প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আরিফ জেবতিক | ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫
গত বছরের কথা। আমার এক গরীব আত্মীয়া গ্রাম থেকে ফোন করেছেন, তাঁর ছেলে কিছুদিন আগে জিপিএ৫ পেয়ে এইচএসসি পাশ করেছে এবং কিন্তু কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি। তিনি এখন ছেলেকে সিলেটের একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএতে ভর্তি করতে চান, এই বিষয়ে আমার পরামর্শ চান।
এই আত্মীয়ার স্বামী মারা গেছেন বেশ আগে, সুতরাং ছেলেটি তাঁর শেষ আশ্রয়; পারিবারিকভাবে বছর খোরাকি চলে যাওয়ার মতো কৃষিজমি থাকলেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যয়বহুল পড়াশোনা চালানোর কোনো সামর্থ তাঁদের নেই।
আমি ছেলেটির সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ ফোনে কথা বললাম। পুরো অবস্থা ব্যাখ্যা করে আমি তাঁকে দুইটি পরামর্শ দিলাম।
প্রথমটি হচ্ছে মদন মোহন কলেজে বিকম এ ভর্তি হওয়া। খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করে ভালো রেজাল্ট করলে আমি তাঁকে পরবর্তীতে ঢাকায় চার্টার্ড একাউটেন্সিতে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে সব সহযোগিতা করব বলে আশ্বাস দিলাম। তাছাড়া কস্ট ম্যানেজ একাউন্টেন্সি এবং বিকম এর ভালো রেজাল্ট সাপেক্ষে ভালো করে কোচিং করে এমনকি আইবিএ'তে এমবিএতে ভর্তির সুযোগ নেয়ারও পরামর্শ দিলাম।
আমার দ্বিতীয় পরামর্শ ছিল এমসি কলেজে ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হওয়া, সেখান থেকে মাস্টার্স করে তারপর বিসিএস দেয়া অথবা আইন পেশায় চেষ্টা করা। আমি তাঁকে বললাম, ইংরেজির ভিত যদি ভালো হয়, তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করো, তাহলে ভবিষ্যতে তুমি একদিন হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করতে পারবে।
আমার কাছে মনে হলো ছেলেটি কিংবা তাঁর অবিভাবক, উনারা দুইজনই আমার পরামর্শে সন্তুষ্ট হলেন না। তাঁরা বিবিএ পড়বেনই, আকারে ইঙিতে যেটা বলার চেষ্টা-সেটা হলো ফ্রি উপদেশ না দিয়ে যদি আমি কিঞ্চিৎ আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস দেই, তাহলে এরকম কিছু আর্থিকভাবে স্বচ্ছল আত্মীয় স্বজনের সহযোগিতায় ছেলেটির 'স্বপ্ন' পূরণ হয়। বলা বাহুল্য, আমি সেই প্রস্তাব সুকৌশলে এড়িয়ে গেছি। পরবর্তীতে আমি জেনেছি যে ছেলেটি ভর্তি হয়েছে এবং আমাদের বেশ কিছু আত্মীয় স্বজনের সহায়তায় সে ওখানে পড়াশোনাও করছে।
এই ঘটনার পরে আমি আমাদের আত্মীয় স্বজনের মধ্যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে এমন বেশ কিছু ছেলেমেয়েকে খুঁজে বের করেছি। আমি লক্ষ করেছি, কয়েকবছর আগেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার ব্যাপারটি শুধুমাত্র উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলেও গত কয়েকবছর ধরে এই প্রবণতা একেবারে গ্রামের মধ্যবিত্তদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ছে। হালের গরু বেঁচে হলেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ পড়তে হবে-এটা অন্তত আমাদের সিলেট শহরে একেবারে উড়িয়ে দেয়ার মতো সংখ্যা নয়।
এর মূল কারণটি আমার কাছে মনে হয়েছে আমাদের রেজাল্ট বিষ্ফোরণ।
