব তথাকথিত ভদ্রলোকেরা ভদ্রলোকের খেলায় কেমন আচরণ করেছেন, কেমন বর্ণবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল খতিয়ে দেখুন, জানুন। দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ের দেশগুলোতে কালো বর্ণের খেলোয়াড়দের জায়গা পেতে কত বছর অপেক্ষা আর কত শত লড়াই করতে হয়েছে গবেষণা করুন।

আপনি যে খেলাকে ভদ্রলোকের খেলা বলছেন, সেই খেলাকে ভদ্রলোকের খেলা তারা এইজন্য বলত যে আপনি এই খেলা খেলতেন না। আপনি তাদের জামা-জুতো গুছিয়ে দিতেন, ব্যাট-বল সাজিয়ে দিতেন আর তারা সেগুলো দিয়ে আপনাকে অত্যাচার-নিপীড়নের সাথে সাথে উপভোগ করত।

ক্রিকেট তখনই ভদ্রলোকের খেলা হয়েছে যখন থেকে সাম্রাজ্যবাদীদের আধিপত্য ভেঙে দিয়েছে আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। যখন থেকে ভারত মাথা তুলে বিশ্ব দরবারে জায়গা করে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্যকে নস্যাৎ করে দিয়েছে তখন থেকে। যেদিন সৌরভ গাঙ্গুলী লর্ডসে নিজের শরীর থেকে জার্সি খুলে বিশ্ব ক্রিকেট মানচিত্রে ভারতের জয়গাঁথা তুলে ধরলেন, সেদিন থেক এটি ভদ্রলোকের খেলা হয়েছে।

সাকিব আল হাসান সেই মানুষ যে জানে যে এই সিদ্ধান্তের কারণে তার তীব্র সমালোচনা হবে। কিন্তু সাকিব দেশের স্বার্থে সকল নিয়ম মেনে এই আউটটি নিয়েছেন যা আম্পায়াররা নিশ্চিত করেছেন। পৃথিবীর সকল খেলোয়াড় ক্রিজে নামার বহু আগে হেলমেট, প্যাড সকল যাচাই বাছাই করে প্যাভিলিয়নে প্রস্তুত থাকে নামার জন্য। আইসিসিই তাই নিয়ম করেছে সকল প্রস্তুতি নিয়ে খেলোয়াড়কে ২ মিনিটের মধ্যে প্রথম বল খেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। ম্যাথিউস সেটি করেননি। সাকিব যা করেছেন সঠিক করেছেন, নিয়ম মেনেই করেছেন।

ক্রিকেট যদি ভদ্রলোকের খেলা হয়, তবে সাকিবকে প্রশংসা করুন আইসিসির নিয়ম মেনে আপিল করার জন্য। নিয়ম আছে, কিন্তু সেটি না মানার যে ভদ্রতার কথা আপনারা বলছেন, সেটি একটি ভুল ধারণা, সাম্রাজ্যবাদীদের আধিপত্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষায় চিত্রায়িত।

ক্রিকেট যদি ভদ্রলোকের খেলা হয়ে তাহলে শ্রী লংকার শাস্তি দাবি করুন খেলা শেষ বাংলাদেশ দলের সাথে হাত না মেলানোর জন্য। তাদের শাস্তি দাবি করুন পুরো খেলায় বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানদের ক্রমাগত স্লেজ করার জন্য, দুর্ব্যবহার করার জন্য। বরং মিরপুরে হাসান মাহমুদ প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে আউট করার পরে তৎকালীন অধিনায়ক লিটন দাস যে আবার ব্যাটসম্যানকে ফিরিয়ে এনেছিলেন, তাতে করে তিনি নিজের বোলারকে ছোট করেছেন, আইসিসির নিয়মকে অগ্রাহ্য করেছেন, এবং অধিনায়ক হিসেবে ব্যক্তিত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছিলেন।

নিজের দেশ একটা খেলায় জিতল, চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে জায়গা পাবার সম্ভাবনা তৈরি করল আর আপনারা সেই দল এবং তার নিয়ম মানা ক্যাপ্টেনকে অযৌক্তিকভাবে সমালোচনা করছেন অন্যায় করা একটি দলের ও তাদের একজন খেলোয়াড়ের পক্ষ নিয়ে? বাংলাদেশীরা যে জাতি হিসেবেই বেইমান এটিও দিন দিন প্রমাণিত হচ্ছে। সিরাজউদ্দৌলাকেও পরাজিত করেছিল নিজ দেশের বেইমান মীরজাফর, বঙ্গবন্ধুকেও হত্যা করেছিল নিজ সেনাবাহিনী, মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ হত্যাও পাকিদের সাথে সমানভাবে তাল মিলিয়েছিল দেশী রাজাকার আল-বদররা।

ভদ্রতার যে মিথ্যা সংজ্ঞা দিয়ে আপনাকে সাম্রাজ্যবাদের ভৃত্য বানানোর চেষ্টা চলছে তার থেকে বেরিয়ে আসুন প্লিজ।

ড. শামীম আহমেদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সামাজিক-বিজ্ঞান গবেষক।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০৪ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৮ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