প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫
আজকের এই প্লাস্টিক স্মার্টনেসের যুগে; হঠাত নগরায়িত তল্লাটে মহসিন ভাইয়ের মত মৌলিক মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। রাজনীতিতে যে গুটিকতক মানুষ নিজের সম্পদ উজাড় করে দিয়ে মানুষের সেবা করতে আসেন; উনি তাদের একজন। বঙ্গবন্ধুর এই মানুষকে নিঃশর্তভাবে ভালোবাসার আদর্শটি খুব অল্পবয়েসেই জারিত হয় মহসিন ভাইয়ের মাঝে। একজন মানুষ ডানে-বামে না তাকিয়ে সোজা হেঁটে গেছেন তাঁর নেতার দেখানো পথে।
অত্যন্ত সম্পন্ন পরিবারের ছেলে মহসিন নেতার ডাকে মুক্তিযুদ্ধে গেছেন; জীবনবাজী রেখেছেন। পিছে ফিরে তাকাননি একটি বারের জন্য। রণাঙ্গণে তাঁর সহযোদ্ধা এক কিশোরের মৃত্যু তাঁকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পুড়িয়েছে। একজন পিতার মত পুত্রশোক বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। এ যে তাঁর বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেই শেখা। নিজের সন্তান আর আদর্শের সন্তানের মাঝে কোন পার্থক্য টানতে শেখেননি তিনি। আর্ণেস্ট হেমিং ওয়ের 'দ্য সান অলসো রাইজেস' উপন্যাসের নায়ক জেক বার্ণসের মতো যুদ্ধ ফেরত শোকের আর দুঃসহ স্মৃতির পাথর বয়ে বেড়িয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা মহসিন আলী। হাসিমুখ এই মানুষটা বুঝতে দেননি, ভেতরে তার কতোটা পুড়লো; কতটা ছাই।
মহসিন আলীর পারিবারিক ঐতিহ্য হচ্ছে শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য নিজেদের সম্পদ উজাড় করে দেয়া। সিলেটে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়তে পারিবারিক জমি উপহার দিয়েছে মহসিন আলীর পরিবার। আমরা হয়তো হিন্দু জমি ও সম্পদ দখলের এই সর্বদলীয় বর্বরতার যুগে হয়তো এখনো অনুধাবন করতে পারছি না; মহসিন ভাইয়ের চলে যাওয়া মূলতঃ নিঃস্বার্থ রাজনীতির বিরল কয়েকটি দেউটির একটির নিভে যাওয়া।
সংগীত মহসিন ভাইয়ের আরেকটি ভালোবাসার জায়গা। এই স্মৃতিতীর্থ মানুষটি হাজার খানেক গান মুখস্ত করে ফেলেছিলেন।সমাজ-রাজনীতির এই অসুরের দোর্দন্ড প্রতাপের যুগে তিনি ছিলেন একজন সুরের মানুষ। উন্নাসিক ফ্রেডেরিশে নীটশেও স্বীকার করে গেছেন, সংগীত-হীন জীবন একটি বড় ভ্রান্তি। নীটশের ‘উতকৃষ্ট’ মননের মানুষ চয়নের মানদন্ডটি নানা কারণে বিতর্কিত। কিন্তু কোথাও কোথাও তার তত্ত্বকে অস্বীকার করার কারণ খুঁজে পাইনা। মহসিন আলীর ধমণীতে সতত সুর আর কল্যাণের বাণী তাঁকে উদ্দীপিত করতো এ আমরা দেখতে পাই উনার কাজে।
হাইব্রীড রাজনীতির মন্ত্রীদের বাসার গেট পেরিয়ে বারান্দা পর্যন্ত পৌঁছানো যেখানে অসম্ভব দারিদ্র্যে বিশীর্ণ মানুষের জন্য; সেখানে মন্ত্রী মহসীনের বাড়ীর দরজাটি খোলা ছিলো সবার জন্য। উনার বাড়ীতে অধিকার বঞ্চিত মানুষেরা রীতিমত আত্মীয়ের মতো বসবাস করতো। মানুষ চলে যাওয়ার পরে সবাই তাঁর সম্পর্কে ভালো কথা বলে; কিন্তু মহসিন ভাইয়ের চলে যাওয়ায় কী-বোর্ডের ওপর অপ্রতিরোধ্য অশ্রু গড়িয়ে পড়ে একজন মৌলিক মানুষকে হারিয়ে ফেলার বেদনায়।
অধিকাংশ রাজনীতিকের মৃত্যুতে আজকাল যেখানে মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে; সেখানে আজ কাঁদছে অনেক আত্মীয়; অনেক জায়গায়; যাদের মহসিন ভাই জিজ্ঞেস করতেন, ভাত খেয়েছো!