আজকাল জিপিএ ফাইভের নিচে কেউ সহজে পায় না, সুতরাং জিপিএ ফাইভ পাওয়া মাত্রই প্রত্যেক ছাত্রের মাঝে খুব আত্মবিশ্বাসের জন্ম হয়। সবার আসল যোগ্যতা আর তৈরি হওয়া আত্মবিশ্বাসের মাঝে হয়তো বিস্তর ফারাক আছে, কিন্তু সেটা একজন তরুণের পক্ষে বুঝা আসলেই সবসময় সম্ভব নয়।
আর এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস তাঁকে বিবিএ কিংবা এমন বাজার চলতি সাবজেক্টগুলোতে ভর্তি হতে উৎসাহিত করছে।
সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সমান নয়, অনেকে মানসম্মত শিক্ষা দিলেও অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ই চলছে জোড়াতালি দিয়ে। নিয়মকানুন মেনে চলা স্বনাম ও সুনামধন্য হাতে গোনা কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করছে কারণ তাঁদের ভর্তি পদ্ধতিও বেশ কঠোর, পরবর্তীতে পড়াশোনার বিষয়টিও শক্তভাবে মান নিয়ন্ত্রিত।
কিন্তু এদের সুনামকে সামনে রেখে হরেদরে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আরো কমদামে এবং দামের তুলনায় আরোও কম মানে কোর্স অফার করে মধ্যবিত্তকে আকর্ষণ করছে।
মা-বাবার কষ্টের টাকা শ্রাদ্ধ করে, এমনকি প্রাণপনে পড়াশোনা করে সার্টিফিকেট নিয়েও এদের পক্ষে শুধু ইন্সটিটিউটের অযোগ্যতার কারণে পেশাজীবনে ঢুকতে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। (কর্পোরেটদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে কাজ করার সুবাদে আমি জানি এরকম অনেক নাক উঁচু প্রতিষ্ঠান কোন কোন ভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের আবেদন বিবেচনাই করবে না, সেরকম অলিখিত রেওয়াজ চালু আছে)।
এরা ইচ্ছেমতো ফি নিচ্ছে অথচ ভালো শিক্ষক নিচ্ছে না। বাসাবাড়িতে ঘিঞ্জির মধ্যে ভার্সিটি চালাচ্ছে, নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাওয়ার কোনো চেষ্টাই করছে না। অনেকে অনুমোদন ছাড়াই ছাত্র ভর্তি করেছে এবং পরে এই ছাত্রদের দায় দায়িত্ব সহজে কেউ নিতে এগিয়ে আসেনি।
এই গোটা ব্যবস্থাটি আসলে শেয়ার বাজারের মতোই আরেকটি সংকট। শেয়ার বাজারে যেভাবে মানুষের লোভ জাগিয়ে কেউ নূন্যতম অর্থনীতির নিয়ম কানুন বুঝুক কি না বুঝুক, সবাইকে দিয়ে দলে দলে শেয়ার কিনিয়ে সেই লোকগুলোকে কৌশলে নিঃস্ব করা হয়েছে; প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলাতেও অনেকটা এরকমই করা হচ্ছে কী না এই প্রশ্নটি আমি রাখতে চাই।
ঝাঁকে ঝাঁকে অতিমূল্যায়িত এসএসসি-এইচএসসির রেজাল্ট থেকে শুরু করে কিছু কিছু সাবজেক্ট সম্পর্কে অতিরিক্ত হাইপ তুলে মধ্যবিত্তের স্বভাবজাত স্বপ্নালুতাকে উস্কে দিয়ে এখানেও খুব নীরবে আরেকটি ছিনতাই চলছে। এই চক্রে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে অনেক প্রভাবশালীই হয়তো দড়ির দুইপাশ ধরে বসে আছেন, বছরে বছরে গন্ডায় গন্ডায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের হিড়িক সেদিকেই ইঙিত করে।
সরকারের উচিত হবে এই বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবনা-চিন্তা করা, শুধুমাত্র বড়লোকের ছেলেরা পড়ছে মনে করে ভ্যাটের বস্তা নিয়ে দৌঁড়ে চলে আসার চাইতে বরং গোটা ব্যাপারটা নিয়েই আরো বেশি করে খোলামেলা আলোচনা মধ্যবিত্তকে আরেকটি নীরব লুটপাটের হাত থেকে হয়তো রক্ষা করবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য