মহসিন আলী তাঁর নেতা বঙ্গবন্ধুকে আত্মস্থ করেছিলেন গভীরভাবে। সংবিধান কাটাছেঁড়া হয়েছে; রাষ্ট্রের চরিত্র বদলেছে; কিন্তু বদলাননি মহসিন ভাই। অসাম্প্রদায়িকতা আর কল্যাণ ও সাম্যভাবনার মুজিব আদর্শকে সযত্নে লালন করেছিলেন তিনি। তিনি আমন্ত্রণ পেলে মিলাদে গেছেন; ডাক পেলে পুজা-পার্বণে গেছেন। সত্য-সুন্দর-মঙ্গল যেখানেই খুঁজে পেয়েছেন; সেখানেই ছুটে গ্যাছেন জীবনের জয়গান গাইতে।
তিনি পিতা হিসেবে নিজের সন্তানদের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। মেয়ের বিয়ের সময় পার্শ্ববর্তী একটি ময়দানে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন; এতো স্বজন তাঁর; সবাইকে আপ্যায়ন করেছেন। বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য একটি প্রশস্ত প্রবেশ পথ তৈরী করতে হয়েছিলো একটি দেয়াল ভেঙ্গে। অনুষ্ঠানটি শেষ হলে দেয়ালটি পুননির্মাণ করান তিনি। রাজনীতির কোন গড ফাদারের এই বোধ-বুদ্ধি থাকে না; তারা কেবল ভাঙ্গতে জানে; গড়তে জানে না। কিন্তু মহসিন ভাইতো গডফাদার ছিলেন না; তিনি ছিলেন সুসংস্কৃতি সম্পন্ন মানুষ। যে সংস্কৃতি আমরা বুয়েট থেকে পাশ করা কোন মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ারের মাঝে দেখিনা; দেখিনা কথিত সার্টিফিকেটধারী স্যুট-কোট-টাই পরা নিও এলিট হাইব্রিড মন্ত্রীদের মাঝে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় সিলেটের রাজন নামের শিশুটির মৃত্যুদৃশ্য শেয়ার করা না হলে, যে সাংবাদিকরা এই তথ্যটি জানাতে পারতো না; তারা নিয়মিতভাবে মহসিন কোথায় কখন ধূমপান করছেন; তার আপডেট দিতো। এই করিতকর্মা সাংবাদিকেরা নিজেদের বিনোদনহীন জীবনে একজন শিশুমনের মানুষ মহসিন ভাইকে নিয়ে রঙ্গ-রসিকতা করে পত্রিকার সার্কুলেশান বাড়িয়েছে; অথচ চাবুক মারতে চাওয়া উপমানব রাজনীতিবিদদের সংবাদগুলো কালে ভদ্রে দিয়েছে।
এদিকে রাজধানীতে প্রথম পুরুষের নিও-এলিটিজমের রোগীরা যাদের লাইফ সাকস; তারা সাংস্কৃতিক বিবর্তনে এগিয়ে থাকা পরিবারের গায়ক মানুষটিকে নিয়ে রগড় করে নিজেদের আরবান সুপিরিওররিটি প্রদর্শনের কাজটি নিয়মিত করেছে। আমরা জানি ইনফেরিওররিটি কমপ্লেক্স থেকেই এরকম সুপিরিরিওররিটি কমপ্লেক্স তৈরী হয়।
কোন ডাকাত মন্ত্রী যখন সুন্দর সুন্দর কথা বলে; চেতনার ফানুস ওড়ায়; এই মেট্রোপলিটান সাবহিউম্যানেরা তার সঙ্গে সেলফি তুলে শেয়ার করে নিজের ‘স্টেইটাস’ বাড়ায়। অসুরের সঙ্গে অসুরের মনের মিল তো হবেই।
মহসিন ভাইকে বোঝার মত গভীর বোধ ফাঁপা-সমাজের কাছে প্রত্যাশা করাই অনুচিত। উনি হঠাত করেই চলে যাবেন এমন ভাবিনি। যে তরুণ গণভবনের পুকুর পাশে বসে বঙ্গবন্ধুকে গান শোনাতো; সে আজন্ম তরুণ আমাদেরও গান শুনিয়েছেন। আমরা এই তরুণ মহসিন এবং মৌলিক মানুষ মহসিনের নামটি কাগজে লিখিনি; কারণ তা ছিঁড়ে যাবে। পাথরে লিখিনি; কারণ তা ক্ষয়ে যাবে। হৃদয়ে লিখেছি; সে নাম রয়ে যাবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য